রংপুর সুগার মিলস্ লিমিটেড লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে আজ উৎপাদনে যাচ্ছে

গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি: উত্তরাঞ্চল তথা রংপুর বিভাগের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান রংপুর সুগার মিলস্  লি:। আধুনিকায়ন, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও গবেষণাগার তৈরী না করায় ধুঁকে ধুঁকে ধ্বংসের পথে এই ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। মিলটির প্রয়োজনীয় সংস্কার, আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন করে কার্যক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি আখের জাত ও  চাষে উন্নত গবেষণাগার স্থাপন করা এবং মিল ও খামারে অভ্যন্তরীণ সকল দুর্নীতিবাজদের  দুর্নীতি বন্ধের আহবান জানিয়েছেন গাইবান্ধা জেলাবাসী।
চলতি ২০১৮-১৯ আখ মাড়াই মৌসুমে মিলটি উৎপাদনে যাচ্ছে আজ মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর)। আগামী দুই মাসে প্রায় ৫৭ দিনে ৭২ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ে চালু রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে বন্যার কারণে আখের জমি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় লক্ষমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর হতে মিলটি ৬১টি মৌসূমে মধ্যে ২০০৪ হতে ২০০৭ পর্যন্ত ৩টি মৌসুমে বন্ধ থাকলেও ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের পর আর কখনো লাভের মুখ দেখেনি। লাভের দিক থেকে মিলটির স্বর্ণ যুগ ধরা হয় আশির দশক। শুরু থেকে ১৯৫৯-৬০, ১৯৬০-৬১, ১৯৬১-৬২, ১৯৬২-৬৩, ১৯৬৫-৬৬, ১৯৭০-৭১, ১৯৭৩-৭৪, ১৯৭৪-৭৫, ১৯৭৫-৭৬, ১৯৭৬-৭৭, ১৯৮০-৮১, ১৯৮১-৮২, ১৯৮৩-৮৪ এবং ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে মিলটি লাভের মুখ দেখে।
এরমধ্যে ১৯৮০-৮১ মৌসুমে প্রায় ৩ কোটি এবং ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লাভ করে। গত মৌসুমে মিলটিতে লসের পরিমাণ প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। মিলটিতে বর্তমানে অবিক্রিত চিনির পরিমাণ ৩ হাজার মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্ট ডিলার ও স্থানীয়রা সরকারি রেটে মিল হতে চিনি না কেনায় বিপুল পরিমাণ চিনি মিল গোডাউনে রয়েছে।
গত মৌসুমে কৃষকদের কোনো বকেয়া নেই। এছাড়া চলতি বছরে মিলটি মাঠ পর্যায়ে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে। বর্তমানে মিলটিতে শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তার সংখ্যা ৭৮৪ জন। ১৪ ডিসেম্বর মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম আমাদের এ প্রতিনিধিকে তার কার্যালয়ে এসব তথ্য জানান।
রংপুর সুগার মিলের নিজস্ব কৃষি খামারের মোট জমির পরিমাণ ১৮শ ৩২ দশমিক ২৭ একর। এর মধ্যে চাষাবাদ যোগ্য জমি রয়েছে ১৫শ ২ একর। ২০১৭-১৮ রোপন মৌসুমে আখ রোপনকৃত জমির পরিমাণ ১ হাজার ১৩ একর। ২০১৮-১৯ রোপন মৌসুমে আখ রোপনকৃত লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার একর।
আবাদি জমির পাশাপাশি খামারে মোট পুকুরের সংখ্যা ২৬টি। এর মধ্যে মাছের চাষ হচ্ছে ১৬টিতে; পানি নেই ৭টিতে আর    পুন:খনন যোগ্য পুকুরের সংখ্যা ৩টি। খামারে সেচ সুবিধার জন্য জি.জি এর আরডিএ বগুড়া মাধ্যমে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের ১৫টি গভীর নলকূপের মধ্যে ৫টি স্থাপন করা হয়েছে।
মিল কর্তৃপক্ষ পুকুর ও আবাদী পতিত জমিতে শস্য ও শস্যবহুমুখীকরণ কার্যক্রম চালু রেখেছে। যেখানে ১০ হাজার লেবু চারা; ৫শ ৫০টি আম; ১ হাজার ৫০টি নারিকেল; ১২০টি লিচু; ৫শ পেঁপেসহ লাউ চারা; মিষ্টি কুমড়া; সীম এবং সাথী ফসল হিসেবে সরিষা বপন করা হয় প্রায় ১০ একর জমিতে।
মিলটিতে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি চিটাগুড়, প্রেসমাড ও ব্যাগাছ জাতীয় বাই প্রোডাক্ট উৎপন্ন হয়। যেখান থেকে মিলটি প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করে। বিগত ১০ বছরের চিত্রে দেখা যায় ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মিলটিতে চিটাগুড় উৎপন্ন হয়েছে ১৬৯৬১.১০ মেট্রিক টন; প্রেসমাড ১৩০৩৩.০০ মেট্রিক টন ও ব্যাগাছ ১৫৩৭৫১.৯২ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৬৭৫৮.৮৭ মে: ট. চিটাগুড় গড়ে ১০ হাজার ২২১ টাকা দরে বিক্রি করে ১৭ কোটি ১২লক্ষ ৯৯ হাজার ৩২টাকা আয় করেছে মিলটি।
কিন্তু প্রেসমাড গত বছরের প্রায় ৩শ মেট্রিক টন এখনও বিক্রি করা হয়নি। তবে খামারে কিছু কিছু ব্যবহার করা হচ্ছে। উৎপন্ন ব্যাগাছ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
