তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?

(তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?)
বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: একসময় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বন্ধু দেশ ছিল তুরস্ক। আর আজ সেই তুরস্ককেই দাঁড় করানো হচ্ছে আমেরিকার সবচেয়ে শত্রুদের কাতারে। এখন প্রশ্ন আসছে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে? তুরস্ক পশ্চিমা বলয় থেকে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে যাচ্ছে কি না? আসলেই কি তুরস্কের পশ্চিমা বলয় থেকে বেড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? 
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে বেলজিয়ামের রাজধানীতে প্রথম বৈঠকটি হয়েছে। ন্যাটো সম্মেলনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত এই মুখোমুখি বৈঠকে তারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আসলেই কি দু’দেশের সম্পর্কের রাতারাতি কোনও উন্নতি হওয়ার সম্ভব? তুরস্কের এবং আমেরিকার মাঝে অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে ঝুলিয়ে রেখে নতুন করে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা প্রায় অসম্ভব।
তুরস্ক কেন আমেরিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ? 
দীর্ঘ চার দশক ধরে চলতে থাকা স্নায়ু যুদ্ধের সময় তুরস্ক মূলোতো তার স্বাধীনতা রক্ষায় ন্যাটো সামরিক জোটে তার সামরিক ও কৌশলগত অবদানের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন, তুরস্ক তার ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক গতিশীলতা, সামরিক শিল্পের উন্নতি এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য বিশেষ ভাবে সামনে চলে এসেছে।বিশেষ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট রেজেপ তায়্যিপ এরদোগানের গত কয়েক বছর ধরে কিছু সাহসী পদক্ষেপ দেশটিকে আরও বেশি ফোকাসে নিয়ে এসেছে। তুরস্ক এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর একটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আধুনিক তুরস্ক রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য পশ্চিমা বলয়ে অবস্থান নেয়। ১৯৪৭ সাল থেকে  শুরু হওয়া এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা স্নায়ু যুদ্ধের সময় তুরস্ক ছিল পশ্চিমা বলয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।তখন সম্পর্কের উত্থান পতন হলেও তুরস্ককে পশ্চিমারা দেখত সবচেয়ে আজ্ঞাবহ মিত্র হিসেবে। কিন্তু সে সম্পর্কে পরিবর্তন আসতে শুরু করে স্নায়ু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে, যখন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যায়। তখন আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো তথা পশ্চিমারা এই অঞ্চলে পরিচালনা করতে থাকে একের পর এক তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
তখন থেকে শুরু করে গত বিশ-ত্রিশ বছরে ইরাক, ইরান, কুয়েত, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, নাগরনো কারাবাখ, বলকান অঞ্চল সহ তুরস্কের চারিদিকের ভুরাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।এবং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তুরস্কও নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে নতুন করে। নতুন করে এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থের জন্য পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক সিদ্ধান্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও নিয়েছে। নিজের সামরিক শিল্পকে অনেক শক্তিশালী করেছে।
দেশটি পশ্চিমাদের আজ্ঞাবহ মিত্র থেকে বের হয়ে এখন যে বহুমুখী বিদেশনীতি অনুসরণ করছে তা অনেক পশ্চিমা রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক এবং বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিরা ভালভাবে নিচ্ছেন না। এখন জোড়েসোরেই আলোচনা হচ্ছে যে তুরস্ক কি পশ্চিমা বলয় থেকে বেড় হয়ে যাচ্ছে?
তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যের সম্পর্কের প্রধান সমস্যাগুলো কি কি?  
