নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীতে উৎপাদন মৌসুমের তুলনায় হিমাগার পর্যায়ে সব ধরনের আলুর পাইকারি দাম দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়েছে। যেমন চলতি উৎপাদন মৌসুমে প্রতি কেজি অ্যাসটরিক-গ্র্যানুলা (সাদা) ও কার্ডিনাল (লাল) জাতের আলু ১০ থেকে ১৩ টাকা এবং দেশিজাতের ছোট বা পাকড়ি জাতের আলু প্রতি কেজি ১৮ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
অথচ মঙ্গলবার (১১ জুলাই) হিমাগারে প্রতি কেজি অ্যাসটরিক, গ্র্যানুলা ও ডায়মন্ড জাতের আলু বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ টাকায়। আর দেশি পাকড়ি আলুর কেজিপ্রতি দাম উঠেছে ৪০ টাকা। সেসব আলু আবার পাইকারদের কাছ থেকে হাতবদলের পর খুচরা পর্যায়ে এসে আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজশাহী শহরের বিভিন্ন বাজারে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) প্রতি কেজি দেশি ছোট বা পাকড়ি আলু ৪৫ টাকা ও কার্ডিনাল বা লাল আলু ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় গত উৎপাদন মৌসুমে ৩৬ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। আলু উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ মেট্রিক টন।
এদিকে সংরক্ষণে জটিলতা ও খরচের কারণে উৎপাদক পর্যায়ে অর্থাৎ কৃষকেরা ভরা মৌসুমে অনেকটা কম দামে আলু বিক্রি করে দেন।
সেই আলুর মধ্যে এই জেলার ৩৬টি হিমাগারে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন সংরক্ষণ করেছেন ব্যবসায়ী ও মজুতদাররা। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল ৩৬টি হিমাগারে ৩ লাখ ১২ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন।
রাজশাহী জেলায় থাকা হিমাগারগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার রেকর্ড পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। তা সত্তে¡ও প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ছে আলুর দাম। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন জাতভেদে প্রতি বস্তা আলুতে (৬০ কেজি) ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা হচ্ছে ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের। তাই সংরক্ষণ মৌসুম শুরু হতে না হতেই হিমাগার থেকে আলু বিক্রির হিড়িক পড়ে গেছে।
স্থানীয় আলু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের পর বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত আলুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এছাড়াও উৎপাদনও কম হয়েছে।
তবে হিমাগার মালিকরা জানান, এই জেলার ৩৬টি হিমাগারে গত বছরের তুলনায় আলুর মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্তে¡ও আগের বছরগুলোয় এই সময়ে কোনো আলু বিক্রি হয়নি। কিন্তু এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আলু ইতোমধ্যে হিমাগার থেকে বের হয়েছে।
অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলছেন, আলুতে কেজিপ্রতি খরচ হয়েছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। কিন্তু আমাদের তা বিক্রি করতে হয়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা করে। এছাড়াও যারা হিমাগারে রেখেছেন, তাদের উৎপাদন ও হিমাগার ভাড়াসহ সংরক্ষণে ব্যয় হয়েছে কেজিপ্রতি ১৭ থেকে ১৮ টাকা। তাই তাদের লাভ হয়নি। অথচ তাদের কৃষিপণ্য কেবল হাত বদল করেই মুনাফা লুটছেন মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা।
যদিও বিভিন্ন বাজারে ক্রেতারা বলছেন, হিমাগারের আলু বাজারে আসা শুরু হয়নি। যখন আসা শুরু হবে, তখন দাম আরও বাড়বে। কারণ তখন হিমাগারগুলোই আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। সবজিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আলু বাজার ক্রেতার জন্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য মনিটরিং প্রয়োজন।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রাজশাহীর পবা উপজেলার উত্তরা কোল্ডস্টোরেজ, রাজ হিমাগার, রহমান কোল্ডস্টোরেজ ও আমান কোল্ডস্টোরেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিমাগারে রাখা প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) অ্যাসটরিক বা সাদা জাতের আলু ১ হাজার ৮০০ টাকা, দেশি ছোট বা পাকড়ি আলু ২ হাজার ৪৯০ টাকা এবং ডায়মন্ড (কার্ডিনাল) জাতের আলু ১ হাজার ৯২০ টাকা দামে এখন বিক্রি করা হচ্ছে।
রাজশাহীর বোয়ালিয়ার মিলন কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক দুলাল সরকার বিটিসি নিউজকে জানান, তাঁদের হিমাগারে এবার ১২ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। গত বছর সংরক্ষণ করা হয়েছিল ৬ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন আলু। অন্যান্য বছর এই সময়ে আলু হিমাগার থেকে বের হতো না। কিন্তু বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার হিমাগার থেকে আলু বিক্রির হিড়িক পড়েছে।
এছাড়া হঠাৎ বাজারে আলুর দাম হু হু করে কেন বাড়ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বলেন, উৎপাদন মৌসুমে খুচরা বাজারে কেজি প্রতি আলু ১০-১৪ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে হঠাৎ করে আলুর দাম বেড়েছে কেজিতে ৩২-৩৪ টাকা। আলুর দাম বাড়ার পেছনে ২টি কারণ আছে। প্রথমতঃ এই বছর আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। তাই কৃষক বাসায় যে পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করে রেখেছিল, তা শেষ পর্যায়ে। দ্বিতীয়ত, হিমাগার থেকে আলু বের হচ্ছে না। ফলে বাজারে আলুর সরবরাহ কমে গেছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৭ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে আবাদ হয়েছে ৩৬ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে। এ বছর জেলায় প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে জেলার ৩৬টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন আলু।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মোজদার হোসেন বিটিসি নিউজকে বলেন, হিমাগারে মজুদ করা আলুর ২০ শতাংশ কৃষকের। আর বাকি ৮০ শতাংশ আলু ব্যবসায়ীদের। হিমাগারে ১৭ টাকা কেজিপ্রতি আলু বিক্রি করলেও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। ব্যবসায়ীরা এখানে বেশি লাভের আশায় আলু হিমাগার থেকে বের করছে না।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধিমো.মাসুদ রানা রাব্বানী / রাজশাহী। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.