চিনিকলটিতে ২০০৮ সাল হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে রাজস্ব জমা হয়েছে প্রায় বিভিন্ন বিল হতে কর্তনকৃত ভ্যাট ২ কোটি ৯৩ লক্ষ ১৮ হাজার ৫৯৫ টাকা; বিভিন্ন বিল হতে কর্তনকৃত আয়কর ১ কোটি ৩১ লক্ষ ১২ হাজার ২৬৩ টাকা; মোলাসেস বিক্রিয় হতে ভ্যাট কর্তন ৩ কোটি ২৭ লক্ষ ১৭ হাজার ১৭৬ টাকা; মোলাসেস বিক্রয় হতে আয়কর কর্তন ৮৫ লক্ষ ৪৩ হাজার ১৮৬টাকা; পল্লি সড়ক নির্মাণ মুঞ্জরী হতে ভ্যাট কর্তন ৪৪ লক্ষ ২ হাজার ১৭২ টাকা; পল্লি সড়ক নির্মাণ মুঞ্জরী হতে আয়কর কর্তন ১৮ লক্ষ ৩ হাজার ৫৯৭টাকা। যা সর্বমোট আয়ের আকার দাঁড়ায় ৮ কোটি ৪৩ লক্ষ ১৬ হাজার ৯৮৯ টাকা।
রংপুর চিনিকলে আখ সংগ্রহের জন্য ৫২টি আখক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। ইতিমধ্যে সবগুলো কেন্দ্রেই ডিজিটাল ওজন যন্ত্র বসানো হয়েছে। চলতি মৌসুমে শুধুমাত্র বালুয়া, গজারিয়া, গোপিনাথপুর ও বামনডাঙ্গা হতে প্রাইভেট পরিবহনের মাধ্যমে আখ পরিবহনের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবশিষ্ট কেন্দ্র হতে প্রতিষ্ঠানের ট্রাক/ট্রাক্টর/ট্রলী দিয়ে আখ পরিবহন করা হবে।
অপরদিকে, মিলটির আভ্যন্তরীণ কিছু দুর্নীতির খবর প্রায়ই শোনা যায়। মাঠ পর্যায়ে সিডিএ গণ চাষীদের তেমন কোন যোগাযোগ রাখেন না। ঋণ প্রদানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম করা হয় বলে অনেক চাষিই অভিযোগ তোলেন। আখ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণার্থে প্রকৃত রোপণের চেয়ে বেশি রিপোর্ট প্রদান করা হয় বিধায় যা মাড়াই মৌসুমে মিলটিতে প্রভাব ফেলে। রোপা আখ চাষে ভুর্তকী ক্ষেত্রেও সিডিএদের অনিয়মের অভিযোগ তোলেন কৃষকরা।
মিলের নিজস্ব ওয়ার্কশপে ও মিল অভ্যন্তরের বিভিন্ন মালামাল ক্রয়েও অনিয়ম হয় বলে অনেকেই অভিযোগ তোলেন। মাড়াই মৌসুমে পরিবহন চালকরা জ্বালানি বিক্রিসহ বেশ কিছু অনিয়ম করে থাকে যা রোধ করা জরুরি।
অপরদিকে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারেও ব্যাপক অনিয়মে পরিচালিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এখানে আখের চেয়ে ঘাস দৈর্ঘে বড় হয়। বরাদ্দকৃত সার-কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণাদির সঠিক ব্যবহার হয় না; বিধায় আখের ফলন আশানুরুপ পাওয়া যায় না। তিন বছর বন্ধ থাকার পর মিলটি চালুর ২০০৭-২০০৮ মাড়াই মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক আখ মিলে সরবরাহ হলেও তার পর থেকে প্রতিবারই নানা অনিয়মের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
এদিকে মিল গেটের অনেক চাষি অভিযোগ করেছেন বর্তমান আখ চাষী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকেরা আখ চাষ না করেও বার বার একই পদে বহাল থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে।
মিলটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এমডি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ৭ মে ২০১৯ যোগদান করার পর থেকে সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধে আমাদের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত টিমের তদারকিতে তা করা সম্ভব নয়।  ভুর্তকি ও কৃষি ঋণে অনিয়মের কোনো অভিযোগ আসলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। বর্তমানে মিলটিতে ই-পুর্জি ও মোবাইলের মাধ্যমে আখের মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা থাকায় অনিয়ম অসম্ভব।
মিলটিতে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন রয়েছে ১টি। এর নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ১২জন। বর্তমানে সভাপতি পদে আবু সুফিয়ান সুজা ও সাধারণ সম্পাদক পদে মোস্তাফিজুর রহমান দুলাল বিজয়ী হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমানে অত্র চিনিকলটি আধুনিকায়নের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সরকার যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে; সেক্ষেত্রে এই চিনিকলটিতে আজও স্থাপন করা হয়নি কোনো গবেষণাগার। চিনিকলটিকে আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ যেমন জরুরি তেমনি আধুনিক গবেষণাগার তৈরি করে আখ চাষসহ চিনি উৎপাদনে সাফল্য আনতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করছে গাইবান্ধা জেলাবাসী।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর গাইবান্ধা প্রতিনিধি মোঃ শাহরিয়ার কবির আকন্দ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.