“কালো বউয়ের গল্প”

নোয়াখালী প্রতিনিধি:

## ১ম পর্ব ##

আমি ছাড়াও আমার পরিবারে আছে তিন বোন। একজনকে বিয়ে দিলাম শশুর বাড়িতে থাকে, আর দুজন কলিজার টুকরা চতূর্থ শ্রেনীতে পড়ে। আমার পরিবারটা খুবই সুখি।
মা আমাদের সবার দুঃখ প্রকাশের জায়গা,

বাবা একটু তেজি মানুষ। মা মাঝে মাঝে বলতেন তোর বাবা হলো নারিকেলের মতো উপরের চোগলা যতই শক্ত হোক ভিতর টা খুবই নরম, সবার জন্য ধরদ আছে ঠিকই, উপরে প্রকাশ করে না।

যাই হোক আমি আমার পড়া লিখা শেষ করার জন্য মাইজদীতে থাকি, এদিকে বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা করলেন। এবং তিনি পাত্রী ও ঠিক করে পেললেন, পাত্রী তার বাল্য কালের বন্ধু শফিক চাচার মেয়ে, সাহারা।

হঠাৎ একদিন ফোন বেজে উঠলো, আমি গোসল খানা থেকে তড়িগড়ি করে এসে দেখি বাবার নাম্বার,রিসিভ করলাম।

আমিঃ  আচ্ছালামুয়ালাইকুম, বাবা কেমন আছেন? আম্মা,শাখী,সুখী তারা কেমন আছে?

বাবাঃ তারা খুব ভালো আছে বাবা,তুমি কেমন আছো? তোমার পড়ালিখা কেমন চলছে?

আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ!

বাবাঃ তুমি একটু দুই একদিনের মধ্যে বাড়িতে আসতে হবে। আসতে পারবা তো?

আমিঃ মনে মনে ভাবছি কি বলবো? কলেজ থেকে ছুটি পাই কি না জানিনা,
বাবা যে রকম তেজি মানুষ না ও করতে পারবো না। তাই বললাম আচ্ছা আসবো বাবা,
ভয়ে ভয়ে বাবাকে বললাম কেন বাবা এত তাড়াহুড়ো করে আসবো?

বাবাঃ বাবার কন্ঠ আজকে একটু নরম মনে হচ্ছে, বললো তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

আমিঃ কি সারপ্রাইজ?

বাবাঃ এখন বললেন তো ঐটা আর সারপ্রাইজ থাকবে না।ঠিক আছে বাড়িতে এলে দেখবি,এখন রাখি ভালো থাকিস।

৩দিন পর কলেজ থেকে অনেক কষ্টে ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসলাম মনে অনেক আনন্দ নিয়ে বাড়িতে আসলাম,বাবা সারপ্রাইজ দিবে বলে।

কিন্তু বাড়িতে এসে শুনি শফিক চাচার মেয়ে সাহারার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
কারন আমি জানি সাহারা কালো কুচকুচে একটা মেয়ে।

বাবা বললো আগামী শুক্রবার তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছি।আমিতো ভিতরে রেগে আছি,
কিন্তু বাবা যেই তেজি কিছু বলতে ও পারছি না,কারন বাবা ছিলেন এক কথার মানুষ মরে গেলেও তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেনা।
যাই হোক শুক্রবার কালো ফেতনি মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।

সবাই সাহারাকে নিয়ে ব্যস্ত,আমি মনে মনে ভাবছি বন্ধু বান্ধব কাউকে বলতেও পারি নাই
তারা শুনলে কি বলবে?
ভাবতে ভাবতে সন্ধা ঘনিয়ে এলো,
আমি রাগে বাহিরে বসে আছি,রুনি খালা এসে বলে কিরে এত রাত বাহিরে কেন বসে আছিস? তোর না আজ বাসর রাত!

## ২য় পর্ব ##

রুনি খালা এসে বলে”কিরে এত রাত বাহিরে বসে আছিস কেন তোর না আজ বাসর রাত”?তোর কি শরীর খারাপ করছে নাকি?

