শিক্ষা নগরী রাজশাহীর “রাজশাহী কলেজ” এর  সার্ধশত জন্মবার্ষিকী: শুভ জন্মদিন রাজশাহী কলেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: উত্তর বঙ্গের প্রাণকেন্দ্র বিভাগীয় শহর রাজশাহীর অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভাগ হিসেবে পশ্চিমে মুর্শিদাবাদ (যা এখন পশ্চিমবংগ) জেলা রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজকের এই শিক্ষা নগরীর রাজশাহী কলেজ জ্ঞানের,শিক্ষার পথকে সমৃদ্ধি করে চলেছে প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে।
আকাশী-সত্য, লাল-সুন্দর, সবুজ-বিশ্বজনীনতা ও কমলা-পবিত্রতা এই চারটি বৃত্তের মাঝে আবিষ্ট হয়ে আছে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ। যা জ্ঞানের প্রতীক। একটি ফিতার বন্ধনে বন্ধুত্ব ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রতীকের মাঝে প্রদীপ শিখা হয়ে দাঁড়িয়ে আলোকিত মানুষ। শিক্ষানগরী রাজশাহীতে অবস্থিত আলোকিত মানুষ তৈরির মুলমন্ত্র নিয়ে ১৮৭৩ সাল থেকে পথচলা দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ পদযাত্রায় সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করলো।
দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৫০ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব ঐতিহাসিক এই প্রতিষ্ঠান গৌরবের সার্ধশতবর্ষে পা রেখেছে।
১৮২৮ সালে বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিক্ষানগরী হিসেবে রাজশাহী মহানগরীর গোড়াপত্তন হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় এই প্রতিষ্ঠান আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব নিয়ে পথচলছে রাজশাহী কলেজ।
পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ১৮৭৩ সালে ১ এপ্রিল মাত্র ছয় জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সোনালী ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত দেশ সেরা এই প্রতিষ্ঠান। ১৮৭৮ সালেই এর ছাত্র সংখ্যা একশতে উন্নীত হয়। ১৯০০ সালে দুইশ, ১৯১০ সালে চারশ, ১৯২০ সালে আটশো এবং ১৯২৪ সালে এক হাজারের শিক্ষার্থী সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২৬ হাজার। পাঠদানে নিয়োজিত আছেন প্রায় ২৪১ জন শিক্ষক।
প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি ভবন, শিক্ষক মিলনায়তন, অধ্যক্ষের বাসভবন, শিক্ষক কোয়াটার, শিক্ষার্থী হোস্টেল, কেন্দ্রীয় মসজিদ, পুলিশ ফাঁড়ি, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ব্যায়ামাগার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মিউজিয়াম, গ্যাস প্ল্যান্ড, নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থা, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, পুকুর, বিরল প্রজাতির বৃক্ষ সংরক্ষণ কর্ণার, রজনীকান্ত সেন মঞ্চ, উদায়াস্তে বাংলাদেশ টেরাকোটা, শহীদ মিনার, স্বাধীনতা চত্বর ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুউচ্চ মুর‌্যালের সমৃদ্ধ লাল-সাদার ঐতিহাসিক স্থাপনার সবুজ ক্যাম্পাস রাজশাহী কলেজ।
দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল সংকটে রাজশাহী কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। তারা স্বদেশী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় ছাত্র হত্যাকান্ডের পরপরই রাজশাহী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়।
ভাষা আন্দোলনকে উৎসর্গ করে শহীদদের স্মরণে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় কলেজের মুসলিম হোস্টেলের সামনে। কিন্তু এখনোও তার জাতীয় স্বীকৃতি মেলেনি। এই কলেজের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ১৯৬২ এবং ১৯৬৯ ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাহস এবং বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছেন।
ঢাকা কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে দেশের ৩য় প্রাচীনতম কলেজ ‘রাজশাহী কলেজ’। প্রাচীনতার দিক থেকে ৩য় হলেও উচ্চ মাধ্যমিক ও জাতীয়প্রতিষ্ঠার শুরুতে রাজশাহী কলেজের কোন নিজস্ব ভবন ছিল না।
রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা কলেজের প্রথম ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। একজন দক্ষ ইংরেজ প্রকৌশলীর পরিকল্পনায় ১৮৮৪ সালে ৬১ হাজার ৭০০ টাকা ব্যয়ে বর্তমান প্রশাসন ভবনটি নির্মিত হয়। গাঢ় লাল বর্ণের দোতলা ভবনটি কালের গ্রাস জয় করে নগরীর প্রধান ও প্রাচীনতম ভবন হিসেবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ভবনটি ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের অন্যতম উদাহরণ।
