রাজশাহী মহানগরীর গাঙপাড়ার বস্তি উচ্ছেদের আগে-পরে পাঁচজনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: খালে শহরের নোংরা পানির প্রবাহ। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এর পাশেই বসতি গড়েছিলেন প্রায় ২৩০টি পরিবার। সহায়-সম্বলহীন দিনমজুর শ্রেণির এসব মানুষের এই আশ্রয়টুকুও আর নেই। ঠিক এক মাস আগে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর তাদের উচ্ছেদ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এর পর থেকে এই শীতের ভেতর অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন রাজশাহী মহানগরীর গাঙপাড়া বসতির প্রায় দুই হাজার মানুষ।

তীব্র শীতের মধ্যে বসতবাড়ি হারিয়ে একমাসের মধ্যেই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চারজন। আর ঘর ভাঙা হবে, এমন কথাবার্তা যখন চলছিল তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরেকজন। এই পাঁচজনের মধ্যে গতকাল বুধবারই মারা গেছেন একজন। বসতিবাসীর ঘর ভেঙে দেয়ার পর কেউ কেউ পাশের কারও জমিতে কিংবা কারও বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। উদ্বাস্তু হয়ে কেউ কেউ নিয়েছেন বাড়ি ভাড়া। তবে এখনও অনেক মানুষ ভেঙে দেয়া বাড়ির ভিটায় টিনের অস্থায়ী একটা ঘর তুলে বসবাসের চেষ্টা করছেন। একটা ঘরেই গবাদিপশুর সঙ্গে থাকছেন তারা। বন্ধ হয়ে গেছে শিশুদের পড়াশোনা। নিদারুণ কষ্টে আছেন তারা।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় বসতির বাসিন্দা ফিরোজা বিবি’র (৪০) সাথে। ঘর-বাড়ি ভেঙে দেয়ার পর ওই ভিটাতেই টিন দিয়ে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়েছেন তিনি। সে ঘরেই বৃদ্ধা মা সুরাতন বিবিকে (৭৫) নিয়ে থাকেন। ফিরোজা জানালেন, স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। তারপর ভাঙড়ি কুড়িয়ে সংসার চালান তিনি। ঋণ নিয়ে ইট দিয়ে দুটি ঘরও করেছিলেন। কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধের আগেই তাকে ঘর হারাতে হয়েছে। এখন জমি কিনে কোথাও ঘর করার সামর্থ্য তার নেই।

বসতির বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন জানালেন, খালের দুই পাড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দরিদ্র শ্রেণির লোকেরা প্রায় ৪২ বছর আগে বসতি গড়েন। পরিবার প্রায় ২ শ ৩০টি। মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সবাই পড়েছেন চরম বিপাকে।

মোফাজ্জল বললেন, তার বাড়ির সাথেই তার দর্জির দোকান ছিল। দর্জির কাজ করে সংসার চালাতেন। বাড়ি ভেঙে দেয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন শ্বশুরবাড়ির বারান্দায়। কিন্তু দোকান আর করতে পারেন নি। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই এলাকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ শুরুর দিন স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বসতিতে যান। তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসতিতে বসে থাকেন। এই শীতের মধ্যে উচ্ছেদ না করার জন্য তিনি কিছু দিন সময় চান। তিনি যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ বাড়িঘর ভাঙা হয়নি। কিন্তু ফিরে আসার পরই চলতে থাকে ড্রেজার। মুহূর্তেই ভেঙে ফেলা হয় সবার ঘর।

বসতির বাসিন্দা পপেল জানালেন, তিনি রঙমিস্ত্রির কাজ করেন। বাড়ি ভেঙে দেয়ার পর বসতির বাসিন্দা বলে শহরের এ এলাকার কেউ বাড়ি ভাড়া দেয়নি। প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পবা উপজেলার বায়া এলাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছেন পপেল। চলে গেছেন পরিবারসহ। এতে বন্ধ হয়ে গেছে তার মাদ্রাসাপড়–য়া মেয়ে মিথিলা খাতুনের পড়াশোনা। মিথিলা গাঙপাড়া এলাকার একটা মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। এ রকম অনেক শিশুরই পড়াশোনা বন্ধ।

বসতি উচ্ছেদের পর রিকশাচালক তৌফিক আলী আশ্রয় নিয়েছেন পাশের এক আমবাগানে। সেখানে তৌফিকসহ পাঁচটি পরিবার রয়েছে। সবাই টিন দিয়ে অস্থায়ীভাবে দু-একটি ঘর করেছেন।

তৌফিক বলেন, একটা ঘরেই তিন মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে হচ্ছে। জমিওয়ালা এখান থেকেও চলে যাওয়ার জন্য এক মাস সময় দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে এখন যাব কোথায়!