আমি কোনো কিছু বলছি না মনে  মনে তাদের অভিশাপ দিচ্ছি,ভাবছি আমাকে তোমরা বলীর পাঠা বানাইছো সবাই আমার গাঁড়ে একটা কালো ফেতনি মেয়ে বেঁধে দিলো।

তার পরও  যে কষ্টে আছি বুঝতে না দিয়ে আমি রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
দেখি সাহারা ফেতনি মেয়েটা আমার জামা কাপড় সব গুছিয়ে রাখছে,তার দিকে তাকাতে আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো,
বললাম এত ডং করা লাগবেনা আমার জিনিস আমি গোছাতে পারবো।

ফেতনি টা বলে আজ থেকে তো আমি সব গুছাতে হবে তাই না?
কেন তুমি গুছাবে? বাহ!রে আমি না আপনার বিয়ে করা বউ।

তার কথা শুনে আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো,কিছু না বলে গদগদ করে মাদুর পেতে ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম,সেই বলে আপনি কি আমাকে বিয়ে করে খুশি না?
এই তুমি কথা বলবেনা  আমার সাথে কালো পেতনি একটা মেয়ে।

আচ্ছা আমি আপনার বিয়ে করা স্ত্রী আমি আপনার সাথে কথা না বললে কে কথা বলবে?দয়া করে আপনি উপরে ঘুমান।
ততক্ষণে আমি ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ রাত্রে ১টা বাজে কেউ একজনের কান্না শুনে ঘুম ভেঙে গেলো তাকিয়ে দেখি ফেতনি মেয়েটা নামাজ রত অবস্থায় গুনগুন করে কাঁদছে,আর কি জানি বিড়বিড় করে বলছে।আমি শুয়ে আছি হটাৎ দেখি ফেতনিটা আমার গায়ে একটা কম্বল মুড়িয়ে দিয়ে উপরে না ঘুমিয়ে আমার পাঁয়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়লো,কখন জানি আমার ও ঘুম চলে এলো।

সকালে সবাই নাস্তা নিয়ে অপেক্ষায় আছে টেবিলে এক সাথে খাবে বলে,কিন্তু আমার তো রাগে শরীর পুড়ে যাচ্ছে!

বাবা রুনি খালাকে পাঠালো আমাকে ডাকার জন্য,”মালেক” আয় বাবা নতুন বউ সহ সবাই একসাথে নাস্তা করবো।আপনি যান আমি নাস্তা করবো না।খালা বলে কি হলো তোর?কিচ্ছু না খালা তুমি যাও তো এখন।

কিছুক্ষন পরে দেখি ফেতনি টা নাস্তা নিয়ে রুমে ডুকলো।বললো আসুন আমরা এক সাথে নাস্তা করি,এই তুমি তো আসলে একটা বেহায়া মাইয়্যা আমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করছি না।

আচ্ছা আপনি কি আমার উপর রাগ করছেন?
গত রাত্রেও আমার উপর প্রচন্ড ক্ষোভে ছিলেন,আমাদের বাসর রাত ছিলো কিন্তু আপনি আমকে………….!
এই চুপ থাকতে বলছি না তোকে।

সে কথা না বলে রুমে সব ঠিকঠাক করছে,আমি বললাম রুম টুম গুছানোর ডং করে লাভ নেই আমাকে পটানোর চেষ্টা করছো,এই মালেক এতো নরম মনের মানুষ না যে তোমার মতো কালো ফেতনি মেয়েকে বউ হিসাবে মেনে নিবে।

এভাবে একই সাথে একই রুমে থাকি কিন্তু টম এন্ড জেরির মতো সংসার এগিয়ে চলছে আমাদের………!

##শেষ পর্ব:##

টম এন্ড জেরির মতো এগিয়ে চলছে আমাদের সংসার!