উপনিবেশিক আমলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরোনো ভবনগুলো হলো- ফুলার ছাত্রাবাস, জীববিজ্ঞান ভবন, রসায়ন ভবন, পদার্থবিজ্ঞান ভবন, প্রাক্তন মুসলিম ছাত্রাবাস। ১৯৫০ সালের পর নির্মিত হয়েছে লাইব্রেরি ভবন, কলা ভবন ও অডিটোরিয়াম।
১৯৯০ সালে একটি নতুন বিজ্ঞান ভবন নির্মিত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজশাহী কলেজে গড়ে উঠেছে পাঁচটি বিজ্ঞান ভবন, দুইটি কলাভবন, ইংরেজি বিভাগের জন্য একটি পৃথক ভবন, পুকুরের পশ্চিম পাশে রয়েছে হাজী মোহাম্মদ মহসীন গ্যালারি ভবন। গ্যালারি ভবন ১৮৮৮ সালে নির্মিত হয়ে প্রথমে রাজশাহী মাদ্রাসা নামে এবং পরে হাজী মোহাম্মদ মহসীন গ্যালারি ভবন হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রখ্যাত দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসীন এর আর্থিক অনুদানে এই ভবনটি নির্মিত হয়।
১৯০৯ সালে নির্মিত হয় কলেজেরে অন্যতম একটি সুন্দর স্থাপনা মোহামেডান ফুলার হোস্টেল। বর্তমানে ভবনটি কলেজের বাংলা, ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, উর্দু, সংস্কৃত, দর্শন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুকুর পাড়ে জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের নামকরণে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
কলেজের সম্মুখ চত্বরে আছে একটি শহিদ মিনার এবং শহিদ মিনারের পশ্চিমে অবস্থিত লাইব্রেরি ও অডিটোরিয়াম ভবন। এছাড়া সম্প্রতি আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন দু’টি হোস্টেল নির্মাণ করা হয়েছে। আধুনিক ক্লাসরুম বিশিষ্ট ১০ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
প্রমত্তা পদ্মা নদীর উত্তরে হযরত শাহ  মখদুম র:(রু:) এর মাজারের পূর্ব পাশে নির্মিত হয় অধ্যক্ষের দোতলা বাসভবন। এই ভবনটিতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদগণ বসবাস করে গেছেন। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষদের বাসভবন হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ভবনটি এখনও স্বমহিমায় অক্ষত রয়েছে। অধ্যক্ষের বাসভবনের পূর্বপ্রান্তে শিক্ষকদের জন্য রয়েছে দুটি তিন তলা আবাসিক ভবন।
রাজশাহী কলেজের প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ হলো গ্রন্থাগার। যেখানে পুরাতন মূল্যবান ও সাম্প্রতিক সংষ্করণের বই, জার্নাল এবং সাময়িকীর প্রাচুর্য রয়েছে। কলেজ গ্রস্থাগার অনেক দুর্লভ বই, গেজেট, এনসাইক্লোপিডিয়া, পান্ডুলিপিতে সমৃদ্ধ।
মূলত ইংরেজি শিক্ষার প্রতিস্থাপনা ও প্রসারকল্পে রাজশাহীতে কর্মরত ইংরেজ কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল। সেদিনের সে ক্ষুদ্র বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ১৮৩৬ সালে প্রাদেশিক সরকার জাতীয়করণ করলে এ স্কুলটি রাজশাহী জেলা স্কুল ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল হিসেবে পরিচিতি পায়।
এই স্কুলের ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিলে রাজশাহী অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৮৭৩ সালে জেলা স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের মর্যাদা দেয়া হয়।
ওই বছরই ৫ জন হিন্দু ও ১ জন মুসলমান ছাত্রসহ মাত্র ছয় জন ছাত্র নিয়ে কলেজিয়েট স্কুলের সঙ্গে চালু হয় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর সমমানের এফ. এ (ফার্স্ট আর্টস) কোর্স। ১৮৭৮ সালে এই কলেজকে প্রথম গ্রেড মর্যাদা দিয়ে ‘রাজশাহী কলেজ’ নামকরণ করা হয়। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত করে এখানে বি.এ. কোর্স চালু করা হলে উত্তরবঙ্গের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ।
 বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কলেজের মধ্যে প্রথম ও শ্রেষ্ঠ হওয়ার গৌরবের ধারা অব্যাহত রয়েছে দেশসেরা এই কলেজের। বাংলাদেশে এই কলেজ থেকেই সর্বপ্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান শুরু হয়। কলেজটি মেট্রোপলিটন এই শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। কলেজের পাশ ঘেঁষেই রয়েছে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। তাই বলতেই হয় শুভ জন্মদিন রাজশাহী কলেজ।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো: মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.