বসতির বাসিন্দা আবদুস সোবহান একজন দিনমজুর। বাড়ি ভেঙে দেয়ার পর তিনিও পাশের এক ব্যক্তির জমিতে টিন দিয়ে একটা ঘর করেছেন। ঘরে ঢুকে দেখা যায় দুটি চৌকি। এক ঘরেই থাকেন সোবহানের ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রী। থাকে গরু এবং ছাগলও। তার ভেতরেই রান্না করছিলেন স্ত্রী শাহিদা বেগম। তিনি বলেন, এই শীতের ভেতর কী যে কষ্টে পড়েছি তা বলে বোঝানো যাবে না।

বসতির আরেক বাসিন্দা মতি বিবি’র বয়স এখন ৭০। ভেঙে দেয়া বাড়ির ওপরেই পলিথিন, চটের বস্তা, টিন আর খড় দিয়ে একটা ঘর করেছেন তিনি। মতি বিবি জানালেন, তার স্বামী নেই। একমাত্র ছেলে প্রতিবন্ধী। মাথা গোঁজার জন্য ঘরটা তিনি একাই করেছেন। প্রতিবন্ধী ছেলে এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ায়। বিকালে যখন তিনি বাদাম বিক্রি করতে যান তখন ঘর ফাঁকাই পড়ে থাকে। দরজা নেই।
এভাবে পুরো বসতির মানুষই ঘরবাড়ি হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। এলাকার লোকজন জানালেন, ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করে দেয়ার পর টেনশনে এবং শীতজনিত রোগে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই এক মাসে আবদুস সালাম, সুফিয়া বেগম, সায়েরা বেগম ও আবদুর রাজ্জাক নামে চারজন নারী-পুরুষ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর উচ্ছেদের কথাবার্তা যখন চলছিল তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান উম্মত আলী নামের আরেক ব্যক্তি।

এদের মধ্যে বৃদ্ধ আবদুর রাজ্জাক মারা যান বুধবার। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হলে সকালেই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বিকালে তিনি মারা যান। শীতে মারা যাওয়া সুফিয়া নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। মৃত সালামের স্ত্রী লতিফা বিবি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ঘর হারানোর পর স্বামীকেও হারালাম। এখন অন্যের বাড়ির রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছি। জীবনে এতো কঠিন সময় আসবে ভাবিনি।

রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, এই শীতের মধ্যে বসতি উচ্ছেদ না করার জন্য আমি অনুরোধ করেছিলাম। তার জন্য আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। এখন উচ্ছেদের ফলে শীতে ছোট একটা বসতির চারজন মানুষ মারা গেলেন। এর দায় কে নেবে? যারা উচ্ছেদ করেছেন আমি তাদের শাস্তি চাই। কারণ তাদের অমানবিক এবং দায়িত্বহীন কাজে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

বসতি রক্ষার জন্য সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা যখন সেখানে অবস্থান করছিলেন তখন মাসুদ রানা নামের সাম্যবাদী দলের বহিষ্কৃত এক নেতা তাকে ফোন করে এলাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আর তা না হলে ‘প্রাণ থাকবে না’ বলে হুমকি দেন। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে দুটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। এখন বসতির বাসিন্দারা নতুন করে ঘর করার একটু অনুমতি পেতে এখানে-ওখানে ছুটছেন। কিন্তু যারা দৌড়াদৌড়ি করছেন তাদেরও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের অভিযোগ, যারা দৌড়ঝাঁপ করছেন তাদের কাউকে কাউকে বিনাকারণে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মাদকসেবী হিসেবে পাঠাচ্ছে আদালতে।

এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন বসতির যুবক মনিরুল ইসলাম মনা। তিনি বলেন, ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়ার পর এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছি। এরই মধ্যে কয়েকদিন আগে সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমাকে বসতি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি নাকি মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামি করছিলাম! পুলিশ আমাকে কোর্টে পাঠালো। এমন দুর্দিনে টাকা-পয়সা খরচ করে কোর্ট থেকে জামিন নিতে হলো।
পাশ থেকে রিকশাচালক মনসুর আলী বললেন, ছেলেটা বিড়ি-সিগারেট পর্যন্ত খায় না। আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়ায় যে কী পরিমাণ দৌড়াদৌড়ি করছে তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। কাউন্সিলর এখন আমাদের খোঁজ নেয় না। এই ছেলেটা আমাদের জন্য কী করছে তা আমরাই জানি। আর এমন ভালো ছেলেকে পুলিশ বিনা কারণে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সবকিছুর বিচার একদিন আল্লাহই করবেন।

অভিযোগের বিষয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। সুনির্দিষ্টভাবে কেউ কোনো অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.