রাজশাহীতে গাছে গাছে ঝুলছে আমের গুটি, করোনার কারণে উৎকণ্ঠায় আম চাষীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে বাড়ছে করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে সাধারণ ছুটি, চলছে লোকডাউন। এরমধ্যে দিয়ে প্রকৃতির নিয়মে গাছে গাছে বড় হচ্ছে গুটি আমের আকৃতি। সেইসাথে অন্য মৌসুমের চেয়ে আশানুরূপ মুকুল না আসা ও কালবৈশাখী ঝড়ের আশঙ্কা।
এসব নিয়ে সামনে আমের বাজারজাতকরণ নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমচাষিরা। কারণ প্রত্যেক মৌসুমেই এই ফলের উপর নির্ভর করে দুই জেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
রাজশাহী কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় আম চাষ হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭৪ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন। এরমধ্যে বাঘা উপজেলায় ৮ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এ বছর বাগানে আম কম থাকায় উৎপাদন ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ৬ থেকে ৭ মেট্রিক টন। গত বছর রাজশাহী জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় আম চাষের জমির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর। গত বছর ছিল ৩১ হাজার ৮২০ হেক্টর এবং গাছের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩০।
আমচাষিদের ভাষ্য অনুযায়ী, আমের গাছগুলোতে এখন গুটি এসেছে। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে যেটুকু ফলনের আশা করেছিলেন চাষিরা তাতেও পড়ছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব। জেলায় লকডাউনের কারণে কৃষি উপকরণ, কীটনাশক ও শ্রমিক সংকট এরই মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে আমের যতœ নিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
এছাড়াও লকডাউন চললেও কৃষি উপকরণ সরবরাহ চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। কিন্তু অন্য দোকানের পাশাপাশি সার-কীটনাশকের দোকানও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে দেন-দরবার করে কীটনাশক ও সার মিললেও তা অপ্রতুল। এছাড়া লকডাউন থাকায় রাজশাহীতে মিলছে না শ্রমিক।
রাজশাহীর পবা উপজেলার কর্ণহার গ্রামের একজন আমচাষি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ব্যাপক হারে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। একটু বড় হয়ে ওঠা গুটিতে ছত্রাক লেগে খসে পড়ছে, গাছে পোকাও খুব। তাই বাজারে কীটনাশক পাচ্ছি না। কীটনাশকের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। পরিচিত দোকানিকে অনুরোধ করে অল্প কিছু কীটনাশক কিনেছি। আমারবাগানের তুলনায় তা অনেক কম। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার জামিরা গ্রামের একজন আম চাষী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, গাছ থেকে ব্যাপক হারে গুটি ঝরে যাচ্ছে। বাগানে সেচ দিচ্ছি, সারও দিয়েছি। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে এখন বাগানে স্প্রে করার জন্য শ্রমিক মিলছে না। অথচ বর্তমানে অন্তত ১৫ জন শ্রমিক প্রয়োজন ছিল। তাই নিজে এবং ভাইদের নিয়ে বাগানের পরিচর্যার কাজ যতটুকু পারছি, করছি। কিছু করার নেই।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ড. আলীম উদ্দিন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার সময় পরিচর্যা বেশি প্রয়োজন। এখন গুটি ও পাতায় স্প্রে এবং গোড়ায় সার, পানি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, সার-কীটনাশকসহ সব কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত রাখার কথা। চাষিরা আমাদের ফোন করে এসবের অপ্রতুলতার বিষয়ে অভিযোগ করছেন। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানানোর জন্য আমরা চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছি।
রাজশাহী কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক উম্মে সালমা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যদি কেউ সার-কীটনাশক না পেয়ে থাকেন, তবে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা বা জেলা অফিসেও মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করবো।
বাঘা উপজেলার আমোদপুর গ্রামের আমচাষি আকবর আলী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, করোনা ভাইরাস শুরু হওয়ার আগে আমার ৬ বিঘা জমির উপর আমবাগানের দাম বলেছিল এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে এই বাগান এক লাখ টাকাতে নিতে চাচ্ছে না। ফলে এ মৌসুমে আম নিয়ে কী হবে ভেবে পাচ্ছিনা। আম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
আড়ানীর আমচাষি বাদশা আহম্মেদ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, গত দুই বছর কিছু অসাধু ব্যাবসায়ীর কারণে সরকারিভাবে সময় বেঁধে আমপাড়া শুরু হয় এবং বাজারমূল্য ভাল না পাওয়ায় আমের সাথে সম্পৃক্তরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি মৌসুমে আমের উৎপাদন তুলনামূলক কম হয়েছে। ফলে বাজারমূল্য ভাল হওয়ার কথা। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সে আশা ভেস্তে যেতে বসেছে।
বাঘা উপজেলার মনিগ্রামের আম চাষি জিল্লুর রহমান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, শতাধিক বিঘার আমবাগান লিজ নিয়ে চাষ করেছি। গাছে যথেষ্ট আম আছে। মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আমপাড়া শুরু হওয়ার আগে এই মহামারি স্বাভাবিক না হলে অনেক ব্যবসায়ী ও চাাষির পথে বসতে হবে। আবার সামনে যে কোনো সময়ে কালবৈশাখী ঝড়ের ভয় আছে।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, এক বছর গাছে ভাল আম হলে অন্য বছর কম হয়। পরপর দুই বছর প্রচুর পরিমাণ আম উৎপাদন হয়েছে। সেই তুলনায় এ বছর গাছে আম কম রয়েছে। মহামারি করোনা ভাইরাস কেটে গেলে আশা করছি চাষিরা ভাল দাম পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.