মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও টিনের ছাদে লাফিয়ে পড়ি!

লালমনিরহাট প্রতিনিধি: মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আহত সুমনকে নিয়ে পুরাতন টিনের ছাউনি বেয়ে বেড়িয়ে এসেছি। জনবিস্ফরন যাকে খুঁজছে তাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসাটা সহজ ছিল না। মৃত্যু মেনে নিয়ে টিনের ছাদে লাফিয়ে পড়ি। সেদিনের স্মৃতিতে আজও বুকটা কেঁপে উঠে।
লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয়দের চালানো তান্ডলিলার লোকহর্ষক বর্ননা দিয়ে গিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পাটগ্রাম থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) সুমন কুমার মহন্ত।
গত ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় গুজব ছড়িয়ে চালালো তান্ডবলিলার বর্ননায় ওসি সুমন কুমার মহন্ত বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, পবিত্র কোরআন অবমাননা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে স্থানীয়রা দুই ব্যাক্তিকে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে আটক রেখেছে। এমন একটি খবরে বুড়িমারী স্থলবন্দর পুলিশ ফাঁড়িকে তাৎক্ষনিক পাঠানো হয়।
এরপর থানার অফিসাররা মোটর সাইকেলে চেপে ঘটনাস্থলে যান। থানার দুইটি গাড়ির একটি সংসদ সদস্যের প্রোটোকলে এবং দুর্বল গাড়িটিও শহর টহলে রয়েছে। ফলে এক এসআইয়ের মোটর সাইকেলে চেপে আমিও বুড়িমারী ইউপি ভবনে চলে যাই। ততক্ষণে ইউপি মাঠে সহস্রাধিক জনতার ভিড়।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যান এবং ইউএনও। তাদেরকে পেয়ে অনেকটাই ভরসা পাই।
ওসি সুমন কুমার মহন্ত বলেন, প্রথমে আমরা সবাই (ইউএনও, চেয়ারম্যান) মাইকে জনতাকে শান্ত করতে অনেক চেষ্টা করেছি। ফাঁকাগুলির অনুমতি চেয়েছি। দেরিতে হলেও সেই অনুমতি পেয়েছি আমরা কিন্তু গুলি করার উপায় ছিল না। ততক্ষণে আমরা সবাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। উপরে ছাদ, জানালায় হাজারো জনতা। গুলি করলে জনতার বুকে লাগে। এক পর্যয়ে চাপ বেড়ে গেলে দুইজন ফোর্সসহ আটক দুই ব্যাক্তির রুমে চলে যাই। এরই মাঝে পুলিশ অফিসারদের নিরাপত্তায় ইউএনওসহ চেয়ারম্যানদ্বয় পাশে একটি ব্যাংকে আত্নরক্ষা করেন।
সময় যতই যাচ্ছে জনতার চাপ বেড়েই চলেছে। একপর্যয়ে জনতা গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে আমাদের রুমে দরজায় ধাক্কা দেয়। এসময় ফোর্সরাসহ ভিতর থেকে দরজা চেপে ধরি। শত পাথরের ঢিল হেলমেটে পড়ে। পাথরের ঢিলে হাতে  রক্ত ঝড়ছিল। তখন অসুস্থতা বোধ করায় জুয়েল মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। পাশে কর্নারে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বন্ধু সুলতান রুবায়াত সুমন। এক সময় সেই দরজা ভেঙে লোকজন লাঠি সোটা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মেঝেতে পড়ে থাকা জুয়েলকে গণপিটুনী দেয়। রক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। লোকজন রুমে প্রবেশ করা মাত্রই ফোর্স ছাড়া আমি একা হয়ে পড়ি। সুলতান রুবায়াত সুমনকে মারতে গেলে পুলিশ সদস্যের পরিচয় দিয়ে সুলতানকে ছাদে নিয়ে যাই যোগ করেন ওসি।
ওসি বলেন, উদ্ধার করা জুয়েলের সঙ্গী সুলতানের খোঁজে ইউপি ভবনের ছাদেও যাওয়ার চেষ্টা করে জনতা। এ সময় উদ্ধার হওয়া সুলতানকে ফোনে কথা বলে দেই ডিআইজি স্যারের। তখন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ভবনের ছাদ বেয়ে পাশের টিনের ছাউনীতে লাফিয়ে পড়ি। একটি বাড়িতে গিয়ে পানি খেয়ে আহত সুলতান রুবায়াত সুমনকে গুপ্তরাস্তা দিয়ে এক এসআইকে ফোনে ডেকে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে পাটগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠাই।
স্থানীয়রা খবর পেয়ে পাটগ্রাম হাসপাতালেও ভির জমায়। তখন সরকারী বা বেসরকারী অ্যম্বুলেন্স খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তাকে পাটগ্রাম হাসপাতালে রাখাও নিরাপদ ছিল না। বাধ্য হয়ে থানার দুর্বল গাড়িতে সুলতান রুবায়াত সুমনকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। জিবিত থাকবো কখনই ভাবি নাই। মৃত্যু নিশ্চিত দেখছিলাম। ছাদে থাকলেও তারা আমাকেসহ রুবায়াতকে মেরে ফেলবে। তাই মৃত্যু হলেও উদ্ধাকৃত রুবায়াত সুমনকে নিয়ে ভবনের ছাদ থেকে পাশের টিনের ছাউনীতে লাফিয়ে পড়ি। সেই দিনের স্মৃতিতে আজও বুক কেঁপে উঠে। চাকুরী নয়, নিজের ও সুলতান রুবায়াত সুমনের জীবন বাঁচাতে পারাটাও কম সাফল্য ছিল না যোগ করেন ওসি সুমন কুমার মহন্ত।
২৯ অক্টোবর বিকেলে বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদের কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে রংপুরের শালবন মিস্ত্রী পাড়ার শহিদুন্নবী জুয়েলকে। প্রাণে বেঁচে যান তার সঙ্গী একই এলাকার সুলতান রুবায়াত সুমন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ ১৭ রাউন্ড রাবার বুলেটের ফাঁকাগুলি ছুড়ি। জনতা ইউনিয়ন পরিষদে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ইউপি ভবন থেকে নিহত জুয়েলের মরদেহ টেনে হেচড়ে প্রায় ৫শতগজ দুরে লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়কে আগুনে পুড়ে ছাই করে।
এ সময় নারায়ে তাগবির ধনি দিয়ে দফায় দফায় মিছিল করে উৎসুক জনতা।এ ঘটনায় ১১৪জনের নামসহ অজ্ঞত শত শত মানুষের বিরুদ্ধে হত্যাসহ তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। তিন মামলায় মসজিদের খাদেমসহ ২৩জনকে গ্রেফতার করে ৯জনকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। তবে গ্রেফতারকৃত আসামীরা সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর লালমনিরহাট প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান হাসান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.