এক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি সামনে আসবে তা হলো তুরস্কের রাশিয়া থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা ক্রয় করা।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাবস্থা কেনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা তুরস্কের উপর সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং তুরস্ককে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান তৈরির প্রকল্প থেকে বের করে দিয়েছে। এতে তুরস্কের ক্ষতি হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার।
এখানে আমেরিকার যুক্তি হলো, তুরস্ক এই প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা কিনে আসলে ন্যাটো সামরিক জোটকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অথচ তুরস্ক বলছে, অন্য ন্যাটো সদস্য যেমন গ্রীসও তো রাশিয়া থেকে এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা বাবস্থা কিনেছে এবং ব্যাবহার করছে। সুতরাং রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কিনে গ্রীস যদি ব্যবহার করেতে পারে তাহলে তুরস্কও পারবে। এ নিয়ে তুরস্ক একটি কমিশন গঠন করারও প্রস্তাব দিয়েছে  যে কমিশন এই প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থার ব্যবহারের বিষয়টি দেখভাল করবে। কিন্তু আমেরিকা মেনে নেয়নি। ওয়াশিংটনের একটাই দাবি এই অস্ত্র রাশিয়ার কাছে ফেরত দেওয়া অথবা কখনই ব্যবহার করবে না মর্মে লিখিত চুক্তি করবে।
অন্যদিকে, তুরস্কের চীন এবং রাশিয়ার প্রতি বেশি ঝুঁকে যাওয়া নিয়েও আমেরিকার অভিযোগের শেষ নেই।এ ক্ষেত্রে তুরস্কের যুক্তি হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত কয়েক বছরে আঙ্কারার বিরুদ্ধে যে শত্রুতা মূলক আচরণ করছে সে কারণেই তুরস্ক বাধ্য হচ্ছে এই পূর্ব বলয়ে ঝুঁকতে।
এছাড়াও, তুরস্কের এজিয়ান এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান নিয়েও আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যথেষ্ট নাখোশ। এক্ষেত্রে হুমকি ধামকি দিয়ে তুরস্ককে বিরত রাখার চেষ্টা করছে তারা। হয়তো তুরস্ক কিছুটা নমনীয় হবে এক্ষেত্রে।
আর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, কারাবাখ এবং বলকান অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবকে ভালোভাবে নিচ্ছেনা মার্কিনিরা। যদিও এসব এলাকায় তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মূলত পরোক্ষভাবে আমেরিকার পক্ষেই কাজ করছে। কিন্তু তারপরেও এইসব বিষয়ে তুরস্ককে মার্কিনীদের স্বার্থে কাজ করার জন্য আহ্বান করছেন বাইডেন প্রশাসন।
অন্যদিকে তুরস্কেরও আমেরিকার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তুরস্কের রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের মুল হোতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে আমেরিকার সামরিক এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সব ধরণের সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।শত রিকোয়েস্ট এবং হাজার হাজার দলিল দস্তাবেজ সাবমিট করার পরেও তাকে তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করছে না মার্কিন প্রশাসন। এবং তাকে হস্তান্তর করার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
এছাড়াও, তুরস্কের হাল্ক ব্যাংক নামের একটি সরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমেরিকার আদালতে অনেকগুলো মামলা চলছে। যেগুলোতে বলা হয়েছে যে এই ব্যাংকটি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানের সঙ্গে ব্যাবসা করেছে। এই মামলা এখন রাজনৈতিক একটি মামলায় রূপ নিয়েছে আর তুরস্ক চাচ্ছে এই মামলা গুলো উঠিয়ে নেওয়া হোক। এ ব্যাপারে সমোঝোতা হতে পারে।
তবে তুরস্ক এবং আমেরিকার সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হোলো সিরিয়াতে কুর্দি সশস্ত্র সংগঠনটিকে আমেরিকার প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া। এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলে একটি কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের পায়তারা করছে তারা। যেটি তুরস্ক তার ভূখণ্ডের উপর সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছে। কারণ, তুরস্কের মতে সিরিয়াতে পিকেকে সন্ত্রাসী গ্রুপটি যতো শক্তিশালী হবে। তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে তত বেশি সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাবে। এমনকি ওখানে নতুন একটি কুর্দি রাষ্ট্রের আবির্ভাব হলে তা তুরস্কের অখণ্ডতার প্রতি বিশাল হুমকি সৃষ্টি করবে।
এছাড়াও তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালানোরও অভিযোগ আছে আমেরিকার বিরুদ্ধে।
