ডিপ্রেশনের কবলে তরুণসমাজ,মুক্তি কোথায়?

খুবি প্রতিনিধি: বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানার অজপাড়াগায়ের ছেলে  শিহাব উদ্দিন । নুন-আনতে পানতা ফুরোয় এমন একটি পরিবারের সংগ্রামী জীবনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাসকতক হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ।বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তির পর  গ্রাম্য পরিবেশে  সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছেলেটি   দেখেছে জীবনের নানামুখী রূপ। সবাই যখন চকচকে, দামী পোষাক পরে ক্লাসে আসে তখন তাকে চিন্তা করতে হয়  পরের বেলায় খাওয়ার টাকা কিংবা মেসভাড়া সে কোথায় পাবে ।ক্যাম্পাস থেকে মেস বেশ দূর হলেও  প্রায়শই হলের ক্যান্টিনে খেতে আসে। কোনো  সিনিয়রের সাথে দেখা হলে নিশ্চয় বিলটা  দিয়ে দিবে এই আশায়।

এমন নানাবিধ প্রতিকূলতায় জর্জরিত  শিহাব এক সময় মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ভাবনার পুরোটা জুড়ে বিস্তার করতে থাকে টিকে থাকার লড়াই আর হতাশা। ঘরে বসে ছক কষতে কষতে সে আজ ক্লান্ত।নতুন পরিবেশ আর  নতুন হাওয়াই গা মেলে মুক্ত বাতাসের স্বাদ নেয়ার অবকাশটুকু  আর হয়ে ওঠে না। ফ্যাকাশে মুখ আর ছিপছিপে শরীরের শরীরী ভাষা বলে দেয় বিচিত্র রঙয়ের দুনিয়ায়  সে কতটা অসহায়।

এমন অসহায়,আত্মকেন্দ্রিক আর মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত ছেলেমেয়ের সংখ্যা  বর্তমানে সমাজে নেহাত কম নয়,যাকে আমরা বলি ডিপ্রেশন । এক পর্যায়ে এরাই হয়তো বেছে নিচ্ছে  অসামাজিক কর্মকাণ্ড কিংবা  আত্নহত্যার মতো পথ।যা কখনই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।বরং তাকে ঘীরে তিলে তিলে একটি পরিবার যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তার সলিল সমাধি রচিত হয়।

এই ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের সংখ্যা যে তরুণ সমাজে বেশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এর মধ্যে আবার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের পরিমাণ বেশি।বয়স্কদের ক্ষেত্রে ঘটলেও তার বহিঃপ্রকাশ হয়তো খুব একটা ঘটে না।তাই আমরা দেখিও না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে। আবার আরেক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী।যাদের বয়স ১১ থেকে ২৫ এর মধ্যে।

দেখে নেয়া যাক তরুণদের মাঝে ডিপ্রেশনের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারনগুলো কি কি হতে পারে? প্রথমত,  প্রেমে বিচ্ছেদ।স্কুল কিংবা কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ের ডিপ্রেশনে ভোগার প্রধান কারন প্রেমে বিচ্ছেদ । দ্বিতীয়ত, আর্থিক অস্বচ্ছতা।  ‘A world where money talks’  এই বস্তুবাদ ও অর্থদাসত্বের সমাজে টাকা থাকলে বাঘের দুধ আর  না থাকলে পান্তার পানিও জোটে না। তৃতীয়ত, বেকারত্ব। অনার্স, মাস্টারস শেষ করা বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সৈকত ভাইকে দেখেছিলাম গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে। মাস শেষে মায়ের ডিম বিক্রির টাকা নেয়ার কোনো বয়সসীমা থাকে না ঠিকই।কিন্তু   সমাজের নোংরা লোকগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দিবে তুমি বেকার।

খুঁজলে হয়তো আরও অনেক কারন বেরিয়ে আসবে। তবে ডিপ্রেশনের সবচেয়ে বড় যে  কারন তা হলো আত্নকেন্দ্রীকতা। হলফ করে বলতে পারি, যে ছেলে বা মেয়ে  বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের সবার সাথে মিলেমিশে থাকে অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিক না। তার ওপর কখনও প্রেমে বিচ্ছেদ, আর্থিক অস্বচ্ছতা কিংবা বেকারত্বের অভিশাপ ভর করতে পারে না। বরং এসব সমস্যার উর্ধ্বে থেকেও আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার দরুণ ডিপ্রেশন ভর করেছে এমন উদাহরণ ঢের পাওয়া যাবে।

আর এই আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার পেছনে বড় নিয়ামক হলো প্রযুক্তি। প্রযুক্তি দিনকে দিন আমাদের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে ফেলছে।

আশার কথা, মানসিক স্বাস্থ্য তথা ডিপ্রেশন নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনের সখ্যা বাড়ছে। শুধু যে বাড়ছে তা নয়, কার্যকরী পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। এমনই একটি সংগঠন ‘মনের স্কুল’। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ-তরুণীর সমন্বয়ে  গঠিত এ সংগঠন  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মশালা পরিচালনা করে থাকে। যেখানে সুস্থ মানুষেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। শেখানো হয় কীভাবে তারা ডিপ্রেশড মানুষ নির্ণয় করবে এবং তা দূর করতে কি কি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ।

এধরনের সংগঠনের সংখ্যা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এজন্য  আমাদের উচিত সবাইকে সচেতন হওয়া এবং সচেতন করা। যে বন্ধু বা বান্ধবী সবার সাথে কম মেশে ।তার খোঁজ খবর নেয়া। প্রয়োজনে তাকে সঙ্গ দেয়া কিংবা সম্মিলিতভাবে হলেও সহযোগিতা করা। রবার্ট ব্রুসের গল্পের কথা  স্মরণ করিয়ে দেয়া, পরাজয় বরণই শেষ  কথা নয়। পক্ষান্তরে   দেশ ও জাতিকে কিছু দিয়ে সবার মাঝে বেঁচে থাকাতেই স্বার্থকতা। পরিশ্রম না করে ‘আমায় দিয়ে কিচ্ছু হবে না’ এই মানসিকতা থেকে দূরে থাকতে হবে। হতে হবে খোলা মনের অধিকারী তবেই মুক্তি।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুবি প্রতিনিধি শফিক ইসলাম।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.