আর্তনাদ (পর্ব-২)

লেখক: এম রায়হান: (রা: বি:): ইয়াসির বাবা হারানো এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বয়স ১০। মায়ের সাথে সে এক বস্তিতে থাকে। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে সে কাজ করতো। তার মা বিভিন্ন বাসায় রান্না করে যা পেত, সেটাতেই দিন কেটে যেত তাদের।
কিন্তু চীনের উহান থেকে উঠে আসা ভয়ানক সেই করোনাভাইরাস নিমেষেই  যেন স্তব্ধ করে দিল তাদের জীবন যাত্রা।
বন্ধ হয়ে গেল দোকান-পাট, হাট বাজার। ছোট্ট ইয়াসির আর যেতে পারেনা দোকান ঘরে। তার মাকে বাসা থেকে নিষেধ করেছে কাজে আসতে। কারন সে বস্তিতে থাকে।
সেটা নাকি করোনার আতুর ঘর। যদি সে করোনাভাইরাস নিয়ে ঘরে আসে। বাসায় যাওয়া বন্ধ শুনে বুকের মধ্যে ধক করে কি যেন আটকে গেল তার। চিন্তায় মুখটা মলিন হয়ে গেল নিমেশেই।
গতমাসে যা টাকা পেয়েছিল তা বাড়িভাড়া আর কিস্তিওলাকে দিতেই প্রায় শেষ। কেবল মাসের শুরু কিছু টাকা আবদার করবে এ সাহস আর হলো না।
এখন সে কি করবে এই চিন্তা করতে করতে বাসায় আসতে গিয়ে সড়কদূর্ঘটনায় পরে সে। গাড়ির আঘাতে পা ভেঙ্গে যায় তার।
হাসপাতালে নিলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠান দায়িত্বরত চিকিৎসক। বেশিদিন রাখা যাবে না সেখানে করোনার প্রকোপ।
এদিকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য শহরকে লকডাউন করেছেন সরকার। রীতিমত সবাই বন্দি জীবন কাটাতে শুরু করেছে। বন্দি পরেছে তারাও। কিন্তু এই বন্দি দশা তো সবার মতো না!!
এদিকে শহরে করোনার প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। জন জীবন যেন স্থবির হয়ে পরেছে আজ। পুলিশ, সেনা রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয়। বাহিরে বের হলেই লাঠি পেটা করছে তারা।
এদিকে তাদের বাসার খাবার প্রায় শেষ। বিছানা থেকে ওঠে রান্না করতে পারে না ইয়াসিরের মা। ছেলেটা হাত পা পুড়ে রান্না করছে কয়েকদিন হলো। কিন্তু আজ সেই চাল ডালটাও শেষ।
চা দোকানের মালিক মতিন চাচার কাছে কিছু টাকার জন্য ছেলেকে পাঠাবে কিন্তু সাহস পাচ্ছিলনা। যদি রাস্তায় পুলিশ, সেনার হাতে পড়ে। আজ ২ দিন চলে গেল অনাহারে। বাধ্য হয়ে খুব সকালে ইয়াসিরকে পাঠালো মতিন চাচার কাছে কিছু টাকার জন্য।
এদিকে মতিন সাহেব দোকান খোলতে পারে না ১০ দিন হলো। ঐ দোকানটাই একমাত্র সম্বল তার।  নিজের দিন কাটানোই যেন অসম্ভব হয়ে পরেছে তার আজ। তবুও তার পরিবারের এই অবস্থার কথা শুনে হাড়িতে একটু খাবার ছিল খেতে দিল।
তারপর মলিন মুখে একটু শান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে ছোট একটা চাল ডালের ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল : ইয়াসির নানু ভাই এটা নিয়ে তোর মাকে দিবি। আর কোন টেনশন করতে দিবি না।এটা আজ নিয়ে যা। এটা শেষ হলে আবার আসিস কেমন।
মতিন সাহেব আজ সকালে মহল্লার মোড়ে এই পুটলিটা পেয়েছে।  সেই তার কি একটু দিতে এসে কতজন ছবি তোলতে তাকে ঝেকে ধরেছে। কারো ইয়া বড় বড় মোছ। কারোর বা মাথায় বেনি। ছেলে না মেয়ে বুঝা মুসকিল।যেটুকু পেল তারও কিছু ছবি তোলার তোপে ধুলোয় নিপাতিত হলো।
যাইহোক, সেই এক ইতিহাস!!