আসলে তুরস্ক এবং আমেরিকা দু পক্ষই জানে একে অপরের কোনও বিকল্প নেই। তাই তারা একে অপরকে না পারছে ছাড়তে আর না পারছে শক্ত করে ধরতে। এ কারণেই মার্কিন প্রশাসন তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না বরং তারা এরদোগান বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। এখন এরদোগান যদি তাদের কথায় উঠবস করে তাহলে তুরস্কের সঙ্গে তাদের কোনও সমস্যাই থাকবে না।
মার্কিনী কর্তব্যস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকের মুখেই এরকম বিবৃতি শোনা যায় যে, এরদোগান এমন একজন লিডার যাকে অল্পস্বল্প চাপে নমনীয় করা যাবে না। তার দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করে তাকে এমন বেকায়দায় ফেলতে হবে যেখান থেকে তার আর পরিত্রাণের পথ থাকবে না। তখন সে আমাদের কাছে ফরিয়াদ করবে, ধরনা ধরবে। আর তখনই আমরা তার সঙ্গে দরকষাকষিতে পেরে উঠতে পারবো। এজন্যই তুরস্কের বিরুদ্ধে তথা এরদোগানের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের যতসব আক্রমণ।
আমেরিকা সবসময়ই চায় তার তাঁবেদারি কোনও সরকার তুরস্কে ক্ষমতায় থাকুক। যে সরকারটি কোনো পরিস্থিতিতেই আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে না। এই অঞ্চলে আমেরিকার পিয়নগিরি করবে।
আর এই তাঁবেদারি এবং পিয়নগিরি করা সরকারটি যতই আন্তর্জাতিক আইন-আদালত এবং নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে যাক না কেন, যতই অ্যান্টি-ডেমোক্র্যাটিক হোক না কেন, এমনকি সে যদি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাপোর্টারো হয় তাকে তখন ক্ষমতায় রাখার জন্য সব ধরণের সহযোগিতা দেয় আমেরিকা।
যেমন, ইসরাইল, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, মায়ানমার, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ভারতে এগুলো আমরা দেখছি।
আর যখন কোনও সরকার তার তাঁবেদারির বিরুদ্ধে যায়, তার কথার বাইরে যায়, তার স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে, তার পিয়নগিরি না করে, তখন মার্কিনীরা সে সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যায়। সে সরকারকে উৎখাত করার জন্য, তখন ডেমক্র্যাসি, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা, মানি লন্ডারিং সহ বিভিন্ন অজুহাতে অনেক বিধি নিষেধ আরোপ করে। দেশের মধ্যে অস্থিতিশীলতা তৈরি এবং দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ব্যাবহার করে ওই সরকারটিকে চাপে ফেলে বাগে আনতে চেষ্টা করে। আর বাগে আনতে না পারলে ওই সরকারকে উৎখাতের জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালায়।
তুরস্ক এবং আমেরিকার বর্তমান সম্পর্ক এই থিওরির উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা দরকার। তাহলে দেখবেন অনেক কিছুই ক্লিয়ার হয়ে যাবে আপনার সামনে।
বৈরি সম্পর্কের মূলে কী আসলে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা?  
তুরস্কের সঙ্গে আমেরিকার বর্তমানের যে বৈরি সম্পর্ক তার মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয় তুরস্কের রাশিয়া থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা কেনার বিষয়টিকে। এবং এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করা হয়েছে যে সব সমস্যার মূলেই যেনো এই এস-৪০০। মনে হয় যেন এই ক্ষেপণাস্ত্র না কিনলে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুব মধুর হতো।
দেখুন, তুরস্কের রাশিয়া থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৭ সালে। তুরস্কের রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরের বছর। এবং এই প্রতিরক্ষা বাবস্থার প্রথম চালান তুরস্কে আসে ২০১৯ সালে। যদি বিষয়টি এরকমই হয় যে সব সমস্যা শুরুই হয়েছে এই এস-৪০০ কেনার কারণে। তাহলে, ২০১৬ সালে যখন এই এস-৪০০ কোনও আলোচনায়ই ছিলনা। তখন এরদোগানকে উৎখাত করতে কেন সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়েছিল। কেন ২০১৫ সালে তুরস্কের মধ্যে সন্ত্রাসীদেরকে লেলিয়ে দিয়ে মুহুর মুহুর বোমা ফুটিয়ে সারা তুরস্কে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। কেন তুরস্কের ওই ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মুল হোতা ফেতুল্লাহ গুলেন এখনো আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় সরকারি নিরাপত্তায় বসবাস করছে। কেন তুরস্কের কাছে তাকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।
তুরস্ক আমেরিকার সম্পর্কে মার্কিনীদের পক্ষ থেকে এই এস-৪০০ নিয়ে যে কথাটি বেশি বলা হয় তা হল, তুরস্ক আমাদের মিত্র রাষ্ট্র, বন্ধু রাষ্ট্র, ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, সেই বন্ধু রাষ্ট্রটি কিভাবে আমাদের চির শত্রু রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে।
