রাবির গ্রন্থাগার হোক জীবন জীবিকামুখী শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত

রাবি প্রতিনিধি: দার্শনিক প্লেটো জ্ঞানের বিষয়ে বলেছেন, এই সংবেদনশীল চলমান বিশ্বে জ্ঞান হচ্ছে নিরন্তর ও অসীম প্রকৃতির। আরো সুনির্দিষ্ট করে তিনি বলেছেন, জ্ঞান হলো ন্যায়সঙ্গত সত্য বিশ্বাস। তার শিষ্য এরিস্টটল জ্ঞান বলতে বুঝিয়েছেন যা কিছু সত্য তাহাই জ্ঞান এবং এই সত্যটি অবশ্যই এমনভাবে সমর্থনযোগ্য হওয়া উচিত যা থেকে বোঝা যায় এটি অবশ্যই সত্য, এটি অপরিহার্য সত্য।

জ্ঞান বিষয়ে এই দুই কালজয়ী দার্শনিকের উদ্ধৃতি টানার উদ্দেশ্য হলো, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বসে বিসিএস গাইড পড়াটা জ্ঞান চর্চার অংশ কি না, সে বিষয়ে একটি বিতর্কের অবতারণা করা।

আজকের বাস্তবতায় লেখাপড়া শেষে একটি ভালো চাকরি হাতিয়ে নেয়াটা লেখাপড়ার অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে- এটি একটি চরম সত্য। আর এই চাকরি নামক সোনার হরিণ অর্জনে চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণ অতি আবশ্যক সেটাও অপরিহার্য সত্য। এই সত্য বিশ্বাসটিই এরিস্টটলের ভাষায় জ্ঞান। গ্রন্থাগারে বসে সেই জ্ঞান অর্জনে বাধা কোথায় আমি জানি না।

মূল প্রসঙ্গটি বলা দরকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ব্যবহারের নিয়মে কিছুটা পরিবর্তনের দাবি উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। কিছু শিক্ষার্থী আমাকে বিষয়টি অবহিত করেছেন এবং এ ব্যাপারে প্রশাসনের উদাসীনতা তাদেরকে ব্যথিত করেছে বলেও জানিয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব বই নিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়ার জন্য অনেক দিন ধরে তারা প্রশাসনের নিকট দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু প্রশাসন বরাবরই তাদের নিরাশ করে যাচ্ছেন কিছু যুক্তি তুলে ধরে। প্রশাসন হয়তো যোক্তিক কারণেই এ বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করছেন এই ভেবে যে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান চর্চার অন্যতম স্থান আর গ্রন্থাগার হচ্ছে সেই স্থানের জ্ঞান চর্চার সবচেয়ে উর্বর ভূমি এবং সেখানে বসে বিসিএস গাইড পড়াটা একেবারে মানানসই নয় বরং গ্রন্থাগারের প্রতি অসম্মানজনক।

এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস প্রস্তুতি নিয়ে চারদিকে একধরনের গণজোয়ার বইছে, যা অত্যন্ত সময় উপযোগী এবং যোক্তিক। মূল কথা হলো, তারা পড়তে চায়, পড়ার জন্য একটা ভালো নিরিবিলি পরিবেশ চায়। সেই বাস্তবতার নিরিখে ছাত্রদের গ্রন্থাগারে ব্যক্তিগত বই নিয়ে প্রবেশের যে দাবি উঠেছে সেটা আমার কাছে ন্যায্য এবং প্রশংসনীয় মনে হয়েছে। তারা তো বলেনি তাদের হলের খাবারের মান ভালো না, মান বাড়াতে হবে, তাদের থাকার জায়গা নেই, হলে সিটের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে কিংবা মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে হবে। বলছে না ওদের ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী চৌকষ ছেলেটিকে বাদ দিয়ে মেধাক্রমে নিচের দিকের সাধারণ মানের কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না, কিংবা তারা বলছে না এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যহানি করে অনেক শিক্ষকের অনুরোধ উপেক্ষা করে একই জাতীয় দুটি স্কুলের মধ্যে ন্যূনতম দূরুত্বের সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাজলা গেটের কোলাহলপূর্ণ মুখে স্কুল নির্মাণ করা যাবে না, কিংবা এই ক্যাম্পাসের গ্রাজুয়েট ছাড়া কাউকে সেকশন অফিসার বা সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না।

