দেশে ও আন্তর্জাতিক ভাবে চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে ইরান

ছবি: সংগৃহীত

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভুলবশত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইউক্রেনীয় বিমান ভূপাতিতের কথা স্বীকার করে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে ইরান। একদিকে এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি ও সরকারকে এর জবাবদিহি করতে রাজধানী তেহরানে শুরু হয়েছে তুমুল বিক্ষোভ।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোয়ও হচ্ছে চরম সমালোচনা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভাবেও এ ঘটনা নিয়ে চাপের মধ্যে পড়েছে দেশটি।

সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রেভোল্যুশনারি গার্ডপ্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরাকে দুই মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আরোপ হওয়া নিষেধাজ্ঞা। সব মিলিয়ে দেশে-বিদেশে নতুন করে ইমেজ সংকটে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি।

কিন্তু এত বড় একটি ভুল কীভাবে ঘটল তা নিয়ে ইরানের সরকারি মহলে এখন চলছে তোলপাড়। ওইদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডের অ্যারোস্পেস কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ জানান, দায়িত্বরত ক্ষেপণাস্ত্র অপারেটরের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মাত্র ১০ সেকেন্ড সময় ছিল। তিনি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া অথবা না ছোড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঘটনার পর পরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ভুলের বিষয়টি জানানো হয়। ইরানি বাহিনীর কাছে তথ্য ছিল, মার্কিন বাহিনী তাদের ঘাঁটিতে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরানের দিকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ফলে এ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে ওই সময় ইউক্রেনের উড়োজাহাজটিকে ভুল করে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ভেবে আঘাত হানেন ওই অপারেটর।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, গত শনিবার ইরান ভুলবশত ইউক্রেনীয় বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা স্বীকার করার পর থেকেই দেশটি একাধিক জায়গায় বিক্ষোভ শুরু হয়। বিমান ভূপাতিতের ফলে যে ১৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের হয়ে বিচারের দাবিতে এদিন তেহরানে আমিরকবির ইউনিভার্সিটির সামনে বিশাল জমায়েত হয়। এ সময় কর্মকর্তারা কেন দীর্ঘ সময় ধরে এই ঘটনা নিয়ে মিথ্যা বলেছেন সরকারের কাছে, তার জবাবদিহি দাবি করেন বিক্ষোভকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চরম উত্তেজনার মুহূর্তে কেন বিমানটিকে উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

বিক্ষোভকারীদের অনেককে এ সময় দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পদত্যাগও দাবি করে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে এই বিক্ষোভ শহরের আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিতে শুরু করে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে ও লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এর মধ্যেই এই বিক্ষোভে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে তেহরানে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট নাইজেল পল ম্যাকেয়ার ওরফে রব ম্যাকেয়ারকে আটক করে পুলিশ। ঘণ্টা তিনেক পরই তাকে ছেড়ে দেওয়া হলেও এ নিয়ে জবাবদিহি করতে ফের তাকে ডেকে পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। এভাবে কোনো রাষ্ট্রদূতকে আটকের ঘটনা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নজিরবিহীন। তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সরব হয়েছে যুক্তরাজ্য। তাদের দাবি, রব ম্যাকেয়ারকে আটক করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে ইরান। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কোনোরকম কৈফিয়ত ছাড়াই আমাদের রাষ্ট্রদূতকে আটক করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে তেহরান। এই মুহূর্তে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরান সরকার। হয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একঘরে হওয়ার পথে এগোক তারা, নইলে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনে পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।

এই বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়ে এদিন টুইট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিক্ষোভকারীদের ওপর নিপীড়ন না চালাতে তেহরানকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, বিশ্ববাসী এই আন্দোলনের ওপর নজর রাখছে।

এদিকে বিমান ভূপাতিত করার কথা স্বীকারের পর ইরানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ইউক্রেন ও কানাডা সরকারও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক পোস্ট করে এই ঘটনার জন্য দায়িদের শাস্তি দাবি করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি। এই ঘটনাকে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। সরকারি এক বিবৃতিতে তিনি মৃতদের পরিবার ও তাদের প্রিয়জনদের কথা ভেবে ইরানকে এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে বলেন। তিনি বলেন, কানাডার সমস্ত নাগরিক এ ঘটনায় প্রচ- আঘাত পেয়েছে। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। এর জন্য মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি ইরানকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে গত ৩ জানুয়ারি ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডের প্রধান জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে গত ৮ জানুয়ারি ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ওই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী বিমান তেহরানের ইমাম খামেনি বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের তিন মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়। বোয়িং ৭৩৭ মডেলের বিমানটিতে ৮২ জন ইরানি, ৬৩ জন কানাডীয়, ১১ ইউক্রেনীয়, ১০ সুইস, ৪ আফগান, ৩ ব্রিটিশ এবং ৩ জন জার্মান নাগরিক ছিলেন। দুর্ঘটনায় বিমানটির সব যাত্রী ও ক্রু নিহত হন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.