আরেক চেচনিয়া হবে ইউক্রেন?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রথম দিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াতে শুরু করে চেচনিয়া যুদ্ধের ছবি। এর জেরে কিছু পর্যবেক্ষক দুটি যুদ্ধের মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজতে শুরু করেন। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কো চেচেন সেনা মোতায়েন করেছে বলে খবর প্রকাশের পর ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত-পরবর্তী যুগে যেমনটা ঘটেছিল এবং এখন যা ঘটছে তার মধ্যে ঐতিহাসিক যোগসূত্র আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে।
এসব বিষয়ে চেচেন ভিন্নমতালম্বী তুমস আব্দুরখমানভের সঙ্গে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। চেচনিয়ার দুই যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া আবদুরাহমানভ একজন ব্লগার ও চেচেন নেতা রমজান কাদিরভের সমালোচক। কাদিরভের জ্ঞাতিভাই ও চেচেন রাজনীতিক ইসলাম কাদিরভের হুমকির মুখে ২০১৬ সালে তিনি নিজ দেশ ছেড়ে যান।
ইউক্রেনে কি এই মাত্রার রুশ হামলার আশা করেছিলেন?
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা ছিল (ভ্লাদিমির পুতিন) ইউরোপে কোনও যুদ্ধ শুরু করবেন না, এতে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন চালাতে হবে, ভেবেছিলাম এটি কেবলই ভয় দেখানোর চেষ্টা। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি যখন হামলার ঘোষণা দেন, তখন অন্য অনেকের মতো আমার কাছেও এটি অপ্রত্যাশিত ছিল।
আপনার মতে এই যুদ্ধের কারণ কি?
পুতিন ফের সোভিয়েত ইউনিয়ন কায়েম করতে চান। আর তিনি তা গোপন করেন না। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বিপর্যয় হিসেবে দেখেন। তিনি এমন এক মানুষ যিনি প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচেন। তিনি রুশ সাম্রাজ্যবাদী ও সাবেক সোভিয়েতভুক্ত সব দেশকে নিজ বলয়ের অংশ হিসেবে দেখেন।
বিধ্বস্ত ইউক্রেন
(বিধ্বস্ত ইউক্রেন)
যুদ্ধের কারণ হিসেবে ন্যাটোর সম্প্রসারণ সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, ইউক্রেন যোগদান করলে, রাশিয়ার কাছাকাছি ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হবে, এগুলো বাজে কথা। লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া ইতোমধ্যে ন্যাটোতে রয়েছে। যদি সেখানে রকেট মোতায়েন করা হয় এবং মস্কোর উদ্দেশে ছোঁড়া হয়, তাহলে ইউক্রেনে মোতায়েন করলে যে সময়ে পৌঁছাতো তার চেয়ে বেশি দেরিতে পৌঁছাবে না। বলা হচ্ছে নিরাপত্তা উদ্বেগ থেকে রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করেছে– এটি আগ্রাসনের একটি কাল্পনিক অজুহাত মাত্র।
রুশ সাম্রাজ্যবাদের যেকথা বলছেন তা কি রুশ সমাজে জনপ্রিয়?
হ্যাঁ, এই ধারণা রাশিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। জাতীয়তাবাদী গরিমা, সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকা, আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী, আমরাই প্রথম মহাকাশে উড়েছি… এমন সব ধারণায় খুব বেশি বুদ্ধিমত্তার কিছু নেই, কিন্তু রুশ সমাজের স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে এসব ধারণা বেশ জনপ্রিয়। এমনকি রুশবাদ নামে নতুন একটি টার্মও আছে যা ফ্যাসিবাদের আরেক রুপ। এটি খুব ভালো টার্ম যাতে ভুগছে রুশ সমাজ।
আমার মতে এটা প্রোপাগান্ডার ফলাফল। টিভিতে যদি মানুষের ব্রেন ওয়াশ করা না হতো, তাহলে তারা এভাবে ভাবতো বলে মনে করি না। যাদের জ্ঞান অর্জনের, ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে সেসব তরুণদের দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা ভিন্নরকম ভাবছে।
প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেন
(প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেন)
হামলার শুরু থেকে কেউ কেউ বলছেন, ইউক্রেন হবে দ্বিতীয় চেচনিয়া, কিয়েভ হবে দ্বিতীয় গ্রোজনি। এই তুলনার বিষয়ে আপনার কী মত?
আমি এখনও কিয়েভ সম্পর্কে জানি না, তবে যুদ্ধের সময় মারিউপোল এবং খারকিভকে অবশ্যই গ্রোজনির মতো লেগেছে। এটি অনিবার্য, কারণ ইউক্রেন দখলে ঝটিকা অভিযানের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর পুতিন প্ল্যান বি সক্রিয় করেন। সেকারণে এখন তিনি পদ্ধতিগতভাবে ইউক্রেনীয় ভূমি জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, শহর পোড়াচ্ছেন, ইউক্রেনীয়দের নিঃশেষ করতে এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে শান্তিপ্রিয় বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছেন।
দুই চেচেন যুদ্ধের সময় আপনি কি গ্রোজনিতে ছিলেন?
