খুলনায় সিপিবি’র মেয়র প্রার্থীর ১৭ দফা নির্বাচনী ইস্তেহার ঘোষণা

 

খুলনা ব্যুরো : খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনোনীত, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণতান্ত্রিক বামমোর্চা সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু কাস্তে মার্কার নির্বাচনী ইস্তেহার ঘোষণা করেছেন। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় সিপিবি জেলা ও নগর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী নিজেই ঘোষণা করেন এ ইশতেহার।

সিপিবি নগর সভাপতি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক এইচ এম শাহাদৎ-এর সভাপতিত্বে এবং নগর সহ-সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব এ্যাড. মোঃ বাবুল হাওলাদারের সঞ্চালনায় মেয়রপ্রার্থী মিজানুর রহমান বাবুর নির্বাচনী ইস্তেহার ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সিপিবি’র কেন্দ্রীয় সদস্য ও খুলনা জেলা সভাপতি ডাঃ মনোজ দাশ, কেন্দ্রীয় সদস্য এস এ রশিদ, বাসদ খুলনা জেলা সমন্বয়কারী জনার্দন দত্ত নাণ্টু, সিপিবি-নারীসেল জেলা সমন্বয়কারী সুতপা বেদজ্ঞ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ নেতা কাজী দেলোয়ার হোসেন, সিপিবি নেতা ফরহাদ নাজিম, নিতাই পাল, কিংশুক রায়, শ্যামল রায়, নীরজ রায়, সরোজ দাশ পিণ্টু, যুব ইউনিয়ন নেতা এস এম নূরুল আমিন, জয়ন্ত মুখার্জী, খেলাঘর সংগঠক মাইনুল ইসলাম সাকিব প্রমুখ।

সিপিবি মেয়রপ্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু তাঁর ১৭ দফা নির্বাচনী ইস্তেহারে উল্লেখ করেন, তিনি স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত সিটি কর্পোরেশন গড়ে তোলা, জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নাগরিক পরামর্শ কমিটি গঠন, বন্ধ কলকারখানা চালু ও হকার পুনর্বাসনে উদ্যোগ গ্রহণ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা, পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ কমিটি গঠন ও নদী-জলাশয়-পুকুর পুনরুদ্ধার-সংস্কার ও সংরক্ষণ, স্বাস্থ্য পরিসেবা ও চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধিতে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট্য হাসপাতাল তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ, দরিদ্র-বান্ধব আবাসন, সুপেয় পানি-বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন-স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সড়ক সংষ্কার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অপরাধ-সন্ত্রাস-মাদকমুক্ত পরিবেশ তৈরি, নারী সমাজের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশ ও বিনোদনের জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি, সিটি কর্পোরেশনের নতুন নতুন আয়ের উৎস সৃষ্টি এবং সুন্দরবন রক্ষায় সম্ভবপর যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করা হবে।

বাবুর ১৭ দফা নির্বাচনী ইস্তেহার ঃ

১। স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা: খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে জবাবদিহিমূলক স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘সিটি গভর্ণমেন্ট ব্যবস্থা ’ প্রবর্তন এবং সকল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ধারা বিকাশের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা হবে।

২। অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত সিটি কর্পোরেশন: আমলাতান্ত্রিকতা ও দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ সিটি কর্পোরেশন গড়ে তোলার মাধ্যমে কর্পোরেশনকে প্রকৃত অর্থেই ‘নাগরিক সেবা কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

৩। জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ: কর্পোরেশন পরিচালনায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য ‘নাগরিক পরামর্শ কমিটি’ গঠন করা। প্রতি ছয়মাস অন্তর মেয়র ও কাউন্সিলরগণ তাদের কর্মকান্ডের স্বচ্ছতার জন্য গণশুনানির মুখোমুখি হবেন।

৪। বন্ধ কল-কারখানা চালু ও হকার পূনর্বাসন: বন্ধ মিল-কল-কারখানা চালু ও আধুনিকীকরণ করার জন্য নাগরিকদের সাথে নিয়ে কার্যকর সংলাপ ও আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। সুপরিকল্পিত পূর্নবাসন ছাড়া কোন হকার উচ্ছেদ করা হবে না।

৫। কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি: নগরীর বেকার মানুষের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা প্রসারিত করতে সিটি কর্পোরেশনের বাজেটে পরিকল্পিত বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। কুটিরশিল্প গড়ে তোলা ও পণ্য বাজারজাতকরণের বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করার জন্য নগরীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে ওয়াই-ফাই জোনের আওতায় আনাসহ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য বহুমুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। তৃতীয় লিঙ্গ (হিজরা)দের অধিকার ও মর্যাদা দিয়ে তাদের কর্মক্ষম করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৬। শিক্ষা ও সংস্কৃতি: শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বসবাসস্থলের কাছে কেসিসি পরিচালিত উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তির ব্যবস্থা করা হবে। জনগণের সকল সৃজনশীল সাংস্কৃতিক উদ্যোগকে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মুক্ত মঞ্চ ও মিলনায়তন নির্মাণ করা হবে। খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত মাঠ তৈরি ও বিদ্যমান মাঠগুলি সংস্কার করা হবে।

