পুদিনা পাতায় ভাগ্য ফিরলো রুহুল আমিন বাবু-আনোয়ারা দম্পতির

লালমনিরহাট প্রতিনিধি: প্রায় ২০ বছর আগে প্রচণ্ড পেটের পীড়ায় আক্রান্ত  হয়েছিলেন লালমনিরহাটের মোগলহাট ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামের কৃষক রুহুল আমিন বাবু। বিভিন্ন চিকিৎসায় ঠিকমতো সুস্থ হয়ে উঠতে পারছিলেন না তিনি। পরে স্থানীয় এক চিকিৎসক পুদিনা পাতার রস খাওয়ার পরামর্শ দেন তাকে। আশপাশে কোথাও পুদিনা পাতা না পেয়ে খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বগুড়া। সেখান থেকে  পুদিনা পাতা সংগ্রহ করে আনেন এবং এর পাতার রস খেয়ে তিনি আজ পুরোপুরি সুস্থ। পুদিনা পাতায় তিনি পেটের পীড়া থেকে সুস্থ হয়ে এখন নিজেই বছরজুড়ে চাষ করছেন পুদিনা পাতা। এই পুদিনা পাতায় আবার তার সংসারকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। রূপকথার মতো না হলেও সেই রকমের এই ঘটনাটি আর গল্প নয়, পুরোপুরি বাস্তবতা।
এখন বাজারে খুব সহজলভ্য পুদিনা পাতা। রান্নায় পুদিনা পাতার কদর তো আছেই, কিন্তু ঔষধি হিসেবে এই পাতার বহুল ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই। যা অনেকের অজানা। এ ছাড়া রূপচর্চার উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে পুতিনা পাতা। আর যত দিন যাচ্ছে ততই গবেষণা হচ্ছে পুদিনা ও পুদিনার মতো ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে।
লালমনিরহাটের কৃষক রুহুল আমিন বাবু ১৮ বছর ধরে মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে পুদিনা পাতা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে আশানুরূপ আয় করছেন। তাদের উৎপাদিত পুদিনা পাতা শুধু লালমনিরহাট নয়, রংপুর, ঢাকা, কমিল্লা ও চট্টগ্রামসহ  দেশের বিভিন্ন স্থানে চাহিদামতো সরবাহ করা হচ্ছে।
উৎপাদিত পুদিনা পাতা বিক্রি করে প্রতিবছরে প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় করছেন এই কৃষক দম্পতি। তারা প্রতিবছরে ১৩০০-১৪০০ মণ পুদিনা পাতা উৎপাদন করছেন। প্রতি কেজি পুদিনা পাতা ২০০-২৫০ টাকা  কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বিক্রেতারা সরাসরি তার খেত থেকে পুদিনা পাতা কিনে নিয়ে যান। এ ছাড়া, বেশ কয়েকটি হোটেল- রেস্টুরেন্ট মালিকরাও তার কাছে নিয়মিত পুদিনা পাতা কিনছেন।
রুহুল আমিন বাবুর (৫৫) সঙ্গে কথা হলে তিনি বিটিসি নিউজকে জানান, পুদিনা পাতার রস খেয়ে পেটের পীড়া থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পুদিনা পাতা আবাদ করা শুরু করি। এর পর আশপাশের লোকজন পুদিনা পাতা থেকে উপকার পেতে থাকেন। ওষুধি এ গাছের চাহিদা বেড়ে যায়। ‘পুদিনা পাতা বিক্রি করে প্রথম দিকে বছরে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতো। বর্তমানে গড়ে ৩ লাখ টাকা আয় হচেছ। মাত্র ১০ শতাংশ জমির পুদিনা পাতা বিক্রি করে সারা বছরের সংসার খরচ সুন্দরভাবে চলে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন রুহুল আমিন বাবু। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমার ক্রেতা আছে। তারা টাকা পাঠিয়ে দিলে তিনি পুদিনা পাতা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।
রুহুল আমিন বাবু আরও বলেন, ‘পুদিনা পাতা চাষে তেমন খরচ নেই। শুধু নিয়মিত নজরদারি ও যত্ন নিতে হয়।  রোপণের মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যে পুদিনা পাতা বড় হয়ে ওঠে।
রুহুল আমিন বাবুন সহধর্মিণী আনোয়ারা বেগম (৫০) বলেন, ‘নিয়মিত পুদিনার যত্ন নিই। পুদিনা পাতাই আমাদের সংসারকে সচ্ছল রেখেছে। এর বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চলছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের বাড়ির পাশে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। আমরা সে জমিতে বিভিন্ন ফসল চাষ করছি। এর মধ্যে ১০ শতকে শুধু  পুদিনা পাতা চাষ করা হয়।
