তিয়েনআনমেন স্কয়ার’র মতোই উহান রহস্য, মত বিশেষজ্ঞদের

(তিয়েনআনমেন স্কয়ার’র মতোই উহান রহস্য–ফাইল ছবি)

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: তিয়েনআনমান স্কয়ারের সঙ্গে উহানের মিল খুঁজে পাচ্ছেন চীনা মানবাধিকার কর্মীরা। ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমান স্কয়ারে গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের বিরুদ্ধে যেমন গর্জে উঠেছিল মানবতা বিরোধী সরকারের কামান, ঠিক তেমনই উহান থেকে শুরু হয়েছে গোটা দুনিয়ার মানবজাতিকে ধ্বংস করার কোভিড-১৯ ভাইরাসের।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপেং এখন মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করতে চাইছেন বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক দুনিয়া চীনের এমন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব হোক, এমনটাই চাইছেন তারা।

একদিকে যেমন প্রশ্ন উঠেছে করোনা নিয়ে চীনের ভূমিকা নিয়ে, পাশাপাশি দাবি উঠেছে তিয়েনআনমান স্কয়ারের তিন দশক আগে সংগঠিত বর্বরতারও সঠিক তথ্য প্রকাশ্যে আনার।

চীনা মোবাইল অ্যাপ নিষিদ্ধ করায় ভারতের প্রশংসা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক দুনিয়াও একই পথ অনুসরণ করুক। সেই সঙ্গে দাবি উঠছে তাইওয়ানের কূটনৈতিক স্বীকৃতিরও।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কার্যকলাপ নিয়ে সম্প্রতি একটি ওয়েবনিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। চীন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব এই ভার্চুয়াল সম্মেলনে বক্তব্য পেশ করেন। ওয়েবনিয়ারের বিষয় ছিল, ‘এম্পায়ার হ্যাস নো ক্লথস: চায়না আন্ডার শি জিনপেং’।

অর্থাৎ, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর আমলে শাসকের কোনও পোশাকই নেই। মানে একেবারেই রাখঢাকের কোনো ব্যাপার নেই। উদ্যোক্তারা হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, সিসিপি-র শাসনামলে প্রকাশ্যেই লুণ্ঠিত হচ্ছে মানবিকতা।

প্রতিবাদের কোনও উপায় তো নেই ই, সেই সঙ্গে চূড়ান্তভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন গণতন্ত্রপ্রেমী সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদ করলেই জেল।

এদিকে তিয়েনআনমান স্কয়ারের বীভৎসতার স্মৃতি উসকে দিচ্ছে খোদ সেই সরকারই। সেদিনের গণহত্যার প্রশংসা করে চলেছেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা।

শুধু উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলিমরাই নন, চীনের সাধারণ মানুষও আজ চূড়ান্ত বিরক্ত সরকারের ওপর। এরপরও দমন-পীড়ন নীতিতে ভর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় দেশটির সরকার। ওয়েবনিয়ারে অংশ নিয়ে বক্তারা তুলে ধরেন সেখানকার প্রতিচ্ছবি।

এই ওয়েবনিয়ারে অংশ নেন চীনের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যানিটেরিয়ান চায়নার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জৌ ফেংশু। তিয়েনআনমান ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। এজন্য জেলও খাটতে হয়েছে তাকে।

এখন তিনি নির্বাসনে। বর্তমানে জেনেভায় তিব্বত সংক্রান্ত মানবাধিকার ব্যুরোয় বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনলে চুক্কি এবং সাংবাদিক আদিত্য রাজ কলও অংশ নেন ওয়েবনিয়ারে। আলোচনায় উঠে আসে চীন সরকারের মানবিকতা বিরোধী বিভিন্ন কার্যকলাপ।

দুনিয়াজুড়ে করোনা সম্প্রসারণে সিসিপির ভূমিকাকে ‘সন্দেহজনক’ উল্লেখ করে বক্তারা মানব সংহারে তিয়েনআনমান স্কোয়ারের সঙ্গে উহানের তুলনা করেন। দুটি জায়গার প্রকৃত ঘটনাই বিশ্বের কাছে অজানা।

