করোনার হটস্পটে পরিণত ”রামেক” হাসপাতাল , নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ও আইসিইউ ওয়ার্ডের বাইরে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। প্রায়শই শোনা যাচ্ছে বুকফাটা কান্নার সঙ্গে আর্তনাদ। কারও চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরলেও বের হচ্ছে না শব্দ। আর এভাবেই কেউ চোখের পানি মুছে আবার কেউ বুকফাটা কান্নায় পরলোকে পাড়ি জমানো স্বজনের লাশ নিয়ে আহাজারি করতে করতে হাসপাতাল ত্যাগ করছেন।
এই দৃশ্যগুলো যখন ভয়াবহ এক পরিস্থিতির বার্তা দিচ্ছে, ঠিক সে সময় স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে জরুরি বিভাগ, হাসপাতালে সামনের খাবারের দোকান থেকে লক্ষ্মীপুর মোড়ের চায়ের দোকান, ফার্মেসি থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক রোগী ও তার স্বজনসহ দালাল-রিপ্রেজেন্টেটিভরা। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা বললেও দৃশ্যমান বিশেষ কোনও কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গতকাল রবিবার (৩০ মে) ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। রামেক হাসপাতালে করোনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা এটি। মারা যাওয়া বারো জনের আট জনেরই করোনা পজিটিভ। বাকি চার জনের করোনা উপসর্গ ছিল, নমুনা পরীক্ষার আগেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা মারা যান। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাত জন রয়েছেন। বাকিদের মধ্যে রাজশাহীর দুই জন, নওগাঁর দুই জন ও নাটোরের একজন। এ নিয়ে গত ছয় দিনে রামেক হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেন ৫১ জন। রামেক হাসপাতালে বর্তমানে ২০৪ জন করোনা আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে ৯৪ জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের। ৭৭ জন রাজশাহীর এবং বাকিগুলো বিভাগের অন্য জেলার।
রামেক হাসপাতালে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন প্রাণ। আক্রান্তের নতুন সংখ্যা। তারপরও সচেতন হচ্ছে না কোভিড আক্রান্তসহ সাধারণ রোগীরা। এছাড়া চিকিৎসাকেন্দ্র লক্ষ্মীপুর এলাকায় নেই কোভিড সুরক্ষার বিশেষ কোনও ব্যবস্থা।
গতকাল রবিবার (৩০ মে) রামেক হাসপাতালে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগসহ লক্ষ্মীপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টার, মেডিসিন কাউন্টার ও চিকিৎসকদের রুমের বাইরে রোগীদের জটলা। একে অন্যের শরীরে স্পর্শ করেই সিরিয়াল নিচ্ছেন। অনেকে তো হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। অনেকেই মাস্ক হাতে ধরে আছেন। আবার কেউ নাকের নিচে লাগিয়ে রেখেছেন। একই অবস্থা প্যাথলজি বিভাগগুলোতেও। এদিন আনসার সদস্যদের সচেতনতা মূলক মাইকিং করতে দেখা গেলেও রোগীরা তেমন কর্ণপাত করছেন না। হাসপাতালের নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদেরও তেমন সচেতন থাকতে দেখা যায়নি।
রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও অধিকাংশ রোগী ও তার স্বজনকে তেমন সচেতন থাকতে দেখা যায়নি। অনেকেই মাস্ক না পরেই হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিন হাসপাতালের বর্হিবিভাগ ও জরুরি বিভাগে ডাক্তারদের চেম্বারের বাইরে ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের জটলাও দেখা গেছে। যেটা ডাক্তার, নার্সসহ হাসপাতালের চিকিৎসা সহায়কদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ডা. আফরোজা নাজনীন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, সাধারণ ওয়ার্ডে কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরে প্রায়শই রোগীর করোনা শনাক্ত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তিনি কোনও রোগীর ড্রেসিং করলেন বা অপারেশন করলেন, তার পরের দিন রোগীর করোনা শনাক্ত হলো। এতে ডাক্তারদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এভাবেই তারা ঝুঁকির মধ্যে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু রোগীরা এখনও সচেতন হচ্ছেন না।
রামেক হাসপাতালে বাইরেও খাবারের দোকান, ওষুধ ফার্মেসিসহ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বাইরে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যাওয়া-আসা করছে। ফার্মেসিগুলোর সামনে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ লেখা সম্বলিত ফেস্টুন টাঙানো হলেও সেখানকার কর্মচারীরা নিজেরাই মাস্ক ব্যবহার করছেন না। এমনকি ফার্মেসির ভেতরে অনেকটা গাদাগাদি করেই কাজ করছেন কর্মীরা। ফার্মেসি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বাইরে জটলা বাঁধিয়ে আড্ডা দিতেও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের। বিকালের পর তাদের আড্ডায় জমজমাট থাকছে লক্ষ্মীপুর এলাকা। তারাও স্বাস্থ্যবিধির প্রতি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
