চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি রপ্তানী হচ্ছে ১২টি দেশে


নাটোর প্রতিনিধি: উত্তরাঞ্চলের নাটোর জেলার চলনবিলে মিঠা পানির শুটকির চাহিদা বাড়ছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের প্রায় ১২ টি দেশে রপ্তানী হচ্ছে এ শুটকি। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদাকে সামনে রেখে অনেক ব্যবসায়ী আকৃষ্ট হচ্ছেন। দাম চড়া হলেও বাড়ছে চাহিদা।
মৌসুমের এক মাস বাকি থাকতেই গত বছরের তুলনায় এ বছর শুটকির উৎপাদন বেড়েছে ৯০ মেট্রিক টন। মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে শুটকির উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে নিংগইন নামক স্থান বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে শুঁটকির অস্থায়ী চাতাল। সেখানে মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের মাছের শুঁটকি উৎপাদন করতে দেখা যায়।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিংড়ায় চারটি চাতাল ও ৩০টি এলাকায় বিলের মাছ সংগ্রহ করে শুটকি তৈরী করেন ৩১৩ জন। ২০২০ সালে সিংড়ায় ৩১৯ মেট্রিক ট্রন শুটকি উৎপাদন হয়। চলতি বছর জানুয়ারী পর্যন্ত উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪১২ মেট্রিক ট্রন।
নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ধারে নিংগইন এলাকায় গড়ে উঠেছে চলনবিলের সর্বববৃহৎ শুটকি চাতাল। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই চাতালে কাজ করছেন ২৫ জন শ্রমিক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ কাটা, বাছাই, ধোয়া, রোদে শুকানো, তোলার কাজে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করেন।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ব্যবসায়ী নান্নু মিয়া বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, চলনবিলের শুঁটকি আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ ১০-১২টি দেশে রপ্তানী হচ্ছে। চলতি মৌসুমে এখানে ১৫০-২০০ মেট্রিক টন শুঁটকি তৈরীর সম্ভাবনা রয়েছে। যার আর্থিক মূল্য হবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫০টি অস্থায়ী চাতাল বসেছে। এসব চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, খলশে, চেলা, টেংরা, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, বাইমসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে।
মানভেদে এই শুঁটকি মাছকে এ,বি,সি গ্রেডে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে এ গ্রেডের বা ভালো মানের শুঁটকি রপ্তানি হয় আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ ১০-১২টি দেশে। মূলত ঢাকার ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরেই এখানকার শুঁটকি বিদেশে যায়।
আর বি,সি গ্রেডের শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুঁটকির আকারভেদে দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের মাছের শুঁটকি প্রতিমণ ১৬ থেকে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকি ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ।
শুটকি ব্যবসায়ীরা আরো জানান, চলনবিলে এখন থইথই পানি নেই। এখন প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ফলে বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে চলছে ধান কাটা কিংবা অন্য ফসল রোপণের কাজ।
তবে বিলের নিচু জায়গা বা বড় খালগুলো থেকে মাছ ধরা হচ্ছে। মাছের ভরা মৌসুমে ভেসাল, সুতিজাল, বেড়জাল, পলো দিয়ে মাছ ধরছেন জেলেরা। আর পাশেই বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয় শুঁটকির অস্থায়ী চাতাল। সেখানে মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের মাছের শুঁটকি উৎপাদিত হয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে কম দামে বিলের মাছ কিনে বাইরের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে। যেসব মাছ অবিক্রিত থাকে সেগুলো কিনে নেন শুটকি উৎপাদকরা।
অক্টোবর থেকে পানি কমতে শুরু করায় শুকিয়ে যায় খাল ও বিলগুলো। তখন হাত দিয়েই ধরা যায় টাকি, শোল, পাতাসি, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, গজার, মাগুর, কই চিংড়িসহ হরেক প্রজাতির দেশি মাছ। এসব মাছের কিছুটা বিক্রি হয় বিল সংলগ্ন হাট-বাজারগুলোতে আর কিছুটা সরাসরি আসে শুটকি চাতালে।
