বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র

লালমনিরহাট প্রতিনিধি: বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। বিলুপ্ত ছিটমহলে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে। পেয়েছে নাগরিক অধিকার ও আইনী সুরক্ষা। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে।
বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে জেলা সদরের কুলাঘাট ইউনিয়নের ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছালেহা সরকার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ১৫২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়টিতে সাড়ে ৮ বছর নিজস্ব অর্থায়নে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লালমনিরহাট-৩ আসনের নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য মতিয়ার রহমান।
এই বিদ্যালয়টি সরকারি করার দাবি জানিয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে দাবি উঠেছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার। দাবি উঠেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের ভূমির রেকর্ড সংক্রান্ত সকল জটিলতা নিরসন করার। যাতে বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির মালিকরা জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে।
২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ভেতরে থাকা ছিটমহলগুলো বিনিময়ের ফলে ৬৮ বছরের পরাধীনতার শিকল ভেঙে মুক্ত হয়ে যায়। মানুষ পেয়েছে স্বাধীনতা। পেয়েছে দেশের নাগরিকত্ব। পেয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরা এখন দেশের মূল ভূখন্ডের নাগরিকদের মতো সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। মিশে গেছে দেশের মূল স্রোতধারায়।
লালমনিরহাট জেলা সদরের ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই ও বোয়ালমারী বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহল দুইটিতে বিগত সাড়ে ৮ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে বিলুপ্ত ছিটমহল বোয়ালমারী বাঁশপচাঁইয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন। এখানেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বোয়ালমারী বাঁশপচাই আদর্শ একাডেমি। বিদ্যালয়টিতে ৩০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত করার দাবি তুলেছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা।
ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই ছিটমহলটিতে বিগত সাড়ে ৮ বছরে শহীদমিনার, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তা পাকা হয়েছে এলজিইডির অধীনে প্রায় ৯ কিলোমিটার। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ একশত ওয়াটের সোলার প্যানেল সরকারিভাবে দেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে ল্যাট্রিন, টিউবয়েল, ভিজিডি কার্ড, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড দেয়া হয়েছে। কৃষকদের সহায়তা করতেও স্বল্পমূল্যে সেচ সুবিধা দিতে একটি সৌরবিদ্যুত চালিত সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মো. হারুন অর রশিদ জানান, বিলুপ্ত ছিটমহল মুক্ত হওয়ার সাড়ে ৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষদের জমির রেকর্ড সংশোধন করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এ সমস্যা দ্রুত সমাধান করা দরকার।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব সীমান্ত চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের ভিতরে থাকা ১৬২ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি এবং নীলফামারী জেলায় ৪টি।
এদিকে জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করে বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তারা জানান, আমরা আগের বন্দী দশা থেকে মুক্ত হয়েছি। বাবা-মা না থাকলে যেমন সন্তানকে দেখার কেউ থাকেনা এমন অবস্থা থেকে আমরা এখন বঙ্গবন্ধুর দেশ সোনার দেশ হামার দেশ বাংলাদেশ পেয়েছি- এভাবেই বলছিলেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার কুচলিবাড়ী ইউনিয়নের বিলুপ্ত ছিটমহল বড়খেঙ্গি এলাকার বর্তমান মুজিব-ইন্দিরানগরের বাসিন্দারা।
একই এলাকার কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ ও মহিলার সাথে কথা হলে বলেন, অনেকদিন ছিটমহলের লোক হওয়ায় (বিধবা) ভাতা বা কোনো সাহায্য পাইনি। খুব কষ্টে হামা জীবন যাপন করিছিন হামারা এলা বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা পাই। হামা এখন সুখে আছি।
বুড়িমারী ইউনিয়নের ১৫ নং খরখরিয়ার বিলুপ্ত ছিট মহলের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আগে ভোট দিতে পাইনি এখন আনন্দ উল্লোসের মাধ্যমে ভোট দিতে পারি। আমরা সরকারের সকল সুবিধা পাই।
পাটগ্রাম উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মনজুর মোর্শেদ বলেন, শতভাগ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রতিবন্ধী ভাতা এবং শিক্ষা উপবৃত্তিও বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা পাচ্ছে।
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুল ইসলাম বিটিসি নিউজকে বলেন, এখন আলাদা নেই সকলেই সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের বাসিন্দা। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সকলের জীবন মানের উন্নতি হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সরকার যৌথ ঘোষণার মধ্যদিয়ে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ছিটমহলের নামে স্ব স্ব দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা ভূ-খন্ডগুলো দেশের মূল ভূ-খন্ডের সাথে মিলে যায়। এতে ওইদিন থেকে ব্রিটিশদের করে রাখা ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে।
বিলুপ্ত ছিটমহল সমূহে মাত্র ৮ বছর ৬ মাসে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে সরকার। প্রতিবছর উন্নয়নে বরাদ্দ থাকছেই। প্রত্যেকটি বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোতে পাকা সড়ক, কিছু কিছু ছিটমহলে জনবসতি অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল, কমিউনিটি সেন্টার, সোলার প্রদান করা হয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা নারী, প্রতিবন্ধীদের জন্য করে দেওয়া হয়েছে ভাতার কার্ড।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ্ বিটিসি নিউজকে জানান, লালমনিরহাট সদরে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলের স্কুলগুলো জাতীয়করণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি বিলুপ্ত ছিটমহলে থাকা সাধারণ মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন কারারও পরিকল্পনা রয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর লালমনিরহাট প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান হাসান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.