ছায়া শ্রমিক : আমার মা

খুবি প্রতিনিধি: ঠিক এই মূহুর্তে যে মোবাইলে আমার অব্যক্ত ভালবাসার মানুষটির কথা লিখছি সেই মোবাইলটাও তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমানো টাকায় কেনা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ৩ বছর অতিবাহিত করছি অথচ এখনও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা হলো না।তাই প্রতি মাসের শেষ ৪/৫ দিন চলার জন্য তার সরনাপন্ন হতে হয়।সে আর কেউ  নন সে  আমার মা।

৫ ভাইয়ের ২ ভাই বিদেশে থাকে।  মায়ের চিকিৎসা কিংবা হাতখরচ বাবদ ভাইয়েরা প্রায়ই টাকা দেয়। তাদের ইচ্ছা মায়ের শরীর ভালো থাকুক।কিন্তু ছোটছেলে মানে আমার জুড়ে বসায় সে আশার সিংহভাগ নিরাশা হয়ে উঠেছে।

মাঝে মাঝে নিজের ওপর খুব রাগ হয়। তবু টাকাটা চাইতেই হয়।কেননা ফাঁকা মানিব্যাগ সমস্ত  আবেগের উর্ধ্বে। ফোনে কথা বলার  শেষ পর্যায়ে  যখন ইতস্তত গলায় কিছু বলার চেষ্টা করি তখন কিভাবে যেন মা বুঝে যায় আমার টাকা লাগবে। কন্ঠস্বর খানিকটা উচিয়ে বলে কত টাকা লাগবে তোর? বেশি প্রয়োজন হলেও কখনও পাঁচশোর বেশি বলি না।মায়ের প্রতি আমার সুবিচার বোধহয় এতটুকুই।

ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ আত্নকেন্দ্রীক স্বভাবের। আমার আব্বাকেও দেখেছি প্রয়োজনের বাইরে খুব কম কথা বলেন।তবে খুব শান্ত মেজাজের।তারই যেহেতু ছেলে তাই প্রয়োজনের বাইরে ভালবাসা কিংবা আবেগ দিয়ে কখনও বাবা-মা’র সাথে কথা বলেছি কিনা মনে পড়ে না।প্রতিবার খুলনা থেকে যখন বাড়ি যায়,মায়ের পরিকল্পনা করা থাকে যে দু’দিন থাকবো কী কী খাবার আমায় খাওয়াবে। উঠোনের ছোট গাছটায় যে ক’টা পেয়ারা হয় তাতে রীতিমতো নিষেধাজ্ঞা জারি করা । অথচ এই মাকে বিদায় বেলা জড়িয়ে ধরে তৃপ্তির আলিঙ্গন কখনও   করা হয়নি।যখন সিনেমাগুলোতে মা-ছেলের আদুরে দৃশ্যগুলো দেখি,অজান্তে চোখের কোণে পানি চলে আসে। আমার  সিনেম্যাটিক প্রস্থান  আর হয়ে ওঠে না।

তবে সিনেম্যাটিক কায়দা রপ্ত না করার সুবিধাও আমি পেয়েছি।বুঝিয়ে বলা দরকার। লক্ষ্য করে থাকবেন,সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে বিশেষ করে ভারতীয় আর্ট ফিল্মগুলোতে যে বিষয়টি  তুলে ধরা হয় তা হলো মায়েরা  ছোটবেলা হতে ছেলেমেয়েকে পড়াশুনায় সিরিয়াস করানোর চেষ্টা করছে এবং তাদের লক্ষ্যও (Goal)  ঠিক করে দিচ্ছে ।তোমাকে ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। অন্যথায় তুমি সমৃদ্ধ, সিকিউরড ভবিষ্যত পাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি  ।এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় ওই ছেলেটি অথবা মেয়েটি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে  আত্নহত্যার পথ বেঁছে নেয় নতুবা তার পছন্দসই পথেই সফলতা অর্জন করে এবং সিনেমার শেষ দৃশ্যে বাবা-মা তাদের  সুমতি ফিরে পায়।

এক্ষেত্রে আমি আমার মাকে আদর্শ  বলতে চাই।তার সুমতি সিনেমার প্রথম দৃশ্য হতেই।  ১৫ বছরের ছাত্রজীবনে পড়াশোনায় আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছি।যখন কিন্ডারগার্টেনে যেতাম,মা সাজিয়ে গুছিয়ে স্কুলে পাঠিয়েই নিশ্চিন্ত থাকতো।কখনও হোমওয়ার্ক কিংবা রেজাল্ট খারাপের জন্যে মাথা ঘামায়নি।ঘামাবেও বা কি করে? অনেক কষ্টে নাম লেখাটা শিখিয়েছিলাম।যেটুক বলার  স্কুলে গিয়ে স্যারদের বলতেন। আমায় কখনও বলেনি তোমায় ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তবে এখন মাঝে মাঝে মা শুধু এতটুক বলে_পড়াশোনা শেষ হতে আর কতদিন?  বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই । তাই হয়তো মনের ইচ্ছে ছোট ছেলের উপার্জনের টাকায় কেনা একটা শাড়ি সে পরবে। এতদিন ছেলেকে   স্বাধীনতা দেয়া  মায়ের সময় হয়তো   নিজেকে পরাধীন করে ছেলের কোলে মাথা রাখার !  সেদিনের অপেক্ষায় মায়ের প্রতি অব্যক্ত ভালবাসাটুকু জমিয়ে রাখলাম। একদিন রঙিন কাগজে মোড়ানো শাড়িটা ধরিয়ে ঠিক বলে দেবো মা তোমায় অনেক ভালবাসি।

আজ বিশ্ব নারী দিবসে  পৃথিবীর সকল মা এবং মা জাতির প্রতি জানাই প্রাণঢালা ভালবাসা।সবার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুবি প্রতিনিধি শফিক ইসলাম।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.