সে কারণেই নিরপেক্ষ তদন্তেরও দাবী তোলেন বক্তারা। এতে করে চীনা প্রেসিডেন্টের প্রকৃত রূপ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হবে বলে বিশ্বাস বক্তাদের।

কী হয়েছিল সেদিন তিয়েনআনমান স্কয়ারে? আরও একবার স্মরণ করা যাক, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের নিরীহ জমায়েতের উপর সশস্ত্র আক্রমণ মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই উদাহরণ। সেদিন সাধারণ ছাত্র-শ্রমিকদের উপর গর্জে উঠেছিল পিপলস লিবারেশন আর্মির কামান। অগণিত মানুষ মারা যান। জানা যায়নি মোট মৃতের সঠিক সংখ্যা।

তাদের হত্যা করে আজও অনুতপ্ত নয় সিসিপি। বরং আজ অবধি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে অমানবিক সেই কাহিনী। কেউ মুখ খুললেই তার বিরুদ্ধে নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

১৯৮৯ সালে এপ্রিল মাস থেকেই চীনে শুরু হয়েছিল সরকারি দুর্নীতি বন্ধ ও গণতন্ত্রের দাবিতে অনশন। ছাত্র-ছাত্রীরা ঐতিহাসিক তিয়েনআনমান স্কয়ারে বসেছিলেন অনশনে। মাও সেতুংয়ের ছবির পাশেই তারা গণতান্ত্রিক শক্তির কল্পিত দেবতার ছবি তুলে ধরেন। দাবী তোলেন দেশে প্রতিষ্ঠা করতে হবে গণতন্ত্রের।

ছাত্রদের এই আন্দোলনে শ্রমিকরাও অংশ নেন। অনশনকারীদের পক্ষে চলে যায় গোটা দেশের জনমত। কমিউনিস্ট পার্টির শাসনে বিরক্ত সাধারণ মানুষও চাইছিলেন গণতন্ত্র। ভয় পায় কমিউনিস্ট সরকার।

বিক্ষোভ দমাতে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ৩ জুন রাতেই তিয়েনআনমান স্কয়ার ঘিরে ফেলে লাল ফৌজ। ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ির সামনে নিরীহ নাগরিকরা ছিলেন অসহায়। ৪ জুন মধ্যরাতে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলের বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গর্জে ওঠে কামান।

বিক্ষোভকারীরা পালাতে চাইলেও নিস্তার মেলেনি তাঁদের। হাজার-হাজার মানুষ গণতন্ত্রের জন্য আত্মবলিদানে বাধ্য হন। সেনা ট্যাঙ্ক আর ফৌজি বেয়নেটে লুণ্ঠিত হয় মানবাধিকার।

তবে তিয়েনআনমান স্কয়ারের বীভৎসতার পুরো ঘটনা আজও জানা যায়নি। কারণ এনিয়ে কোনও ধরনের আলোচনা নিষিদ্ধ সেখানে। সম্প্রতি অবশ্য চীন সরকারই টেনে এনেছে তিয়েনআনমান প্রসঙ্গ।

বিদেশ সফরকালে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়েই পেং বলেছেন, ‘তিয়েনআনমেন বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমনই চীনের দ্রুতগতির উন্নতির ভিত গড়ে দিয়েছে। চীনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয় এরপরই।’

চীনের সরকারী গণমাধ্যমেও ফলাও করে তিয়েনআনমান স্কয়ারের ‘সাফল্য’ প্রচারিত হচ্ছে এখন। নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই কমিউনিস্ট পার্টির।

বরং তাঁরা বলে বেড়াচ্ছেন, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে পারাতেই নাকি সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মতো পতন হয়নি তাঁদের।

আসলে সমাজতন্ত্রের মোড়কে আবদ্ধ চীন চিরকালই গণতন্ত্র ও মানবিকতবাদের বিরোধী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সেই পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন পাক-সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীনকে পাওয়া যায়নি সেই দলে। উল্টে পাকিস্তানি হানাদারদেরই তারা সমর্থন করেছিল।

বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষের হত্যাকারীদের প্রতি ছিলো চীনের প্রত্যক্ষ মদত। এখনও পাকিস্তানই চীনের প্রকৃত বন্ধু। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক আসলে পুরোটাই ব্যবসায়িক। তাই নিজেদের দেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলিমদের ওপর বর্বরোচিত ও অমানবিক অত্যাচার চালালেও বাংলাদেশের প্রতি নতুন করে দরদ দেখাতে শুরু করেছে।

২০১২ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে চীনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরার সম্ভাবনা হয়ে পড়েছে আরও অনিশ্চিত। আন্দোলনকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীদের মত প্রকাশ করার অধিকার আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

তিয়েনআনমান স্কয়ার আন্দোলনের দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে সেদিনের ছাত্র নেতা জৌ বলেন, ‘১৯৮৯-এ তিয়েনআনমান স্কয়ারের আন্দোলন থেকেই শুরু আমার পথচলার কাহিনী। সেদিনের আন্দোলনে ফুটে ওঠে চীনা জনগণের স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

প্রথমবারের মতো চীনের মানুষ তুলে ধরতে পেরেছিলেন মুক্তির জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা। আজও তারা সেই ভালোবাসাটাই মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন। তিন দশক পরেও আমি সেই গণতন্ত্রের কথা বলে চলেছি। তাই আজ আমি নির্বাসিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার সংগঠন হিউম্যানেটিরিয়ান চায়না রাজনৈতিক বন্দিদের নিয়ে কাজ করে। প্রতি বছরই ১০০-২০০ বন্দিকে সহযোগিতা করি আমরা।

কিন্তু রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা অনেক। আমরা সকলের কাছে পৌঁছাতে পারিনা। দিন দিন সংখ্যাটি দ্রুত বেড়ে চলেছে। গণতন্ত্রের কথা বললেই ভরা হচ্ছে জেলে। আমরা তাই আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইছি।’

জৌ মনে করেন, তিয়েনআনমান স্কয়ারের মতো কমিউনিস্টরা উহান নিয়েও একইরকম অমানবিক আচরণ করছে। তিনি বলেন, ‘করোনা নিয়ে মুখ খুললেই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। অতি সম্প্রতি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক খোলা চিঠি লেখায় তাঁকে ভরা হয়েছে জেলে। তাঁর অপরাধ তিনি চীন সরকারের করোনা-নীতির সমালোচনা করেছিলেন।

আমার কাছে তো মনে হচ্ছে তিয়েনআনমান স্কয়ারের সঙ্গে মিল আছে উহানের। দু-জায়গা নিয়েই মুখ খোলা বারণ। দমননীতিকে কাজে লাগিয়ে করোনাকে আজ মহামারিতে পরিণত করেছে সিসিপি। আর চীনের স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, ২৬ ফেব্রুয়ারিতেই তাঁরা নাকি চীনে করোনার ভ্যাক্সিন চালু করে ফেলেছেন! উদ্বেগজনক পরিস্থিতি।’

জৌয়ের মতে, ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের উচিত তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। সেই সঙ্গে তিনি চীনা অ্যাপস নিষিদ্ধ করা নিয়ে ভারতের পথ অনুসরণ করার জন্য আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনুরোধ করেন। তিয়েনআনমান আন্দোলনের এই নেতাকে বহু বছর জেল খাটতে হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী জৌ বর্তমানে নির্বাসনে রয়েছেন। দেশে ফিরতে চাইলেও চীন সরকার দিচ্ছেনা। তাঁর একটাই দাবি, চীনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে গণতন্ত্র। তাহলেই প্রকাশ্যে আসবে তিয়েনআনমান স্কয়ারের প্রকৃত ছবি।

উহান নিয়েও মানুষের সন্দেহ দূর হবে। জানা যাবে, কোভিডের আসল রহস্য। এর জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার ডাক দেন জৌ। তিনি মনে করেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই চীনে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান জরুরী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.