জেলার নিংগইন শুটকি চাতালে গিয়ে দেখা যায়, নারী শ্রমিকরা বিলের তাজা টাকি মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ধোয়ার পর লবণ মাখিয়ে মাচায় মেলে দিচ্ছেন। সকালে রোদে ভেজা মাছগুলোও এপিঠ-ওপিঠ উল্টে রাখছেন। পুরুষ শ্রমিকরা চাতাল ঘরে রাখা শুটকি আবারো রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। রাস্তার পাশে মাচার উপর শুটকির পসরা সাজিয়ে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ। মহাসড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে অনেকেই কিনে নিচ্ছেন শুটকি।
জানা যায়, শৈল মাছের শুটকির কেজি আকারভেদে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা, পুঁটি ৩০০ টাকা, টাকি ৩৫০ টাকা, চেলা ৬০০ টাকা, পাতাসি ৮০০ টাকা, গুচি আকারভেদে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা, কাঁচকি ৭০০ টাকা, বোয়াল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চাপিলা ৪০০ টাকা, মলা ৫০০ টাকা ও বাইম ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
তবে বছরের শুরুতে প্রতিকেজি ১ হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এ বছর মাছের স্বল্পতার কারণে বিলের চিংড়ি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি চিংড়ি মাছ খুবই সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে নেয়ার পর আর অপেক্ষা করতে হয় না। শুটকি তৈরির জন্য চাতাল পর্যন্ত চিংড়ি আর আসে না।
চলনবিল থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ শুটকি বিক্রি হয়। তবে সিংড়ার শুটকিগুলো চলে যায় নীলফামারীর সৈয়দপুরে। এছাড়া রাজধানী, চট্টোগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর, কক্সবাজার, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এখানে এসে শুঁটকি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন।
ঢাকার আশুলিয়া থেকে শুটকি কিনতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, শুঁটকি ব্যবসায় লাভ যেমন আছে, তেমন লোকসানও আছে। ভালোভাবে মাছ শুকানো না হলে পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভালো মানের শুঁটকির কদর বেশি। ঢাকার বড় ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে রপ্তানি করেন।
শুটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে বর্ষায় বিলের মাছ ধরে রেখে শীতের শুরুতে বা প্রয়োজন মাফিক শুটকি তৈরি করা সম্ভব। শুটকির মৌসুমে পর্যাপ্ত শুটকি থাকায় দাম বাড়ে না। কিন্ত বছরের অন্য সময় চাহিদা বেশি থাকলেও সরবরাহ করা যায় না। সারা বছর শুটকি তৈরি সম্ভব হলে আশানুরূপ দামে সারা বছরই তা বিক্রি করা যাবে।
শুটকি চাতাল মালিক নাসির উদ্দীন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, পর্যাপ্ত উৎপাদন হলেও এখনো স্থানীয় বাজার সৃষ্টি হয়নি। সড়কের ধারে চাতাল থেকে শুটকি কিনতে পারেন না অনেকেই। ফলে বিক্রি কমে গেলে শুটকিগুলো কখনো কখনো জেলার বাইরের মোকামগুলোতে নিয়ে যেতে অনেক বেশি খরচ পড়ে। তখন লাভের পরিমাণ কমে যায়।
আরেক ব্যবসায়ী জমির উদ্দীন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের শুটকির মান ভালো। বিক্রিও ভালো। কিন্ত সারাবছর আমরা শুটকি বিক্রি করতে পারতাম। যদি একটা মাছ রাখার জায়গা থাকতো। দেশে শুটকির চাহিদা মেটাতে সিংড়ায় মৎস্য সংরক্ষণাগার তৈরি জরুরি।
ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, বিলের মাছ যদি সংরক্ষণ করা যেতো- তবে শুটকি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটতো সিংড়া থেকেই। বর্ষাকালে কম দামে যেসব মাছ বিক্রি হয়, সেগুলো শীতকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারলে বৃহৎ এ মৎস্য সম্ভার প্রক্রিয়াজাত মাছ উৎপাদনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতো।
নাটোরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, চলনবিলের শুঁটকির সুনাম ও চাহিদা দুটোই রয়েছে। ফলে আমরা এই শুঁটকির মান বৃদ্ধির জন্য চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছি। আশা করি, প্রক্রিয়াটি শুরু হলে এই অঞ্চলের শুঁটকি ব্যবসা আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.