লালমনিরহাট শহরের সবজি বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘লালমনিরহাটে শুধু রুহুল আমিন বাবু- আনোয়ারা বেগম কৃষক দম্পতি বাণিজ্যিকভাবে পুদিনা পাতা উৎপাদন করছেন। তাদের কাছ থেকে পুদিনা পাতা সংগ্রহ করে ক্রেতাদের সরবরাহ করা হয়।
লালমনিরহাট শহরের হার্বাল চিকিৎসক রমেশ চন্দ্র বর্মণ বিটিসি নিউজকে বলেন, পুদিনাপাতা ওষুধ জাতীয় ফসল। পুদিনাপাতার তৈরি বোরহানি সবার প্রিয়। বড় ধরনের পারিবারিক অনুষ্ঠান ও বড় হোটেল-রেস্টুরেন্টে পুদিনাপাতার বোরহানি তৈরি করা হয়। পুদিনাপাতা ভর্তা করে খাওয়া যায়। পুদিনা পাতা দিয়ে শরবত খান অনেকে। পুদিনাপাতা পেটের পীড়া, শরীর ব্যথা, আমাশয়সহ নানা রোগের উপকারে আসে।
বিশেষ করে পুদিনা পাতা ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে। পুদিনা পাতার পেরিলেল অ্যালকোহল যা ফাইটো নিউট্রিয়েন্টসের একটি উপাদান দেহে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে।
এ ছাড়া, ব্রণ দূর করতে ও ত্বকের তেলতেলে ভাব কমাতে তাজা পুদিনা পাতা বেটে ত্বকে লাগিয়ে দশ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেললে ব্রণের দাগ দূর হবে। প্রতিদিন রাতে পুদিনা পাতার রস মুখে লাগাতে হবে। সম্ভব হলে সারারাত  যদি সম্ভব না হয়, তা হলে কমপক্ষে ২/৩ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেললেই হবে।মাসখানেক এইভাবে লাগালে ব্রণের দাগ উধাও হয়ে যাবে।
এ ছাড়া চুলে উকুন হলে পুদিনার শেকড়ের রস লাগানো যায়। উকুনের মোক্ষম ওষুধ হল পুদিনার পাতা বা শেকড়ের রস। গোটা মাথায় চুলের গোড়ায় এই রস ভাল করে লাগাতে হয়। এরপর একটি পাতলা কাপড় মাথায় পেঁচিয়ে রেখে এক ঘণ্টা পর চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেললেই হয়ে যাবে। সপ্তাহে অন্তত দুবার লাগালে  এক মাসের মধ্য চুল হবে উকুনমুক্ত।
এ ছাড়া  সর্দি হলে নাক বুজে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো মারতœক কষ্ট হয় অনেকের। সেই সময় যদি
পুদিনা পাতার রস খেলে রেহাই পাবেন নিমেষে। যারা অ্যাজমা এবং কাশির সমস্যায় ভোগেন, তাদের তাৎক্ষণিক উপশমে পুদিনা পাতা বেশ কার্যকরী। খুব বেশি নিঃশ্বাসের এবং কাশির সমস্যায় পড়লে পুদিনা পাতা গরম জলে ফুটিয়ে সেই জলের ভাঁপ নিতে পারেন। ভাঁপ নিতে অসুবিধা হলে গার্গল করলেও হবে।
পুদিনা পাতায় রয়েছে এন্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যা পেটের যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে খুব দ্রুত। যাঁরা হজমের সমস্যা এবং পেটের ব্যথা কিংবা পেটের নানান সমস্যায় ভুগে থাকেন, তারা খাবার কাওয়ার পর ১ কাপ পুদিনা পাতার চা খাওয়ার অভ্যাস করুন। ৬/৭টি তাজা পুদিনা পাতা গরম জলে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে খুব সহজে পুদিনা পাতার চা তৈরি করতে পারেন ঘরের মধ্যেই।
গরমকালে শরীরকে ঠান্ডা রাখাতে পুদিনার রস খুব ভালো। গোসলের আগে পানির মধ্যে কিছু পুদিনা পাতা ফেলে রাখুন। সেই পানি দিয়ে দিয়ে গোসল  করলে শরীর ও মন চাঙ্গা থাকে।
কৃষি বিভাগ জানায়, পানি জমবে না এমন উঁচু স্থানে পুদিনা পাতা চাষ করতে হয়। এ অঞ্চলের মাটিতে পুদিনা পাতার ফলন বাম্পার হয়ে থাকে। ঔষধি গাছ উৎপাদন করতে শুধু জৈবসার দিতে হয়। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর লালমনিরহাট প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান হাসান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.