আর্তনাদ (পর্ব-৩)

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: মাবরুর পেশায় একজন ডাক্তার।ছোটবেলায় সে গ্রামো ডাক্তার রচনায় পড়েছিল। ডাক্তারি এক মহৎ পেশা। তখন থেকেই তার খুব ইচ্ছে সে ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে।
ঠিক যেমন ইচ্ছা, তেমন কর্ম এবং প্রাপ্ত ফলে আজ সে ডাক্তার। বহুল কাঙ্ক্ষিত তার প্রত্যাশাটি প্রভু কবুল করেছেন।
তাই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল- যে প্রভু আমার কাঙ্ক্ষিত সপ্নটি পুরোন করেছেন, তার শপথ। আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও এর সম্মান রক্ষা করবই, ইনশাআল্লাহ।
ডাক্তার হবার পর থেকেই সে জীবনের নতুন যুদ্ধে  অংশ নিয়েছে। সর্বদা অসহায়, দরিদ্রদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। অল্প কিছুদদিনের মধ্যেই চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পরে গরিবের ডাক্তার হিসেবে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে গোটাবিশ্ব আজ এক মহাসংকটময় মুহূর্ত অতিবাহিত করছে। করোনার প্রকপে জাতি আজ দিশেহারা।
ছোট্ট বাংলাদেশটাও রক্ষা পায়নি এর প্রভাব থেকে। দিনের পরদিন এর প্রভাব বেড়েই চলেছে বহুগুনে।
জাতির এই মহাবিপদে আর চুপ করে থাকতে পারে না মাবরুর। মুহুর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতির এই বিপদে। করোনার প্রভাব দিনকে দিন হুড়হুড় করে বেড়েই চলেছে। এদিকে হাসপাতালে রোগীদের সংখ্যাও বাড়ছে।
মুমূর্ষু মানুষগুলোকে ফেলে সে বাসায় যেতে পারে না আজ ৭ দিন হলো। বাসায় তার ৩ বছরের ছেলেটা সারাদিন কাঁদতে থাকে বাবা বাবা বলে। একটায় আবদার বাবার সাথে একটু খেলবে সে।
পাঁচ বছরের মেয়েটা বারান্দা দাড়িয়ে বাবার অপেক্ষায় বসে থাকে সারাদিন। সে অনেকদিন হলো বাবাকে দেখেনি। বাবার সাথে খেলেনি। বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমায় নি।
তাদের মা আজ অসহায়। কতবার আর মিথ্যা সান্ত্বনা দিবে তাদের। আজ বলে- কাল সকালে আসবে খেয়ে নাও তোমরা। কালকে বলে তোমাদের জন্য বাবা অনেক খেলনা কিনেছে। দেখ, কাল নিয়ে আসবেই। প্রতিবার মিথ্যায় পরিণত হয় তার আশ্বাস। সন্তানরা আর তার মায়ের কথা শুনতে চায় না।
আজ দশ দিন পর সে বাসায় এসেছে। চেহারায় যে তার অন্য রকম ছাপ পরে গেছে। স্বামীকে এবস্থায় দেখে স্ত্রীর চোখ দিয়ে অঝরে জল পরছে। বুকে জমা হাজারো চাপা প্রশ্ন।
সন্তানরা বাবাকে পেয়ে আজ সবচেয়ে বেশি খুশি। আজ তাদের কোন চকলেট বা খেলনার আবদার নেই। শুধু বাবাকে জড়িয়ে ধরা আর কোলে একটুখানি বাসায় তারা স্বর্গীয় সুখ খোজে পেয়েছে।
কিন্তু বাবার সময় আজ খুবই সল্প।তাই স্ত্রীকে একলা ঘরে ডেকে বলতে থাকেঃ প্রাণের প্রিয়তমা আমার, জানিনা আর কত রাত কাটাতে হবে বিরামহীন এই দয়িত্ব পালনে। তবে জীবনে যে শপথ করেছিলাম। মনে হয় আজ সেটা পুরন হতে চলেছে।
জানিনা আর কোনদিন এভাবে পাশাপাশি বসতে পারব কিনা? সন্তানদের কোলে তুলে আদর করে চুমু দিতে পারব কিনা? প্রিয়তমা তুমি, আজ সময়ের সবচেয়ে উপযোগি মানুষ তুমি।
জানি তুমিই পারবে তাদের আদর্শের পথ দেখাতে।
যদি জাতির এই চরম দর্যোগ কাটিয়ে আসতে পারি-আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি না পারি আল্লাহ জান্নাতে আমাদের মিলিয়ে দিবে-ইনশাআল্লাহ।
স্ত্রীর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়েই চলেছে অঝরে।
আগে কত রাগ- অভিমান করত কিন্তু আজ যে সে নির্বাক হয়ে গেছে। শুধু ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে।
ছেলেটা এসে পা জড়িয়ে বসে আসে। তার বাবাকে আর যেতে দেবে না সে। মেয়েটা গলা জড়িয়ে ধরে বলছেঃ বাবা আজ আমরা পুতুল পুতুল খেলব। ছাদে যেয়ে কানামাছি খেলব ঠিক আছে!!