৭। প্রকৃতি ও পরিবেশ : কর্পোরেশনের আওতাধীন একটি প্রাকৃতিক জলাশয়ও আর নতুন করে ভরাট করা হবে না। ময়ুর নদীর দখলকৃত অংশ পুনরুদ্ধার করে প্রাকৃতিক প্রবাহ নিশ্চিত করা, খাল ও জলাশয়সমূহ দখল ও দূষনমুক্ত করা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন রোধ করা হবে। বায়ু ও শব্দদূষনসহ সব ধরণের দূষন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্পোরেশনের উদ্যোগে ‘পরিবেশ কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে নাগরিক উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হবে।

৮। স্বাস্থ্য পরিষেবা ও চিকিৎসা: কর্পোরেশনের নিজস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নুতন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শারীরিক, শ্রবণ, বাক, দৃষ্টি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ‘মানষিক চিকিৎসা কেন্দ্র’ তৈরি করা। সিটি কর্পোরেশনের পরিচালনায় পাঁচশ বেডের একটি হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে।

৯। দরিদ্রবান্ধব আবাসন: দরিদ্র ও শ্রমজীবী নগরবাসীর জন্য স্বল্পব্যয়ে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। স্বল্প আয়ের বসতি(বস্তি)তে নাগরিক জীবনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা করা হবে।
১০। সুপেয় পানি, বর্জ্য ও পয়নিস্কাশন, স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা: প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুপেয় পানির নিশ্চয়তা বিধান করা সহ যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেন ও খালগুলিকে দখলমুক্ত করা, বর্জ্য ও পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হবে। নগরীতে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হবে। কেডিএ, সওজ, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, ফায়ার ব্রিগেড ও বিটিসিএলকে সমন্বিত কাজের অওতায় আনা হবে।

১১। সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার, যানজট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: সড়ক-মহাসড়কের প্রয়োজনীয় সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জনপথ ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও রুট সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নগরীতে চাহিদা অনুযায়ী পাবলিক বাস এর ব্যবস্থা করা হবে। গণপরিবহনে ছাত্রদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’, প্রতিবন্ধী ও চলাচলে অক্ষম সিনিয়র নাগরিকদের জন্য ‘ভাড়া মুক্ত’ চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বিবেচনায় নিয়ে যন্ত্রচালিত রিকসা ও ইজিবাইক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে নগরবাসীরসাথে আলোচনা সাপেক্ষে সুশৃংখল ব্যবস্থা গড়ে তুলে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে।

১২। আপরধ-সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত পরিবেশ: চুরি-ডাকাতি-হাইজ্যাক-খুন-রাহাজানি, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার সহ নানাবিধ অপরাধমূলক কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করে ‘সামাজিক নিরাপত্তাবলয়’ গড়ে তোলা হবে।

১৩। নারী সমাজ: নারী সমাজের উপরে পরিচালিত নানা অন্যায়-অত্যাচার ও বৈষম্য দূর করে সর্বক্ষেত্রে তাদের সমান অংশগ্রহণ, সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়া হবে। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হবে। কর্মজীবী নারীদের শিশু সন্তানদের জন্য কেসিসির উদ্যোগ ডে কেয়ার সেন্টার চালু করা হবে।

১৪। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা রোধ ও সকলের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করতে সাধ্যমত সকল ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কবরস্থান ও শশ্মানঘাটের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১৫। শিশুÑকিশোর: শিশু-কিশোরদের স্বার্থরক্ষা, তাদের বহুমুখী প্রতিভা বিকাশ ও বিনোদনের জন্য উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশ ও কাঠামো গড়ে তোলা হবে। আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দেয়া।

১৬। নিজস্ব নতুন আয়ের উৎস ও অন্যান্য: খুলনা নগরীর উন্নয়ন অব্যহত রাখার জন্য কেসিসি এলাকার মধ্যে নতুন আয়ের উৎস সৃষ্টি করা হবে। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় নগরবাসীকে ‘সর্বোচ্চ সংখ্যায় ও সর্বনি¤œ ট্যাক্সের’ আওতায় আনা হবে। বাজার মনিটরিং সেল সক্রিয় করা হবে।

১৭। সুন্দরবন রক্ষা: খুলনা মহানগরসহ এ অঞ্চলের ‘প্রাকৃতিক নিরাপত্তা ঢাল’ সুন্দরবন রক্ষায় সম্ভবমত সবধরণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
আমরা আশা করি বর্তমান লুটেরা বুর্জোয়া ধারার বিপরীতে আমাদের গণমুখী ও প্রগতিশীল কর্মসূচির পক্ষে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের সমর্থন প্রদান করবেন। আমাদের মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হলে জনগণের পরামর্শ ও অব্যহত সমর্থনের ভিত্তিতে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.