জেলার সীমান্তজুড়ে চলছে রমরমা হুন্ডি ব্যবসা: প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্ত সিন্ডিকেট প্রধান আবু তালেব

 

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:  গত ৩ এপ্রিল ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকার শেষের পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছে, সারা দেশে ৬২০ চোরাকারবারি, মুদ্রা পাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চালানো হবে। এসব অপরাধীর মধ্যে চক্রের প্রধান বা মূল হোতা ৭৫ জন এবং বাকিরা সদস্য।

চক্রের মূল হোতা বা সদস্যদের মধ্যে আছেন কতিপয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংক কর্মকর্তা, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং ইমিগ্রেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী। অপরাধীরা এজেন্ট এবং সাব-এজেন্টের মাধ্যমে টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। ওই টাকার একটি বড় অংশ দিয়ে কেনা হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক।

আর এসব অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে চলে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অভিমত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে চোরাকারবারি, মুদ্রা পাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে। সেই তালিকা জমা পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকাটি দেয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সেটি যায় পুলিশ সদর দফতরে। এরপর তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে সারা দেশের পুলিশ সুপারদের কাছে চিঠি দেয়া হয়। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তাদের তালিকাও যুক্ত করে দেয়া হয়েছে চিঠিতে।

সারাদেশে ৭৫ জন গডফাদারদের মধ্যে রয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিন্ডিকেট প্রধান চোরাকারবারী, শীর্ষ কালোবাজারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ী জামায়াতের অর্থদাতা-আমদানিকারক আবু তালেব এর নাম। এছাড়াও তালিকায় রয়েছে জেলার আরও কিছু ব্যবসায়ীর নাম। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য রাষ্ট্রীয় তালিকা প্রকাশ প্রায় ২ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্ত সিন্ডিকেট প্রধান আবু তালেব।

গ্রেফতার হয়নি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই সিন্ডিকেট প্রধান চোরাকারবারী, শীর্ষ হুন্ডি ব্যবসায়ী ও জামায়াতের অর্থদাতা এবং অন্যতম পৃষ্ঠপোষকতা কারী-আমদানিকারক আবু তালেব। এ নিয়ে জনমনে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে, বেরিয়ে এসেছে আরও ভয়াবহ কিছু তথ্য।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় এখনো চলছে হুন্ডির রমরমা ব্যবসা। অবৈধ হুন্ডির ব্যবসার কারণে একদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ে গড়ে তুলছে অর্থের পাহাড়। অন্যদিকে, সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিবগঞ্জ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ২’শ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনেকেই হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন।

এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে কোটি কোটি টাকার লেনদেন। একাধীক সূত্র জানিয়েছে, হুন্ডি ব্যবসায় ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সংকেত। এ সংকেতগুলির মাধ্যমে ভারতে সিন্ডিকেটের সাথে লেনদেন হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। যারা টাকা অবৈধ পথে লেনদেন করে তাদের প্রায় বেশিরভাগই গরু ব্যাবসায়ী ও আমদানি রপ্তানিকারক।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সিন্ডিকেটের মূল হোতারা শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা বাজার, সাহাপাড়া বাজার, ঠুঠাপাড়া বাজার, বিনোদপুর খাসেরহাট বাজার, সোনামসজিদ স্থলবন্দর, তেলকুপি বাজার, বিনোদপুর বাখেরআলী বাজার, শ্যামপুর চামা বাজার, কানসাট বাজার, পাঁকা ইউনিয়নের বাবুপুর বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজার ও পয়েন্টে নির্বিঘ্নে চলাচ্ছে ভারতীয়দের সাথে কোটি কোটি টাকার লেনদেন।

পাচার হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যপক অর্থ ও গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলতে চাইলে তারা জানান, হুন্ডি ব্যবসায় ব্যাপক লাভ হওয়ার ফলে এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। তবে মুল নেতৃত্বে রয়েছেন হাতেগোনা কয়েকজন। শিবগঞ্জ উপজেলাতেই রয়েছে সীমান্ত এলাকার প্রায় ৪০ জন অবৈধ ব্যবসায়ী।

