ফেনীর ভেজাল ঘি যাচ্ছে সারাদেশে

ফেনী প্রতিনিধি: ফেনীতে বিষাক্ত ক্যামিকেল দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের ঘি। এসব নকল ঘি বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ভেজাল ঘি খেয়ে ভোক্তারা দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরতলীর লালপোলে গ্রামীণ ব্যাংক সংলগ্ন স্থানে গড়ে উঠেছে নকল ঘি শাহী, ভিআইপি, অভি স্পেশাল গাওয়া ঘি কারখানা।

বিশাল এ কারখানায় দরজা বন্ধ রেখে তৈরি হওয়া মুখরোচক এসব ঘি। নামীদামী ব্র্যান্ড নকল করা ঘি তে সাবানের ফেনা, জুতার গাম, বিভিন্ন রং ফ্লেভার ও পামওয়েল এবং কেমিকেল দিয়ে তৈরি হয়।

কারখানায় কাজ করেন মধুয়াই এলাকার মোফাজল হকের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও ফরহাদ। তারা বাজারজাত করার জন্য টিনের কৌটা তৈরী করা থাকে। ৯শ গ্রাম ওজনের কৌটাগুলো কাটন ভর্তি করে পিকআপে করে ফেনী শহর ও উপজেলার বিভিন্ন বাজার বিক্রি করা হয়।

পাশ্ববর্তী চৌদ্দগ্রাম, বসুরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগে বাজারজাত করা হয়। এসব ভেজাল ঘি বাজারজাত করতে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করা জন্য মার্কেটিংয়ে লোকও নিয়োগ দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। ভেজাল ঘি প্রতি ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে বিএসটিআই এর ভুয়া লগোও মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখও ব্যবহার করা হচ্ছে।

তাদের কর্মচারীদের তথ্যমতে, এসব ভেজাল তৈরী করতে ১০০ টাকা খরচ না হলেও বিক্রি করছে ৪৬০ থেকে ৭০০ টাকা। এতে ব্যবসায়ীদের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে বাবুর্চিরা। বাবুর্চিদেরকে আকৃষ্ট করতে প্রতি কৌটায় টোকেনের মাধ্যমে ২শ টাকা করে দেয়া হয়। এতেবাবুর্চিরা লোভে পড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে এসব ভেজাল ঘি ১০/১৫টি ব্যবহার করেন। এসব ঘি তৈরী খাবার খেয়ে অনেকে বিভিন্ন কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এছাড়া বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না নিয়েই অনেক ঘি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে শহরের লালপোল, রামপুর, ধর্মপুরসহ শহরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে ভেজাল ঘির কারখানা। টিনের কৌটার গায়ে কারখানা চট্টগ্রাম বিসিক এলাকার ষোলশহর, চৌমুহনী বিসিকে তৈরী করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।

তবে এসব ভেজাল ঘি গোপনে তৈরী হচ্ছে ফেনী লালপোল (মিতালী ষ্টোরের মালিকানাধীন লিটনের গোডাউন) বিরিঞ্চি-হ্যাংকার, রামপুর রাস্তার মাথা ও সদর উপজেলার ধর্মপুরে।

পোলাও, বিরিয়ানি, পরোটা, কোরমা, হালুয়া বা যে কোনো সুস্বাদু খাবার তৈরীতে বিয়ে অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হয় ভেজাল ঘি।

এ সুযোগে ফেনীর বাজারে দুই যুগ ধরে সয়লাভ হয়ে গেছে ভেজাল ঘি। ভোজাল ঘির কারণে আসল ঘি বাজার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি, অভি স্পেশাল গাওয়া ঘি, ভিআইপি স্পেশাল গাওয়া ঘি, এপি-ওয়ান গাওয়া ঘি, টেস্টি গাওয়া ঘি ও হোমল্যান্ড গাওয়া ঘি, বাঘাবাড়ি ঘি, কহিনুর ঘি, মিল্ক ক্যারী, গোল্ড, এ-ওয়ান গাওয়া ঘি, কুকনি গাওয়া ঘি, সূর্য্যমুখি, রাণী, ডাবর গাওয়াসহ এসব ভেজাল ঘির দখলে রয়েছে বাজার।