এমনকি তারা এও বলেনি, মাননীয় উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে প্রবেশ করে মনোমুগদ্ধকর ফুলের বাগানে হাঁটতে চাইনি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় শিক্ষকদের ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য তৈরি পার্কিং ভেঙে তাদের বাই-সাইকেল রাখার স্ট্যান্ড করতে বলেনি। যদিও প্রতিদিন কোনো না কোনো শিক্ষার্থী তার রক্ত ঘাম করে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনা বাই-সাইকেল হারাচ্ছে ক্যাম্পাস থেকে।

তাদের দাবি পড়ার দাবি। তারা শুধু চেয়েছে পড়তে, নিজেদের টাকায় কেনা বই এনে গ্রন্থাগারের নিরিবিলি পরিবেশে বসে জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছে। আবারও বলছি, তারা পড়তে চেয়েছে। জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছে। পড়া শেষে একটি চাকরির বন্দোবস্ত করার আশায়।

আজকে যখন বর্তমান প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছে, বিভিন্ন জব ফেয়ার, ক্যারিয়ার ক্লাব, আইটি ক্লাব’কে উৎসাহিত করছে, যাতে তারা নিজেদের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরো যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে, নিজেদের সৃজনশীল ও ফলদায়ক কাজে ব্যস্ত রেখে সকল প্রকার মাদকের ছোবল থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে, সেখানে শিক্ষার্থীদের এই দাবির প্রতি প্রশাসনের অসহযোগিতার মনোভাব অনাকাঙ্খিত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

আপনারা যারা মনে করছেন বিসিএস গাইড জ্ঞানের মানসম্মত কোনো উপকরণ নয়, তাদের বলছি একবার দেখুন সেখানে কী লেখা আছে সেটি পড়ে শিক্ষার্থীরা কী জানতে পারে। সেখানে কি লেখা নেই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের কথা, সেখানে কি নেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা, সেখানে কি বলা নেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী কিংবা কারাগারের রোজনামচার কথা, সেখানে কি লেখা নেই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলোর কথা কিংবা অকুতোভয় বীরশ্রেষ্টদের কথা? সেখানে আছে বাংলা ভাষা সাহিত্য থেকে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি যেন একই বাগানে নানান ফুলের চাষ। আপনি যদি বিসিএস এর বিষয়কে জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করতে সংকোচ বোধ করেন তাহলে কি পিএসসি চাকরি প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করছে ভুল মানদন্ডে? যারা বিসিএস কোয়ালিফাই করে প্রথম শ্রেণির ক্যাডার হচ্ছে তাদের কি তাহলে জ্ঞানী ভাবা যোক্তিক হবে?

যেখানে দেশের প্রধান পাবলিক লাইব্রেরি চাকরি প্রার্থীদের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে চাকরির প্রস্তুতি সংক্রান্ত যাবতীয় পুস্তিকা তাদের সংগ্রহে রেখেছে, যেখানে দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে নিজস্ব বই নিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে, সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন বিষয়টি নিয়ে এত দীর্ঘসূত্রিতা করছে বোধগম্য হচ্ছে না। এই সুযোগ ব্যবহার করে ২০ জন শিক্ষার্থী যদি ক্যাডার হতে পারে সেটি কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন নয়, আমাদের জন্য গর্বের নয় কী?
মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি শৈথিল্যতা দেখিয়ে যে ভুল করেছিল, আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিসিএস প্রস্তুতির বিষয়ে একই ভুল করে আমাদের সন্তানদের চাকরির বাজারে পিছিয়ে রাখবেন না।

হয়তো বলতেই পারেন বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ক্যারিয়ার রিলেটেড বইপত্র থাকে না কিংবা বই নিয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। একেবারে থাকে না সেটা ঠিক নয়Ñ সেখানেও কিন্তু এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিয়ার মতো জ্ঞানের বই থাকে, কিংবা রিডার্স ডাইজেস্ট থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সেখানে তো আমাদের মতো সকল বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্যের প্রমাণ দিয়ে চাকরি নিতে হয় না। একজন যে ডাক্তার হবেন তাকে কেন বাংলা ভাষায় সাহিত্যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে তার জ্ঞানের বহর প্রমাণ করে চাকরি নিতে হবে? যাহোক সে প্রসঙ্গে না যাই।