হাসপাতালের বাইরে খোলা পরিবেশেই খাবার খাচ্ছেন রোগীসহ তার স্বজনরা। এক্ষেত্রে হাত না ধুয়েও খেতে বসতে দেখা গেছে অনেককেই। এছাড়া হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে আছেন ফুটপাত ব্যবসায়ীরা। তারাও মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। লাশ ও রোগীবাহী গাড়ির চালক ও তার সঙ্গীদেরও একই অবস্থা।
এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘রাজশাহীর করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখানে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কয়েক দিন পরপরই করোনার বেড বাড়ানো হচ্ছে। এরপরেও করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে সামনে রোগীদের আর জায়গা দেওয়া যাবে না।’
তিনি আরও জানান, হাসপাতালে রোগীদের সচেতন করতে তারা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু রোগীরা সচেতন হচ্ছেন না। এক্ষেত্রে তারা খুব বেশী কঠোর হতেও পারছেন না। আর হাসপাতালের বাইরের এলাকাগুলোতে প্রশাসনিক তৎপরতা যেভাবে থাকা প্রয়োজন কার্যত তা হচ্ছে না বলেই মনে করেন তিনি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার আহ্বান জানান হাসপাতাল পরিচালক।
এ বিষয়ে রাজশাহী পুলিশ কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক জানান, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে হাসপাতাল পরিচালক, জেলা প্রশাসকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীলদের নিয়ে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার বৈঠক করেছেন। যেখানে তিনি সবার করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি আরও জানান, হাসপাতাল এলাকার বাইরে তারা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। মাস্ক বিতরণ করছেন। এখন ফার্মেসিগুলো বন্ধ করে বা রোগীদের সেখানে আসা বন্ধ করতে পারেন না। করোনা পরিস্থিতি পুলিশ মানবিকভাবে মোকাবিলা করছে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, করোনা সংক্রমণ রোধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলছে লকডাউন। এরপরও করোনা সংক্রমণ দিন দিন রেকর্ড ভাঙছে। রবিবার আরও ৬৩টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এতে করোনা আক্রান্তের হার ৭১.৪৩ শতাংশ। শনাক্তদের মধ্যে কোন উপজেলায় কতজন তা যাচাইয়ে কাজ চলছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ল্যাব ইনচার্জ ডা. সাবেরা গুল নাহার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় রাজশাহীর ২৮৭ জনের করোনার নমুনা পরীক্ষায় ৯০ জনের পজিটিভ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ৩১ শতাংশ। এছাড়া নওগাঁর আঠারো জনের নমুনা পরীক্ষা করে আট জনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ৩৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৪৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে রবিবার দুপুরে পাঠানো রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমা আক্তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে নতুন করে সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩৩৭ জনের। এটি বিভাগে একদিনে গত প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত রোগী। এ নিয়ে বিভাগে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ১৭৫। আর বিভাগে মারা গেছেন ৫৫০ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পাঠানো প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজশাহী বিভাগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ১২ এপ্রিল। এরপর গত বছরের ২৯ জুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়ায়। এভাবে ২০ জুলাই ১০ হাজার, ৪ আগস্ট ১৫ হাজার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০ হাজার, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারী ২৫ হাজার এবং ১৯ এপ্রিল বিভাগে ৩০ হাজার ছাড়ায় করোনা রোগীর সংখ্যা। এ সংখ্যা গতকাল রবিবার (৩০ মে) ছাড়ালো ৩৫ হাজার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা কমেছে। এদিন মাত্র ৫১ জন সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে বিভাগে মোট সুস্থ হয়েছেন ৩১ হাজার ৩৫১ জন।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক হাবিবুল আহসান তালুকদার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, তারা করোনার সংক্রমণরোধে সব ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপক হারে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার হার বাড়িয়েছেন। তিনি সবাইকে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধিসহ সরকারি বিধিনিষেধ মানার জন্য অনুরোধ করেছেন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.