কালো বউ নিয়ে মনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে আছি আমি,দিন গুলো কাটছে নিরব,নিভৃতে,শূন্যতা,বিষাদের ঘন অন্ধকার সন্ধিহীনতার পরতে।যেন রাত্রি প্রহরে ঘোর কুয়াশায় ঢাকা একটি স্বাদ গন্ধহীন মরিচিকাময় জীবন।

দেখতে দেখতে ১বছর কেটে গেলো,বাবা বললো আজ না তোদের বিবাহ বার্ষিকী?
আজ তুই বউ মাকে নিয়ে কোথাও একটু ঘুরে আস।

আমি চুপ করে আছি,বাবার মুখের উপর কিভাবে
বলবো কালো বলে আমি তাকে বউ হিসাবে মেনে নিতে পারছিনা?বলছি বাবা আমার তো আজ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে কোথাও যেতে পারবো না।

সাহারা হঠাৎ রান্নারঘর থেকে কেন জানি বলে উঠলো আমারও আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা বাবা,বাবা বলল আচ্ছা।শুনে আমি তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম!

রাতে বললাম এই তোকে নিয়ে কে বাহিরে বের হবে তুই যে বললি তোর যেতে ইচ্ছে করছে না।বাহ! রে আমি তো বাবার বকা থেকে আপনাকে বাঁচানোর জন্য বলছি।আহা! কি দরদ?আর দরদ দেখানো লাগবেনা।

১০ বছর পর বাবা মারা গেলেন,পরিবারে দেখা দিলো আসীম অভাব অনটন।
হঠাৎ আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি,ডাক্তার বলছে আমার নাকি দুইটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে।এক সপ্তাহের ভিতর কিডনি স্থাপন করতে হবে ২লক্ষ টাকা লাগবে।

কিন্তু  এতো টাকা কোথায় পাবো খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম?হঠাৎ ৩ দিন পর ডাক্তার বলবো আপনার জন্য একজন অজ্ঞাত লোক একটি কিডনি দান করেন।

আমি জানতে চাইলাম কে কিডনি দান করলো?এতো মহান লোকটি কে?রুনি খালা বলল যাকে তুই ঘৃনা করিস সে কালো মেয়েটি তোর জন্য কিডনি দান করছে।

আমি হতচকিত হয়ে লজ্জিত মাথায় রুমে গিয়ে দেখি সে নামাজ পড়ে মুনাজাতে বলছে হে মাবুদ তুমি আমার স্বামীকে আমার কাছে সুস্থ করে ফিরিয়ে দাও।

ততক্ষণে মনের অজান্তে আমার দুচোখ বেয়ে পানি টপটপ কর পড়ছে।আর মনে মনে ভাবছি,যে কালো মেয়েটাকে আমি এতো অবজ্ঞা,অবহেলার চোখে দেখলাম সে আজ আমার জীবন বাঁচাতে দুর্দিনে, দুর্দশার অন্ধকারে সৌন্দর্যের আলো নিয়ে
আসলো,শেষে তাকে ভালোবাসার আলিঙ্গনে আপন করে নিলাম।

দুই বছর পর আমাদের ঘর আলোকিত করে এলো কুচকুচে কালো একটা কলিজার টুকরা।আমি তাকে কালো বলি না কারন আমি এখন বুঝি সাদা কালো মানুষের পরিচয় নয়।
আমি তার নাম দিলাম”””লালপরি””””তাকে আমি তার মায়ের মতো ধৈর্য্য, আদর্শ আর চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে চাই।

পরিশেষে বলিঃ

সাদা কালো নহে ব্যবধান- নহে ঘৃনা তবে, তবু কালো বলিয়া ঘৃনা কেন মানবের ভবে? সকলিই সৌন্দর্য আখ্যায় রহমান- কুরআনের অমর বানী, তবু কেনো মোরা আজ সাদা কালোর- অশোভন পার্থক্য টানি?

গল্পটি লিখেছেন সাইফুল ইসলাম মালেক সহকারী শিক্ষক, মোহাম্মদপুর আদর্শ কিন্ডারগার্টেন, ৮নং মোহাম্মদপুর, সুবর্ণচর, নোয়াখালী।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.