কষ্টে বুক ফেটে যেতে থাকে তার। ছলছল নয়নে সন্তানদের বলতে থাকে এইতো সোনামনিরা, বাবা যে একটু খানি কাজ পরেছে। শুধু যাবে আর আসবে। তোমরা মায়ের কাছে যাও। মা চকলেট দিবে, খেলনা দিবে।
যাও।
মেয়েটা বলছেঃ তুমি আগেও এমন বলে আর আসনি। আজ আর তোমাকে যেতে দিব না। ছেলেটা পা ছাড়ছেই না। তবুও যে তাকে যেতে হবে। কারন সে তো ডাক্তার। দায়িত্বের কাছে যেন আজ সন্তানদের কান্না তুচ্ছ হয়ে পরেছে।
কোন রকম তাদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে বের হলো সে। বাহির দরজায় যেতেই বুকটা হাহাকার করে ওঠলো তার। ইচ্ছে করছে একটা চিৎকার দিতে।
কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনা। কোন রকম নিজেকে সামলে চলে যায় হাসপাতালে। কারন সে একজন ডাক্তার।
এদিকে সন্তানেরা বাবার পথ চেয়ে অপেক্ষা করতে করতে দিন চলে যায়। তবুও ফিরেনা বাবা। দরজার হাতল ধরে টানতে থাকে। বারান্দার গ্রিল ধরে চেয়ে চেয়ে কাঁদতে থাকে। কিন্তু ফিরে আসে না বাবা।
তাদের ইচ্ছে করে দরজাটা টান দিয়ে খুলে বাবার কাছে যেতে। কিন্তু কি করে যাবে মা তো দরজা বন্ধ করে রেখেছে।
এদিকে মাবরুরের প্রতিটা মুহুর্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটতে থাকে। না, এ উদ্বেগ তার সন্তানের জন্য নয়। এই উদ্বেগ হাসপাতালের বিছানায় করোনা আক্রান্ত শত শত রোগীর কষ্টের উদ্বেগ।
হাসপাতালের সকল কর্মী, নার্স, ডাক্তার আজ ঘর-বাড়ি, সংসার ত্যাগ করে মৃত্যু ঝুকি নিয়ে আজ হাসপাতালে দিনাতিপাত করছে। রোগীদের সেবা দিচ্ছে। কোন স্বার্থের জন নয়। শুধুমাত্র তারা ডাক্তার এবং তারা রোগী তাই।
সেই মাবরুর-ই আবার শত ব্যস্ততার মাঝেও জাতির জন্য বার্তা পাঠাচ্ছেঃ “আপনারা বেশি বেশি ভিটামিন সি খান, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নেন। ঘরেই থাকুন। নিজ পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন “।
কিন্তু সেই মাবরুরই আজ ঘরের বাইরে।তার আজ পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেই। ভালো কোন খাবার নেই।
দিন-রাত রোগীর সেবা করছে শুধুমত্র সে ডাক্তার বলে।
গভীর রাতে হাসপাতালের ছোট্ট শক্ত খটখটে বিছানায় যখন সে একটু বিশ্রাম নিতে যায়। একটু পরেই আচমকায় যেন তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এই ভেবে যে, এই বুঝি কেউ শ্বাসকষ্টে বিছানায় ছটফট করছে। মহুর্তেই ছুটে যায় সে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে।
হঠাৎ দেখতে পায় সুমাইয়া নামের মেয়েটা বারান্দা ঘুরে ঘুরে সব পরিদর্শন করছে। রাত তখন ৩ টা। কাছে গিয়ে বললামঃ সুমাইয়া তুমি ঘুমাও নি?