তবুও এখনতো দুনিয়া কিছু মানুষ আছে যে অপরের কষ্টে হাত বাড়ায়।
ব্যাগটা পেয়ে মহুর্তেই বুঝে গেল তার মা মতিন চাচার অবস্থা।
আবার কিছুদিন কোন রকম পার করল তারা।
অনেকদিন হয়ে গেল ইয়াসিরের মা ঘর থেকে বের হতে পারে না।একদিন সকালে ঘরের পাশ দিয়ে সকিনা বেটিকে যেতে দেখে ডেকে কাছে আনল সে।
বলল: বোন শুনতেছি শহর নাকি বিভিন্ন বড় সাহেবরা চাল- ডাল দিচ্ছে? কমিশনার সাহেবও নাকি দিচ্ছে।
তুই কিছু, কোথাও পেলি বোন?
কি বলবো সেই দুঃখের কথা। বড় সাহেবরা রাস্তায় যাকে পাচ্ছে একটু  দিচ্ছে।
আর কমিশনার সাহেবের কাছে এই বস্তির জন্য আসা কিছু ত্রান নাকি কাটা রফিকের কাছে ছিল।
তার খোজ আর মিলে নি।
শুনলাম কাল সকালে কোন বড় সাহেবের ত্রান আসবে। ইয়াসিরকে পাঠাস মোড়ের দিকে।
ইয়াসিরের মা মনে একটু সাহস হলো।
মতিন চাচার দেয়া যা ছিল সেটাও কাল শেষ হয়েছে।
মতিন সাহেবের অবস্থার কথা চিন্তা করে। মা ইয়াসিরকে আর পাঠাতে পারেনা।
এদিকে বহুল প্রতিক্ষার সকাল আসল। মা পাঠিয়ে দিল ইয়াসিরকে আজ কিছু পাবার আসায়।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
বড় সাহেবের কর্মচরিকে মহল্লার কোন মাতব্বর যেন একটা তালিকা দিয়েছে। সেই তালিকা অনুসারে কর্মচরি ঝটপট ত্রান দিয়ে চলে গেছেন। প্রসাশনের নির্দেশ ত্রান দিতে ভীড় করা যাবে না।
এদিকে ত্রান আসার সাথে সাথে মাতব্বর কিছু দিল আর বাকি গুলোর কোন হদিস পাওয়া গেল না।
তালিকায় নাম না থাকায় শূন্য হাতে একা দাড়িয়ে থাকল সে। কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পারল সে।
তার ত্রান নেই।
তাই অনেকজনের কাছে যেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার অনাহারে থাকা কষ্টের কথা বলেও কোন লাভ হলো না।
এলাকার পরিচিত মুখ গোল যেন আজ বড়ই অপরিচিত হয়ে গেছে তার কাছে!
অশ্রুসিক্ত নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ইয়াসির বাসায় এসে মায়ের কোলে মাথা ঢুকিয়ে অবস্থার বর্ণনা দিল।
মায়ের চোখ বেয়ে জল পরতে লাগলো।
কিন্তু মহুর্তেই আচলের আড়ালে চোখ দুটো মুছে একটু হাসি দিবার চেষ্টা করে বললঃ
ইয়াসির, বাবা আমার। কাঁদছিস কেন? এ দুনিয়া তো মরে গেছে রে!
