‘গণহত্যা’ প্রশ্নে বাইডেনের কাছে অসহায় এরদোয়ান

(‘গণহত্যা’ প্রশ্নে বাইডেনের কাছে অসহায় এরদোয়ান–ছবি: সংগৃহীত)
বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: উসমানীয় সাম্রাজ্যের আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ আখ্যায়িত করার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব একটা দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে না তুরস্ক।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণে এর কারণ হিসেবে বলছে, এখন সংঘাতে গেলে দেশটির নাজুক অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ও মার্কিন মিত্র আরব দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের যে আশা জেগেছে, তাও ভেঙে যেতে পারে।

শত বছর আগের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিবৃতির কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

তিনি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের উচিত ‘আয়নায় নিজ চেহারা দেখা’। ঔপনিবেশিক দখলদারেরা আদিবাসী আমেরিকানদের কচুকাটা করে বসতি স্থাপন করেছে।

সাধারণত যুদ্ধংদেহী তুর্কি নেতা এরদোয়ান—দেশে জনসমর্থন অর্জনে যিনি প্রায়ই বিদেশে বিবাদে জড়ান—এবার ভেঙেপড়া অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতেই বেশি জোর দিচ্ছেন। ২০২৩ সালে তার কাঙ্ক্ষিত পুনর্নির্বাচনের জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপকার্থে তার জবাব ছিল সংযমী। তিনি বাস্তবিক কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেননি। শনিবার বাইডেনের ঐতিহাসিক ঘোষণার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে কেবল একবার কথা বলেছেন।

টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বাইডেনের মন্তব্যকে ভিত্তিহীন, অন্যায় ও অসত্য বলে সমালোচনা করেন এরদোয়ান।

বাইডেনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আগামী জুনে এরদোয়ানের সঙ্গে তার বৈঠক হতে যাচ্ছে। তখন নতুন সম্পর্ক শুরুর প্রতি জোর দেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।

গণহত্যার স্বীকৃতিতে ক্ষোভ ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে বড় ধরনের দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক ক্ষতি—এই দুইয়ের মাঝের এক নাজুক পথ দিয়ে এগোতে হচ্ছে এরদোয়ানকে। বাইডেনের বিবৃতি নিয়ে তার নরম সুরে এমন কিছুরই প্রতিফলন ঘটছে।

গত বছরের শেষ দিক থেকে পশ্চিমা ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে চেষ্টা করছে তুরস্ক।

এর আগে কয়েক বছর ধরে সামরিক হস্তক্ষেপ ও কঠোর পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে দেশটি। এতে আংকারার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একঘরে হয়ে পড়েছে তুরস্ক।

আংকারার রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় ও সিরীয় কুর্দিশ যোদ্ধাদের প্রতি মার্কিন সমর্থন নিয়ে দুই ন্যাটোমিত্রের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে আগে থেকেই। তুরস্কের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে কুর্দিরা।

যদিও এরদোয়ানের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাদের মধ্যে নিয়মিত আলাপ হতো। বিপরীতে এরদোয়ানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন বাইডেন।

তুরস্কের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও তার মার্কিন প্রশাসন সমালোচনামুখর।

ক্ষমতাগ্রহণের তিন মাস পর গত শুক্রবার এরদোয়ানের সঙ্গে প্রথম কথা বলেন বাইডেন। গণহত্যার ঘোষণা নিয়ে এরদোয়ানকে আগাম জানাতেই ফোন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

দুই নেতার আলাপ সম্পর্কে জানেন এমন এক তুর্কিশ কর্মকর্তা বলেন, নিশ্চিতভাবেই এটা সন্তোষজনক কিছু ছিল না। ক্ষমতার প্রথম বছরেই এই পদক্ষেপ নিয়ে সম্পর্ককে আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন বাইডেন।

আবার একই সময়ে ওই ফোনকল ভবিষ্যতে দুই ন্যাটো অংশীদারের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সম্পর্ক সামনের দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তারা বর্তমান পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তুরস্কের আরও দুই কর্মকর্তা বলেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিতর্ক বাড়াতে চাচ্ছে না তুরস্ক। অন্তত এই সময়ে এসে তারা কলহ এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে।

এরদোয়ানের মুখপাত্র ও উপদেষ্টা ইব্রাহীম কালিন বলেন, আসছে মাসগুলোতে বিভিন্নভাবে তারা বাইডেনের বিবৃতির জবাব দেবেন।

আঠারো বছর ক্ষমতায় থাকার পর এরদোয়ানের ইসলামপন্থী দল একে পার্টির জনসমর্থনে ভাটা চলছে। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তেজ কমে গেছে এবং ব্যাপকভাবে করোনা মহামারি হানা দিয়েছে।

আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকীতে ২০২৩ সালের নির্বাচনেও ক্ষমতায় আসতে মরিয়া এরদোয়ান। দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির ওপরই যা নির্ভর করছে।

বিরোধী দলগুলো বলছে, করোনা মোকাবিলায় সরকারের অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এছাড়া লিরার ক্ষতি এড়াতে ১২ হাজার কোটি ডলারের বিদেশি মুদ্রা বিক্রি করে দেওয়া ভুল ছিল।

মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী লিয়া পার্টির প্রধান মেরাল আকসেনার বলেন, বাইডেনের বিবৃতিতে দেখা গেছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের যথাযথ জবাব দেওয়ার পরিস্থিতিতে নেই এরদোয়ানের। স্বভাবের বাইরে গিয়ে তুর্কিশ নেতার নতি স্বীকার নিয়ে উপহাস করা হয়েছে।

বুধবার দলীয় সদস্যদের সামনে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, এতদিন এরদোয়ানকে যারা বিরক্ত করতেন, তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলায় গর্ব করতেন। কিন্তু এখন তিনি বেশ বিনয়ী হয়ে গেছেন।

ডলারের বিরুদ্ধে লিরার কেবল বড় ধরনের পতনই হয়নি, করোনার সংক্রমণও বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। সব মিলিয়ে এখন বড় ধরনের ক্ষতি পাশ কাটিয়ে যেতে চাচ্ছেন এরদোয়ান।

মার্কিন মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মিসর ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ চাচ্ছে আংকারা।

এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, মহামারিতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আমরা পদক্ষেপ নেব। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, উপসাগরীয় দেশ ও অন্যান্য সমস্যাগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের আভাস দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। আমরাও সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করছি।

আগামী জুনে দুই প্রেসিডেন্টের বৈঠক হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ নীতি অবলম্বন করার কথা জানালেন ওই কর্মকর্তা।

ইস্তানবুলভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর ইকনোমিক্স অ্যান্ড ফরেন পুলিসি স্টাডিজের প্রধান সিনান উলগেন বলেন, তুর্কি-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নে ওই আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন কড়া প্রতিবাদ না-জানানোর অর্থ এই নয় যে ভবিষ্যতেও এমন থাকবে।

এছাড়া সংঘাতমুখী পররাষ্ট্রনীতি এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে আংকারা। কারণ এতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, অর্থনীতির ওপর আঘাত আসবে।

সিনান উলগেন বলেন, এটা বড় পরিবর্তনের শুরু। আসছে দিনগুলোতে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় আঘাত আসতে পারে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.