মেয়েটা ছলছল নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল।
না,স্যার ঘুমাই নি। একটু পরে ঘুমাব, স্যার। আপনি বরং একটু ঘুমান। আমি দেখছি এদিকটা।
মেয়েটার প্রাইমারিতে থাকা অবস্থায় মাদার তেরেসার জীবনী পড়েছিল। তাই ছোটবেলার ইচ্ছা সে নার্স হবে। মাদার তেরেসার মত মানব সেবাই আ্ত্মনিয়োগ করবে। তাই সে আজ নার্স হয়েছে।
সারাদিন রোগীদের দেখাশোনা করে। তার নাকি ঘুমাতে স্বার্থপর লাগে আজকাল।
বলেঃ স্যার, এই যে মানুষ গুলো আজ বিছানায় কাতরাচ্ছে।
পরিবারের কোন লোক তাদের পাশে আজ নেই। অসহায় অবস্থায় অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাদের উপর শেষ ভরসা করে এটুখানি
বাচার আকুতি করছে, স্যার।
এদের এ অবস্থায় রেখে কেমনে ঘুমাব, স্যার। তার কথা শুনে অজান্তেই কেঁদেছিলাম।  মনে একটু সাহসও পেয়েছিলাম। এই ভেবে যে, এই যুদ্ধে আমি একা নই।
আজ রোগীর সেবা দিতে দিতে মাবরুর, সুমাইয়াদের জীবনীশক্তিটুকু ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। কিন্তু তারা আজ পালিয়ে যাচ্ছে না। কারন তারা ডাক্তার।
একদিন সকালে মাবরুর ফেইসবুকে ঢুকতেই দেখতে পেলেন – ছোট্ট একটা ছেলে কাগজে লিখে দাড়িয়ে আসেঃ
“আমার বাবা এতজন ডাক্তার। আপনাদের বাঁচাতে আজ সে বাহিরে, দয়াকরে আপনারা ভিতরে থেকে আমার বাবাকে বাঁচান”।
মহুর্তেই বুকটা কেঁদে উঠল তার। এতদিন সে তার পরিবারের কথা প্রায় ভুলেই গেছিল।
 আর দুরে থাকতে না পেরে, একটু খানি দেখার জন্য রওনা হলো বাড়ির দিকে।
কিন্তু আজ আর বাসায় ঢুকে সন্তানকে কোলে তুলে চুমু দেবার সামর্থ্যটুকু নেই তার।তাই রাস্তা থেকে সন্তানদের সাথে কথা বলছে সে। স্ত্রীর দুচোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছে। ছেলেটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুহাত বাড়িয়েছে জড়িয়ে ধরার জন্য।
মেয়েটা দরজা আছড়াচ্ছে বাহির হবার জন্য।
কিন্তু তার বাবা তো আজ প্রকৃতির এই মহাবিপর্যয়ে অসহায়। মুহুর্তেই মায়া ত্যাগ করে স্ত্রী সন্তানকে বিদায় জানিয়ে। আবার ফিরে এলো কর্মস্থলে। কারন সে একজন ডাক্তার।
এভাবেই দিনের পর দিন পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় প্রটেকশন ছাড়া রোগীর সেবা দিতে গিয়ে আজ সে নিজেই রোগী। ভয়ানক করোনায় আক্রন্ত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পরে আছে তার নিথর দেহখানি।
এভাবেই প্রতিদিন হাজারো মাবরুর ও সুমাইয়ারা তাদের জীবনকে তুচ্ছ করে মানবতার সেবাই আত্মনিয়োগ করেছে নিঃস্বার্থভাবে।
তারা মৃত্যুভয়ে কাপুরুষেরর মত পালায় নি। তারা যে শপথ নিয়ে এ মহান পেশায় এসেছিল। জীবন দিয়ে তার সম্মান রক্ষা করে ইতিহাসের পাতায় তাদের সাক্ষর বহন করছেন।
সত্যিই স্যার স্যালুট আপনাদের।জাতি আপনাদের এই ত্যাগ কখন ভুলবেনা। আপনারা জাতির হৃদয়ে  জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে বেঁচে থাকবেন চিরদিন।
তাই নিজে ঘরে থাকুন। পরিবারকে সুস্থ রাখুন কারন, আপনি সুস্থ থাকলে, সুস্থ থাকবে আপনার পরিবার। সুস্থ থাকবে আপনার এলাকা। সুস্থ থাকবে বাংলাদেশ।##
লেখক: এম রায়হান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.