কিন্তু সেই একই তুরস্ক যখন বলে আমেরিকা আমার মিত্র রাষ্ট্র, বন্ধু রাষ্ট্র, ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, সেই আমেরিকা কিভাবে আমার চির শত্রু পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনটিকে সিরিয়াতে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। যে অস্ত্র মূলত তুরস্কে আক্রমণ করার জন্য ব্যাবহার করছে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি।
তখন আমেরিকার উত্তর কুর্দিরা আমাদের কৌশলগত অংশীদার। তুরস্ক তখন প্রশ্ন করে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন কিভাবে আমেরিকার কৌশলগত অংশীদার হতে পারে? তুরস্কের জিজ্ঞাসা, আমি কি তোমার strategic partner না? আমি কি ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তিধর রাষ্ট্র না? আমি কি তোমার বন্ধু না? তাহলে আমার নিরাপত্তা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় কেন? তুমি যদি আমার ঘরের পাশে এসে আমার শত্রুকে অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে গড়ে তোলো তখন তোমার বন্ধুত্ব নিয়ে শুধু সন্দেহই নয় বরং তুমি আমার শত্রুর চেয়েও বড় শত্রু হয়ে যাও।
এমনকি তুরস্ক যখন আমেরিকার কাছে তার নিরাপত্তার জন্য প্যাট্রয়েট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার প্রস্তাব দেয় তখন আমেরিকা বিভিন্ন অজুহাতে বিক্রি করে না। ফলে আঙ্কারা, রাশিয়ার শরণাপন্ন হয় অর্থাৎ এরদোগানকে পুতিনের কাছ থেকে এস-৪০০ কিনতে মূলত আমেরিকাই বাধ্য করে।
আসলে তুরস্ক এবং আমেরিকার মধ্যে বর্তমানে যে বিষয়গুলো নিয়ে মূল সমস্যা সেগুলো দুই পক্ষ খুব ভাল করেই জানে। এবং সমাধানও তাদের থেকেই জানা। কিন্তু এখানে মূল বিষয় হচ্ছে তুরস্কের শক্তিশালী হয়ে ওঠা।
অর্থাৎ সেই স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের মত তুরস্ক এখন আর আমেরিকার কথায় উঠবস করছে না। এই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থের জন্য নিজের স্বার্থকে বলি দিচ্ছে না। এছাড়াও, পশ্চিমা বলয়ের বাইরেও বিশ্বের যে বড় একটা অংশ আছে সেই অংশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
এ কারণেই, এস-৪০০ কেনার অজুহাতে তুরস্কে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান তৈরির প্রজেক্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এই সব কারণেই, এস-৪০০ কেনার অজুহাতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ কারণেই তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হওয়ার পরেও তুরস্কের সঙ্গে শত্রুর মত আচরণ করা হচ্ছে।
আর এ ক্ষেত্রে তাদের বড় শত্রু হচ্ছেন এরদোগান। কারণ তাদের ধারণা এরদগানের কারণেই তারা তুরস্ককে তাদের নিজেদের ইচ্ছেমত পরিচালনা করতে পারছে না। আজ এরদোগানের পতন হোক, কাল তুরস্কের বিরুদ্ধে সব ধরণের অবরোধ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তুরস্কের অর্থনীতিতে গতি আসবে, তারা তুরস্কের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ডলারকে ব্যাবহার করে যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে তাও বন্ধ করে দিবে। তবে এর বিপরীতে তুরস্ক এখন যেমন প্রতিরক্ষা শিল্পে স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করছে, এনার্জি সেক্টরে বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, বহুমুখী বিদেশ নীতি পরিচালনা করছে সেগুলো মুখ থুবড়ে পরবে।
তবে বর্তমান তুরস্কের যে অবস্থান তাতে এখন আসলে তুরস্কের সঙ্গে আমেরিকা আগের মত আচরণ করলে সমঝোতায় আসা সম্ভব না। আমেরিকা চাচ্ছে যথা সম্ভব চাপ প্রয়োগ করে তুরস্ককে বাগে আনতে। সেই শীতল যুদ্ধের সময়ের জি হুজুর, জি হুজুর করা একটা সরকার চায় তারা তুরস্কে। এজন্যই গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করছে তুরস্কের উপর। মুখে বলছে মিত্র রাষ্ট্র। কিন্তু শত্রুতার সব কিছুই করছে তুরস্কের বিরুদ্ধে। আবার সুন্দর করে দোষ ও চাপিয়ে দিচ্ছে তুরস্কের উপর।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের ধরণটাও পরিবর্তন হয় 
এখন আমারিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের নতুন এই তুরস্কের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়া উচিত। সবার আগে বুঝা উচিত যে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে তুরস্ক সেই আগের অবস্থানে নেই । যেমন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তুরস্ক সবসময়ই রাশিয়ার ভয়ে থাকতো। এমন কি রাশিয়া তুরস্কের পূর্ব অঞ্চলের কিছু এলাকা দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য তুরস্ককে সর্বদাই তটস্থ রাখতো। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার পরে তুরস্ক রাশিয়াকে একটু কম ভয় পেতে শুরু করে। একই সঙ্গে তুরস্কের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি আঙ্কারাকে মুক্তভাবে চিন্তা করতে সহয়তা করছে।