নকল ঘির দাপটের দাপট ও চটকদার বিজ্ঞাপনের কাছে হার মানছে ক্রেতা-বিক্রেতারা। শহরের বড় বাজারের বণিক ষ্টোর, মেসার্স মা ট্রেডার্স, রহিম এন্টারপ্রাইজ, মেসাস ভূঞা এন্টারপ্রাইজ, মিতালী চা বিতান, রাম ভান্ডার, মহসিন ব্রাদাসসহ অনেকগুলো দোকানে ভেজাল ঘি দেদারছে বিক্রি হচ্ছে।

এসব নকল-ভেজাল ঘিগুলো বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৯০০ টাকায়। আবার কিছু কিছু ২৮০ থেকে ৫৮০ টাকায় দামে বিক্রি হচ্ছে। ফেনী শহরের লালপোলে কারখানা গড়ে তুলেছেন দাগনভূঞার রাজাপুর ইউনিয়নের আবুল বশরের ছেলে আনোয়ার হোসেন। সেখানে মেঝেতে রাখা ঘি এর কোটায় লিখা রয়েছে- আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গাভীর খাঁটি দুধের ক্রিম দিয়ে তৈরী শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি।

এসব ঘি গুলোর দাম মূল্য ৮৫০ টাকা। কিন্তু কারখানায় ঘি তৈরীর চিত্র দেখলে ক্রেতারা স্পেশাল ঘি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। অথচ ক্রেতা আকৃষ্ট করতে সরকারী রেজিষ্ট্রি নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে। লগো ব্যবহার করা হয়েছে বিএসটিআই এর।

শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি, অভি স্পেশাল গাওয়া ঘি, ভিআইপি স্পেশাল গাওয়া ঘি এ গুলো লালপোলে তৈরী করে আনোয়ারসহ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা। শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘিসহ কৌটার গায়ে ব্যবহার করছেন চৌমুহনী বিসিকের ঠিকানা। দুধ ছাড়াই তৈরি হয় এসব।

একইভাবে এপি-ওয়ান গাওয়া ঘি, টেস্টি গাওয়া ঘি ও হোমল্যান্ড গাওয়া ঘি তৈরী করেন ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আজহারুল হক আরজুর ভাই স্বপন ও মাজহারুল হক সুমন। এ- ওয়ান ঘির এজেন্ট বড় বাজারের নারিকেল পট্টির রামভান্ডার। এসব নকল ঘি ব্যবসা করে রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে ভেজাল ঘি বিক্রি ও বাজারজাত করণে মূখ্য ভূমিকা পালন করছেন বাবুর্চিরা। বিনিময়ে প্রতি কোটার জন্য পাচ্ছেন ২শ টাকা। এছাড়া ঈদের বোনাস পেয়ে থাকেন। প্রতি বিয়েতে ১০ থেকে ১৫টি ব্যবহার করা হয়। এজন্য বাবুর্চিরা তাদের নিজের নামে খাদ্যের তালিকায় এ ভেজাল ঘি নাম ব্যবহার করছেন।

তাকিয়া রোডে হাজী আনিছ বাবুর্চির খাদ্য তালিকায় হোমল্যান্ড ঘি, পূর্ব উকিল পাড়ার মো. পেয়ার আহম্মদ বাবুর্চি খাদ্য তালিকায় রয়েছে শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি, রাণী স্পেশাল গাওয়া ঘি, ভিআইপি ও ডাবর স্পেশাল গাওয়া ঘি। এসব বাবুর্চিরা নিজেদের লাভের জন্য অনুষ্ঠানে এসব ভেজাল ঘি কিনতে ভোক্তাদের বাধ্য করে। যেখানে ৫টি ঘির দরকার সেখানে বাবুর্চিরা ১০টি কেনার জন্য নির্দেশ দেন।

হাজী আনিছ বাবুর্চি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, এসব ঘি ক্ষতিকর বিষয়টি তার জানা নেই। বিভিন্ন সুবিধা পেয়েই এগুলো কিনতে আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বলে থাকেন।

নোয়াখালী আবদুল মালেক মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার সাহা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ভেজাল ঘি নিয়মিত খেলে ধীরে ধীরে কিডনী অকেজো হবে। এছাড়া যেকোনো বয়সে ব্রেন স্টোক ও হার্ড স্টোক হবার ঝুঁকি রয়েছে।

সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুল মোমিন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ভেজাল ঘি রোধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে জেলা প্রশাসনকে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হবে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মো: গোলাম জাকারিয়া বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ভেজাল প্রতিরোধে শীঘ্রই ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হবে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ফেনী প্রতিনিধি মোঃ দেলোয়ার হোসেন।#

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.