এসব ব্যবসায়ীরা হুন্ডি, জাল টাকার ব্যবসা, ফেন্সিডিল, অস্ত্র, হোরোইনসহ বিভিন্ন চোরচালান ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন। তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামের আমদানিকারক আবু তালেব। মুলতঃ তারই নেতৃত্বে প্রায় ২০ বছর যাবৎ পরিচালিত হয়ে আসছে এ হুন্ডি ব্যবসা।

এদিকে, সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে ভারতের ধূলিয়ান, বাখরাবাজ, মালদহ, কালিয়াচক, শশ্নানী এলাকাসহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশের কালোবাজারিদের মতই তারাও টাকার বদলে রুপী লেনদেন করে। নানা অজ্ঞাত কারনে বেড়েই চলেছে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, শিবগঞ্জ সীমান্ত এলাকাগুলোতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার হুন্ডি ব্যবসা হচ্ছে। সিন্ডিকেট প্রধানরা গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর রাজপ্রাসাদের মত আলিশান বাড়ি আর গাড়িসহ অন্যান্য সম্পদের পাহাড়। দেখা মিলেছে, জেলার শীর্ষ হুন্ডি ব্যবসায়ী আমদানিকারক আবু তালেব এর নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছে আনুমানিক ২ কোটি টাকা মূল্যের রাজকীয় বাড়ি।

এছাড়াও রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার ঘোড়ামারার বালিয়াপুকুরে ১০৫ নং এ আরো একটি আলিশান বাড়ি। রয়েছে সেভেন স্টার নামের ৩টি ইট ভাটা। শিবগঞ্জ উপজেলার উপর কয়লার দিয়াড়ে একটি, আটরশিয়ায় একটি ও নওগাঁ জেলায় একটিসহ মোট ৩টি। এখানেই শেষ নয় ট্রাক ও মাইক্রোসহ রয়েছে বেশ কয়েকটি যানবাহন।

সেই সাথে অবৈধ অর্থে কানসাট বাজারে গড়ে তুলেছে ‘পপুলা’র নামের একটি এনজিও। এছাড়াও তার ২ ছেলে জুয়েল রানা ও সোহেল রানার রয়েছে ভারতের সাথে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন বৈধ্য অবৈধ ব্যবসা। যা দিয়ে হাতাচ্ছেন মোটা অংকের অর্থ। আর এভাবেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন হুন্ডি ব্যবসায়ী আবু তালেব।

জনমনে প্রশ্ন, এসব অবৈধ ব্যবসা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি করার পরও বহাল তবিয়তে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব ব্যবসায়ীরা কিভাবে। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় তালিকায় থাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের চিহ্নিত চোরাকারবারীরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাদক বিরোধী অভিযানে সারা দেশে অনেক চোরাকারবারী আটক এবং বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হলেও সীমান্ত এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে এর প্রভাব খুব একটা চোখে পড়েনি।

অবশ্য জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেশ কিছু সাধারণ মাদকসেবী ও মাদক বিক্রেতাকে আটক, কারাদন্ড ও জরিমানা করা হয়েছে। তবে রাঘববোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই। এসব রাঘববোয়ালদের নিয়ন্ত্রণ বা কঠোর হাতে দমন না করতে পারলে মাদকের ছোবল থেকে তরুণ সমাজ বা জাতিকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

এব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার টি.এম মোজাহিদুল ইসলাম বিপিএম জানান, সীমান্ত এলাকায় যে হুন্ডি ব্যবসা চলছে, সেটা আমাদের পুলিশ বিভাগের সতর্ক দৃষ্টিতে রয়েছে। হুন্ডি ব্যবসা কোনভাবেই বৈধ নয়, এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের হাতেনাতে ধরতে চাই। এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সঠিক তথ্যের মাধ্যমে হাতেনাতে ধরার জন্য প্রক্রিয়া চলছে।

কম সময়ের মধ্যেই হুন্ডি ব্যবসায়ীদের হোতা এবং এ ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.