রাষ্ট্র তথা জনগণের বিপুল অর্থব্যয়ে যে গ্রন্থাগার বিশ্ববিদ্যালয়ের অহংকার হয়ে দাড়িয়ে আছে, সেটাকে যদি যথার্থ ব্যবহার করা না হয় তা সম্পদের অপচয়ই হবে। যতোদূর জেনেছি, অধিকাংশ সময় লাইব্রেরি ফাঁকা পড়ে থাকে। বই নিতে পারে না বলে লাইব্রেরি ব্যবহারে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ গ্রন্থাগারের বাইরের একটি অংশে যেখানে বই নিয়ে এসে পড়ালেখা করা যায়, যেখানে ভোর চারটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আসন নিশ্চিত করতে হয়। আমার কিছু শিক্ষার্থীও এখানে প্রতিদিন পড়াশোনা করে- বিকেলে তাদের চেহারার দিকে তাকালে খুব খারাপ লাগে। ভোরবেলা এসে এখানে আসন নিয়ে ঠিকমতো খাওয়া নেই গোসল নেই ঘুম নেই- কি অদম্য শক্তিতে বিসিএস প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র পিতামাতা আশায় বুক বেঁধে আছেন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান লেখাপড়া শেষ করে কবে একটি ভালো চাকরি পাবে।

আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা যদি বিসিএস প্রস্তুতির জন্য লাইব্রেরির মতো ভালো পরিবেশ পায়, পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পেতে তাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। বাবা-মায়ের মুখে দ্রুত হাসি ফোটাতে পারবে। আমি মনে করি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে আরো বেশি আন্তরিক হবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জাতীয় সম্পদটির সর্বোচ্চ উপযোগিতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন। এটা তো সত্য আজকের বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার উদ্দেশ্য যতটা না জ্ঞান অর্জন তার চেয়েও বেশি একটি চাকরি মেলানো। সারাবিশ্বে পড়ালেখার ধারায় পরিবর্তন এসেছে- এখন যতটা না জ্ঞানভিত্তিক তার চেয়েও বেশি ইন্ডাস্ট্রিকেন্দ্রিক- ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা মাথায় রেখে প্রতিনিয়ত তারা তাদের পঠন পাঠনে পরিবর্তন নিয়ে আসছে আর বাড়াচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি লিঙ্ক। সেখানে আমরা কেন এত পিছিয়ে থাকব? কমপক্ষে তাদের পড়ালেখার একটি ভালো পরিবেশ দিতে তো আমাদের বেতনে টান পড়বে না।

আমি শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি এবং অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে তাদের পছন্দের বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবার আহ্বান জানাচ্ছি। ব্যক্তিগত বই নিয়ে প্রবেশের অনুমতি না দিলে একটি ক্যারিয়ার কর্নার রাখতে পারেন, যেখানে কেবল ক্যারিয়ার সম্পর্কিত বইগুলো থাকবে।

যদি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থের সংকুলান করতে না পারেন, আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এক একটি করে বই সেখানে দিতে পারবে। প্রয়োজনে আমরাও তাদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারব। তাই আবারও আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি, সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, সেটিকে স্বাগত জানাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির কথাটি প্রাসঙ্গিক- একজন জ্ঞানী সেই যে নিজেকে আগে পরিবর্তন করে। আমরা আমাদের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল- প্রতিবছর কয়েক হাজার গ্রাজুয়েট তৈরি করছি যারা সমাজকে আলোকিত করবে পাশাপাশি একটি সম্মানজনক চাকরির সুযোগ তৈরি করে নিবে। সে ব্যাপারে আমরা আপোষ করতে চাই না বরং এই লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়ায় আমরা একটু নমনীয় হতে পারি। এতদিন প্রয়োজন হয়নি আমরা শিক্ষার্থীদের বইসহ প্রবেশের অনুমতি দেইনি। কিন্তু আজ যখন যোক্তিক দাবি উঠেছে নিয়ম পরিবর্তনের, তাকে স্বাগত জানানোই শ্রেয়। কেননা মনীষীর কথায়,‘Change is the end result of all true learning.’

তাছাড়া শেষ কথা হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য। সম্পদ তাদের, ব্যবহারও হোক তাদের পছন্দ মতো। তবে অবশ্যই ন্যায়-সঙ্গত এবং যোক্তিকভাবে- সেটুকু দেখার দায়িত্ব আমাদের। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জয় হোক! প্রাণের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাক মাথা উঁচু করে। সনৎ কুমার স্যার, হাসান আজিজুল হক স্যার কিংবা অরুণ কুমার বসাক স্যারদের এই ক্যাম্পাস বেঁচে থাকুক জ্ঞান গরিমা আর সৃষ্টিতে। জোহা স্যারের এই সবুজ মতিহার যুগ যুগান্তরে বেঁচে থাকুক সাহসে দায়িত্বে আর ভালোবাসার অহংকারে।

লেখক: ড.ফরিদ খান
সহযোগী অধ্যাপক,অর্থনীতি বিভাগ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.