হ্যাঁ, উভয় যুদ্ধেই ছিলাম। প্রথম যুদ্ধের সময় আমি শুধু এক শিশু ছিলাম। ১৯৯৪ সালে আমার বয়স ছিল নয় বছর। আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগে ২৬ নভেম্বর, আমি প্রথম ধ্বংস হওয়া রুশ ট্যাংক এবং রুশ সেনা মরদেহ দেখেছিলাম। এক চত্বরে মানুষেরা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করছিল – এটি ছিল ভয়ঙ্কর দৃশ্য। শিশু হিসেবে এগুলো আমার ওপর একটি জোরালো মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে আর আমি বুঝতে শুরু করি যুদ্ধ আসছে। তারপর ১১ ডিসেম্বর ‘সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের অভিযান’ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয় – নিশ্চিতভাবে রাশিয়া কখনোই কোনও যুদ্ধকে যুদ্ধ বলে না। তারা সবসময় অভিযান বলে থাকে।
চেচেন ভিন্নমতালম্বী তুমস আব্দুরখমানভ
(চেচেন ভিন্নমতালম্বী তুমস আব্দুরখমানভ)
প্রথম যুদ্ধে আমি যদি ঠিকঠাক বুঝতে নাও পারি যে কী ঘটছে, দ্বিতীয়টিতে তা পেরেছিলাম এবং ভয় পেয়েছিলাম। মনে আছে, যখন তারা গ্রোজনির কেন্দ্রীয় বাজারে বোমা হামলা করে, তারপরের দিন সেখানে গিয়েছিলাম এবং এটা ছিল এক মর্মান্তিক দৃশ্য। ততক্ষণে মানুষ মরদেহ নিয়ে গেছে, কিন্তু সেখানে রক্ত, ফাঁকা রাস্তা, ভাঙা জানালা আর মারাত্মক নীরবতা ছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধের ছবি এবং ফুটেজ কি চেচেন যুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে?
যখন দেখি চেচনিয়া থেকে যাওয়া রুশ সেনারা ইউক্রেনের রাস্তায় সাঁজোয়া যানে বসে আছে, তখন গ্রোজনি দখলের পর সেখানে শিশু হিসেবে দেখা রুশ ট্যাংক এবং যানবাহনগুলোর কথা মনে পড়ে। আমরা শিশুরা সেগুলোর কাছে দৌড়ে গিয়ে তাদের মাঝের আঙুল দেখিয়েছিলাম। এটি ছিল প্রতিবাদের একটি ধরন, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের আমাদের উপায়।
আর এখন এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়, যখন আমি আবার ইউক্রেনে রুশ সেনাদের দেখি, এবং তাদের মধ্যে চেচেন, যারা চেচনিয়ায় একই রকম দৃশ্য দেখেছে কিংবা তাদের বাবা-মা দেখেছে এবং এখন তারা ইউক্রেনে আছে এবং ইউক্রেনীয়দের হত্যায় অংশ নিচ্ছে। এটি বিরক্তিকর।
ইউক্রেন নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে শুরুতে চেচনিয়ার উপর অনেক জোর দেওয়া হয়, প্রায় এমন ছাপ পড়তে শুরু করে যে, ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে নয়, চেচনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। চেচেন জনগণ পুতিনের আগ্রাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে- এটা দেখা খুবই বেদনাদায়ক। পশ্চিমারা আমাদের রাজনীতি বুঝতে চায় না, জানে না যে আমাদেরও একটি যুদ্ধ করতে হয়েছে, আমরা এখনও দখলদারের কবলে রয়েছি, কাদিরভ চেচেন রাষ্ট্রপতি নন বরং ক্রেমলিন নিযুক্ত এক আমলা, চেচেন জনগণ এখনও স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সংবাদ পরিবেশন বদলাতে শুরু করেছে আর তা দেখে ভালো লাগছে।
বিপর্যস্ত ইউক্রেন
(বিপর্যস্ত ইউক্রেন)
চেচেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পান?
ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে আসা ছবিটি আলাদা, হয়তো ইতিবাচকও। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ক্ষমতাধর এবং জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিমান হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের কিছুই ছিল না, তাই আমাদের লুকিয়ে থাকতে হতো। ইউক্রেনীয়রা লুকিয়ে থাকছে না, তারা যুদ্ধ বিমানগুলো ভূপাতিত করতে সক্ষম।
কোনও সরঞ্জাম ছাড়াই আমরা দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। আমাদের কাছে যে অস্ত্র ছিল তা হয় রাশিয়ানদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া নয়তো কিনে নেওয়া। আমাদের কোনও কামান কিংবা সাঁজোয়া যান ছিল না।
সমর্থনের দিক থেকেও পার্থক্য রয়েছে। দুনিয়ার কেউ আমাদের সমর্থন করেনি।
আপনি কি মনে করেন এর সঙ্গে ইসলামফোবিয়ার কোন সম্পর্ক আছে?
আমি সেরকম বলবো না। কারণ পশ্চিম কিংবা মধ্যপ্রাচ্য (মুসলিম দেশগুলো) থেকে কোনও সমর্থন পাইনি। কোনও জায়গা থেকে সমর্থন পাইনি। প্রশ্ন ছিল ওই সময় রাশিয়া কী ভাবছে। পুতিনকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে দেখা হতো, যিনি ককেশাস অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন।
আমরাও কিছু ভুল করেছিলাম। কিন্তু বিশ্ব আমাদের কথা শুনতে চায়নি, তারা আমাদের চরমপন্থী, সন্ত্রাসী হিসেবে দেখেছে। সেখানে রুশ প্রোপাগান্ডা চালানো মানুষ ছিল, যারা এসব বলেছিলেন আর কেউ আমাদের নেতাদের কথা শোনেনি, তারা শান্তির জন্য, আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
রুশ হামলায় বিধ্বস্ত ভবন
(রুশ হামলায় বিধ্বস্ত ভবন)
আজকে পৃথিবী বুঝতে পেরেছে, পুতিন ভাল লোক নন, তাকে চেচনিয়ায় থামানো উচিত ছিল। তারা যদি তা করত, তাহলে জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, ডনবাস এবং আজকের ইউক্রেন সংঘাত হতো না। তারা তা করেনি, ফলে আজ এই দানব পুরো দুনিয়াকে তটস্থ রেখেছে।
ইউক্রেনের মতো অন্যান্য ভৌগলিক এলাকায় চেচেনরা উভয় পক্ষে লড়ছে, আপনি কি মনে করেন চেচেন সংঘাত এখনও চলমান?
লড়াই এখনও শেষ হয়নি আর তা হবেও না, যতক্ষণ আমরা আমাদের মুক্ত না করছি কিংবা মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা বাদ না দিচ্ছি। কিন্তু মনে হয় আমরা হাল ছাড়ব না। কোনও জনগোষ্ঠীকে অন্য রাষ্ট্রে যোগ দিতে হলে তা স্বেচ্ছায়, গণভোটের মধ্য দিয়ে করতে হয়। কিন্তু দখলদারিত্বের মধ্যে থেকে গণভোট আয়োজন সম্ভব নয়।
অবশ্যই, আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। এই মুহূর্তে, আমরা সামরিকভাবে তা করছি না, কারণ আমাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পুনরুদ্ধারের জন্য মানুষের সময় প্রয়োজন। আর যখনই আমরা সুযোগ পাবো, আমরা আবার বিদ্রোহ করবো। যদি কোনও যৌক্তিক মানুষ ক্ষমতা নেয় (মস্কোতে)এবং বুঝতে পারে যে তাদের যেতে হবে এবং আমাদের সঙ্গে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, তাহলে এটি যুদ্ধ ছাড়াই হতে পারে। কিন্তু তারা যদি একই রকম সাম্রাজ্যবাদী হয়ে থাকে, তাহলে উচ্চ মূল্য পরিশোধ না করে আমাদের স্বাধীনতা জয়ের কথা কল্পনা করা কঠিন।
ইউক্রেনের যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে বলে আপনি মনে করেন?
এখন যেহেতু রাশিয়া সম্পূর্ণরূপে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, তারা হয় জিতবে বা প্রত্যাহার করতে হবে এবং পরাজয় স্বীকার করতে হবে, যা এড়াতে তারা সবকিছু করবে। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা এখন যেভাবে যুদ্ধ করছে এবং একই আন্তর্জাতিক সমর্থন অব্যাহত থাকলে, আমি মনে করি তারা সফলভাবে প্রতিরোধ করবে এবং এমনকি পাল্টা আক্রমণে যাবে।
কিন্তু সার্বিক ফলাফল জানা কঠিন। ইউক্রেনীয়রা তাদের সব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হতে পারে। অথবা পরের দিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে। অথবা আমরা ঘুম থেকে উঠে শুনতে পারি যে পুতিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। আমরা জানতে পারব না কীভাবে এটি ঘটেছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারব যে তার ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বৃদ্ধ লোকটি ক্ষমতা হারিয়েছে এবং তার যত্ন নেওয়া উচিত। এমনকি রাশিয়ার ভেঙ্গে পড়াও একটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.