জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত সুন্দরবন, আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে মানুষ, ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতি

 

খুলনা ব্যুরো: ঘূর্ণিঝড় রিমালের অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে ডুবে গেছে সুন্দরবন। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে বনের করমজলসহ অনেক এলাকা। উপকূলীয় জেলা খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি বৃষ্টির সংগে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের আতঙ্কও। অনেকেই তাদের গবাদিপশু ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে শুরু করেছে। বন্ধ রাখা হয়েছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঘূর্ণিঝড় রিমাল এর ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৩০টি টিম শনিবার সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে খুলনা উপকূলে দমকা হাওয়া ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ১০নং মহাবিপদ সংকেত জারির পর আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫টি উপজেলার সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে এক লাখেরও বেশী মানুষ। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে।
উপকূলীয় জেলা গুলোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ এলাকা বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
রিমাল’এ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে খুলনা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় চালানো হচ্ছে সচেতনতামূলক প্রচারণা। খুলনা বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। রয়েছে স্পেশাল টিম। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব, ঘূর্ণিঝড় সময়কালীন এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সবে কাজ সমন্বয় করার জন্য খোলা হয়েছে বিভাগীয় মনিটরিং সেল। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টিম।
সার্বিকভাবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে ফায়ার সার্ভিস। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনসাধারণকে সচেতন, সতর্ক ও সাবধান করছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ফায়ার স্টেশনগুলো। উপকূলীয় এলাকাসমূহের সকল ফায়ার স্টেশনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে সতর্ক ডিউটিতে রাখা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতি ফায়ার স্টেশনে ফায়ারফাইটিং টিম, সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম, প্রাথমিক চিকিৎসাকারী দল এবং ওয়াটার রেসকিউ টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জামসহ অ্যাম্বুলেন্স, চেইন স’, হ্যান্ড স’, রোটারি রেসকিউ স’, স্প্রেডার, মেগাফোন, র‌্যামজ্যাক বা এয়ার লিফটিং ব্যাগ, ফাস্ট এইড বক্সসহ যাবতীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজসহ রাস্তাঘাট যান চলাচল উপযোগী করার কাজে ফায়ার সার্ভিস নিয়োজিত থাকবে। তাদের সাথে সহযোগিতা করবেন ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়াররা। এসব এলাকায় জীবন ও মালামাল সুরক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো কাজে দিবা-রাত্রি ২৪ ঘণ্টা ফায়ার সার্ভিসের সেবা গ্রহণ করা যাবে। সব আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রয়োজনে উপকূলবর্তী ফায়ার স্টেশনগুলোতেও সাধারণ জনগণ আশ্রয় নিতে পারবেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপপরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৩০টি টিম শনিবার সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করেছে। এরমধ্যে খুলনায় ১৪টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। যারমধ্যে একটি রিভার ফায়ার স্টেশন আছে। এছাড়া বাগেরহাটে ১০টি এবং সাতক্ষীরায় ৬টি ফায়ার স্টেশনের টিম কাজ করছেন। টিমের সদস্যরা মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি রেসকিউ, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে আনাসহ যাবতীয় কাজ করবে। জল ও স্থল উভয় পথে ফায়ার সার্ভিসের টিম এবং যাবতীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খুলনা সদরদপ্তরে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে ২০ সদস্যের স্পেশাল টিম। খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল।
তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিসের মনিটরিং সেল, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সারাক্ষণ সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত থাকবে। যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে সেবা গ্রহণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশন, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হটলাইন নম্বর ১৬১৬৩ অথবা খুলনা বিভাগীয় মনিটরিং সেল-এর জরুরি মোবাইল নম্বর ০১৭৩৩০৬২২০৯-এ ফোন করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া জরুরী প্রয়োজনে ১০২ এবং ৯৯৯ হটলাইনে কল করে তথ্য জানানো যাবে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ রক্ষায় প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উপকূলের মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তাদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। শনিবার রাতভর পরিশ্রমের পর রোববার সকাল থেকে দাকোপ ও কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ অংশ বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। বাঁশের বেড়া তৈরি করে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে অতি ভাঙন প্রবণ এলাকায়।
দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়দেব চক্রবর্তী জানান, ১০নং বিপদ সংকেত ঘোষণার পরই মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য মাইকিং শুরু হয়। বেলা দেড়টা পর্যন্ত উপজেলার ১৩০টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনবার্সন কর্মকর্তা আবদুল করিম জানান, খুলনার উপজেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এক লাখেরও বেশী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের শুকনা খাবারসহ আপদকালীন সাহায্য হয়েছে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় প্রতিটিতে দেড় লাখ নগদ টাকা এবং ১০ টন চাল পাঠানো হয়েছে। বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলায় নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ স্বেচ্ছাসেবকরা প্রস্তুত রয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে খুলনা জেলা প্রশাসন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬০৪টি আশ্রয় কেন্দ্র। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লা ও ৫ সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তত রয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষ থাকতে পারবে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় প্রস্তত রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি টিম। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সতর্ক থাকার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিপদ সংকেত জারি হলে তারা এলাকায় মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করবেন। শুকনো খাবার, ওষুধ, ঢেউটিন ও নগদ টাকা প্রস্তত রাখা হয়েছে। প্রস্তত রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বিটিসি নিউজকে জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে। কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.