দেখছিস না চারদিকে শুধু জেন্ত লাস। কিন্তু তোর মা তো এখনো বেঁচে আছে, রে। কাঁদিস না। বস এখানে।
তারপর নিজেই ভাঙ্গা পা নিয়ে একটু বাহিরে যাবার চেষ্টা করল। কিন্ত পারলনা।
কোন উপায় নানা দেখে। বাধ্য হয়ে ইয়াসিরকে পাঠালো কাজের মালিকের বাসাই।
কিছু টাকা ধার নেওয়ার জন্য।
কিন্তু বাসায় যেয়ে অনেক রিকুয়েস্ট করেও কোন সাহায্য পেল না ইয়াসির।
খালি হাতে ফিরে আসায় এবার চরম হতাশায় নিমজ্জিত হলো মা।
কি করবে বুঝতে পারছে না সে।নিজ শক্তি বলে ওঠারও সামর্থটুকু হারিয়েছে আজ সে।
আজ তিনদিন হলো চুলা জলে না। শুকনো খাবারে কাটছে দিন।
আজ নিজেকে তার খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আল্লহ কি তার রিজিক তুলে নিল?
কিন্তু না! সেই আল্লাহ তো মহান দয়াময়। রিজিকের মালিক তিনি।
একটু পর এক বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে এসে তার দরজায়  ডাকছেঃ ঐ ইয়াসিরের মা, দরজা খোল।
দরজা খুলতেই বুড়ি মলিন শাড়ির আচল থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট বের করে ইয়াসিরের হাতে দিল। বুড়িেক ইয়াসিরের মা নানি ডাকে। মাঝে মাঝে সে বুড়িকে খাবার দিয়ে আসত।
ইয়াসিরকে সেদিন ত্রান না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আসা দেখে।আজ সে এসেছে টাকা নিয়ে। এই টাকাও সে কাল রাতে এক বড় সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছে। কিছুদিন আগে সে চাল ডাল পেয়েছিল।
একটা মানুষ সেটাতেই তার অনেকদিন যাবে।
তাই সে এই টাকা তাদের দিতে এসেছে।ইয়াসিরের মায়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল অঝরে।
আর মনে মনে বলছে, হায়রে মানবতা! তুই এতো নিষ্ঠুর কেন?
তাই সে আজ প্রতিজ্ঞা করেছে। অন্যের করুনায় নয়। নিজ সামর্থে এই টাকা দিয়ে ঘরে বসেই কিছু বানিয়ে বাহিরে বিক্রি করবে এবং তা দিয়ে দিনাতিপাত করবে।
রীতিমত জীবন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তাদের।
মা রুটি বানিয়ে দেয়। সেই রুটি ইয়াসির রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে আজ ১০ দিন পার করল তারা।
হঠাৎ কাল রাত থেকে তার জ্বর,সর্দিকাশি এবং মাথা ব্যথা হচ্ছে। দিন শেষে তার শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করেছে।
ডাক্তারি পরিক্ষায় তার দেহে এখন করোনাভাইরাস পজিটিভ এসেছে।
অসুস্থ মাকে একা ফেলে সাদা মাইক্রোবাসে করে আজ সে কোথায় চলেছে জানেনা।
আর সে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবে কিনা জানেনা!!!
এভাবে প্রতিদিন হাজারো ইয়াসিরের শেষ চিহ্ন টুকু নিঃশ্বেস হয়ে যাচ্ছে মানবিক বিপর্যয়ের কারনে।
কিছু তথাকথিত ভদ্র সার্থান্নেসী ডাকাতের হাতে আজ মানবতার মৃত্য হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আর অন্যদিকে যারা ইয়াসিরের মত অবস্থার শিকার না হয়েও এই জাতীয় দুর্যোগেরর মধ্যেও অকারনে বুক  ফুলিয়ে বাহিরে ঘুরে দেশকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেনন।
মনে রাখবেন আপনারা জাতীয় দুষ্মন।
আপনার জন্য যদি একজনও আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পরকালে আপনাকে হত্যাকারীর কাতারে দাড়াতে হবে।জাতি আপনাদের এই অপরাধ কোনদিনও ক্ষমা করবেনা।
তাই ইয়াসিরের জীবনের কথা নয়।
আপনার ঘরের ছোট্ট ইয়াসিরের কথা চিন্তা করে ঘরেই থাকুন।
নিজে সুস্থ থাকুন। দেশকে সুস্থ রাখুন। আবার বাংলাদেশ বিজয়ী হবে।-ইনশাআল্লাহ
লেখক: এম রায়হান, শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী । #  

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.