রাজশাহীতে ধানের সঠিক দাম না পাওয়ায় ধানের বিকল্প আবাদে ঝুঁকছে কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক: আমাদের দেশের কৃষকরা বেশ কয়েক বছর যাবত ধানের নায্য মূল্য পাচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক বিকল্প আবাদের দিকে ঝুঁকছে। যার প্রভাব এখন না পরলেও ভবিষতে যে ধানের আবাদ কমে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

রাজশাহীর পবা উপজেলার চকের মাঠ। বোরো মৌসুমে এ মাঠ জুড়ে দেখা মেলে বোরো ধানের আবাদ। তবে প্রতিবছর এসময় সেখানে ধানের আবাদ দেখা গেলেও এ বছরের চিত্রটি ঠিক এর উল্টো। বিস্তৃত এ মাঠের কোথাও ধানের আবাদের দেখা মেলেনি। পুরো মাঠ জুড়ে এবার বোরো ধানের জায়গা দখল করেছে গম। গম ছাড়াও কিছু জমিতে ভুট্টা, সরিষা আর কিছু বেগুনের আবাদ দেখা গেছে। মাঠের উঁচু কিছু জমিতে আলু ও পেঁয়াজের আবাদও করা হচ্ছে।

কৃষকরা বলছেন, ধান চাষ অলাভজনক হওয়ায় তারা ধানের পরিবর্তে বিকল্প আবাদ করছেন। বোরো মৌসুমে ধানের আবাদে খরচ বেশি কিন্তু ধানের দাম কম। অনেক সময় উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন না বলেও দাবি করছেন অনেকে। তাই ধানের পরিবর্তে গম, ভুট্টা ও সরিষার আবাদ করছেন তারা।

পবার হরিপুর ইউনিয়নের কৃষক কাসিমুদ্দীন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, আমরা প্রতিবছর বোরো মৌসুমে মূলত ধানের আবাদই করতাম। চকের মাঠে অন্যান্য বছরগুলোতে ধান ছাড়া অন্য আবাদ তেমন দেখা যেত না। কিন্তু এ বছর চকের মাঠে গমের আবাদই বেশি ধান নাই। এবার ধানি জমিতে এ মাঠে আমার চার বিঘামত গম আর দেড় বিঘা জমিতে ভুট্টা রোপন করেছি।

পবার আরেক কৃষক সুবহান ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, আমার নিজস্ব তেমন জমি নাই। অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করি। এই জমিতে একসময় আমরা ধান করতাম। ধান উৎপাদনে শ্রম বেশি দিতে হলেও ধানের যে দাম তাতে ধানের আবাদ করে উৎপাদন খরচ উঠানো সম্ভব হয়না। তাই এবছর আমি তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা আর এক বিঘা আট কাঠা জমিতে গমের আবাদ করেছি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতেও রাজশাহীতে বোরো ধানের আবাদ কমছে এবং শাকসবজি, ভুট্টা, গমসহ আলুর আবাদ বাড়ছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গত আট বছরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ সালে রাজশাহীতে বোরো ধানের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ১৫০ হেক্টর। যা ২০১৭-১৮ সালে ১২ হাজার ৮৭ হেক্টর কমে দাঁড়ায় ৬৯ হাজার ৬৩ হেক্টর। এতে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৫ মেট্রিক টন। যা ২০০৯-১০ সালে ধানের উৎপাদন ছিলো ৩ লাখ ২ হাজার ২২১ মেট্রিক টন।

তবে বেড়েছে শাকসবিজ, ভুট্টা ও আলুর আবাদ। ২০০৯-১০ সালে রাজশাহীতে শাকসবজির আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৪০৮ হেক্টর, ভুট্টার আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭৭৪ হেক্টর এবং আলুর আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ১৬০ হেক্টর। যা ২০১৭-১৮ সালে শাকসবজির আবাদি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮২৭ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ২৩৫ হেক্টর, ভুট্টার আবাদি জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৬৪৬ হেক্টর বেড়ে ১৫ হাজার ৪২০ হেক্টর এবং আলুর আবাদি জমির পরিমাণ ৫ হাজার ২০১ হেক্টর বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার ৩৬১ হেক্টর।

এবিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল হক বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, রাজশাহীতে বোরো ধানের আবাদি জমি কমেছে। তবে ভুট্টা, গম ও আলুর আবাদ বাড়ছে। কৃষকরা ধানের পরিবর্তে অন্য আবাদে যাচ্ছে। ধান আবাদে বেশি পানি লাগে- বিশেষ করে বোরো মৌসুমে। আর এটা খরাপ্রবণ এলাকা। এ জন্যে আমরা চাচ্ছি যে, ধানের পরিবর্তে কম পানি লাগে এমন আবাদ করা হোক। যেমন আমাদের শাকসবজি, গম, ভুট্টাতে ধানের চেয়ে অনেক কম পানি লাগে। এ জন্যে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি যেন তারা শাকসবজি, ভুট্টা আবাদ করে। কেননা এটাই লাভ বেশি। কৃষকেরাও এটার সুবিধা বুঝতে পারছে এবং লাভজনক হিসেবে এটাতে ঝুঁকছে।

এদিকে, অনেক কৃষক ধানের দাম কম এমন কারণেই অন্য আবাদে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল হক বলেন, কৃষক মনে করতে পারে তবে আমরা চাচ্ছি ধানের দাম থাকুক। ধানের দাম কম এমন কারণে কৃষকরা অন্য আবাদে ঝুঁকছে বিষয়টা এমন না। উত্তরাঞ্চলের জন্যে পানির বিষয়টাকে আমরা বড় করে দেখছি। আসলে আমরা পরিবেশকে রক্ষা করতে চাচ্ছি এবং সরকারও চাচ্ছে যে, আমাদের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকায় বোরো ধান আবাদ কৃষক কমিয়ে দিক। কারণ বোরো ধানে বেশি পানি লাগে। শুধু বোরো ধানেই না আসলে ধান আবাদেই পানি বেশি লাগে। তাই সরকার চাইছে পানি কম লাগে অর্থাৎ পানিসাশ্রয়ী ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করতে। তারই অংশ হিসেবে আমাদের মাঠেও বোরো ধানের আবাদ কমে যাচ্ছে। আমাদেরকে পানি সাশ্রয়ী ফসলগুলোর আবাদ বাড়াতে হবে। কেননা এখনো আমাদের ভুট্টা আমদানি করতে হয়। কিন্তু ধান আমাদের উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.