শুধুমাত্র একমুখী অর্থাৎ পশ্চিমমুখী ফরেইন পলিসি থেকে বেড়িয়ে এসে বহুর্মুখী ফরেইন পলিসি চালু করছে এশিয়া এবং ইউরোপের সন্ধিক্ষণে থাকা এই দেশটি। শুধু মাত্র ইউরোপ এবং আমেরিকার দিকে তাকিয়ে না থেকে বরং, এশিয়া, প্যাসিফিক, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, বলকান, মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা এমনকি লাতিন আমেরিকার সঙ্গেও রাজনৈতিক, সামরিক, এবং ব্যাবসায়িক সম্পর্ক গড়তে থাকে তুরস্ক। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গেও সু সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
অন্যদিকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের ভু-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ইরান এখন আর পশ্চিমাদের জন্য সবচেয়ে বড় থ্রেট না। সিরিয়া এখন ভঙ্গুর। ইরাক এখনো ধুকছে সেই ততাকথিত গণতন্ত্র নিয়ে আসার মিথ্যা প্রলোভনের বীভৎস ধাক্কায়। মিসর এখন আর সেই মিসর নেই। নেই সেই অর্থনৈতিক, বা সামরিক শক্তি। সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। আরব আমিরাত, মরুভূমির বুকে আনন্দ ফুর্তি করার জন্য সুন্দর এক জায়গা কিন্তু পশ্চিমাদের জন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য কোনও দেশ নয়।
ইউরোপ আরও শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে এখন আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়া, এই আন্তর্জাতিক জোটটিকে অর্থনৈতিক এবং মোরালের দিক দিয়ে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে।এখন নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে ইউরোপ।
এই সব কিছুর বিবেচনায় আমেরিকার উচিত তুরস্কের সঙ্গের সম্পর্ককে নতুন করে ঢেলে সাজানো।
হুমকি ধামকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, অবরোধ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তুরস্ককে দমানো সম্ভব না।
তুরস্কের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক এর চেয়ে বেশি খারাপ কি কখনও হয়েছিল? 
১৯৭৪ সালে তুরস্ক যখন সাইপ্রাসে তুর্কি নাগরিকদের রক্ষায়  একটি সামরিক অভিযান চালায়, তখন আমেরিকা তুরস্কের উপরে জারি করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধাজ্ঞায় তুরস্ক ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং সামরিক সমস্যায় পরে। এর প্রতিশোধ হিসেবে তুরস্ক তখন এদেশে অবস্থিত আমেরিকার সবগুলো সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেয় এবং সব মার্কিন সেনাকে দেশ থেকে বের করে দেয়। পরে অবশ্য আমেরিকা অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার কয়েক বছর পরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় তুরস্কের সরকার পরিবর্তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে অনেকবার। এগুলো এখন ওপেন সিক্রেট।
 ২০০৩ সালে আমেরিকা যখন ইরাক যুদ্ধে তুরস্কের ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে চায় তখন তুরস্ক অনুমতি না দিলে সম্পর্ক আবার খারাপ হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে আমেরিকার সৈন্যরা দক্ষিণ ইরাকে কিছু তুর্কি সেনাকে বন্দী করে তাদের মাথায় বস্তা বেঁধে রাখে। সে পরিস্থিতিও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে দু’দেশ।
সুতরাং, সেই ১৯৭৫ সালে যে তুরস্ককে সামরিক এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমাতে পারেনি, আজকের এই ২০২১ সালের তুরস্ককে দমানো অতো সহজ হবেনা।
তাই আমেরিকার উচিত, এই অঞ্চলের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, তুরস্কের সঙ্গের সম্পর্ককে নতুন করে ঢেলে সাজানো। অন্যদিকে, তুরস্কেরও উচিত তার সামরিক, এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে অনুধাবন করে পশ্চিমাদের সঙ্গে নতুন করে উইন-উইন পজিশন তৈরি করা।
আসলে, পশ্চিমাদের সঙ্গে  সু-সম্পর্ক গড়ার জন্য তুরস্কে এক পায়ে খাঁড়া।এক্ষেত্রে দরকার তুরস্ককে সেই আগের মত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা হেয় প্রতিপন্ন না করে বরং সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা।
কারণ, তুরস্কও জানে তার ভাগ্য পূর্ব পশ্চিমের মাঝখানে দোদুল্যমান। পাশ্চত্যের  সঙ্গে যেমন সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে না, তেমনি প্রাচ্যকেও পুরোপুরি দূরে ঠেলে রাখতে পারবে না। ভারসাম্যের নীতি বজায় রেখেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে উসমানীয়দের উত্তরসূরি এই দেশটিকে। #

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.