অসচ্ছলদের ‘বীর নিবাস’ ক্ষমতাবানদের কব্জায়!

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর দুর্গাপুরে ‘অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’ প্রকল্প চলে গেছে সচ্ছল ও ক্ষমতাবানদের কব্জায়। বাছাই কমিটি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে বিত্তবানদের নাম চ‚ড়ান্ত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লেখাপড়া না জানায় এবং ওপর মহলে তদবির করতে অক্ষম হওয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুনছুর আলী প্রামানিকের নাম বাদ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুর রহমান (মুক্তিযুদ্ধকালীন ইপিআর সৈনিক, নম্বর ১৫৮৫৪) মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাকে বাদ দেয়া হয়েছে প্রভাব খাটিয়ে।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে সারাদেশে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। গত বছরের ১৬ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪ হাজার ১২২ কোটি ৯৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার এ প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ রয়েছে আগামী বছরের অক্টোবর পর্যন্ত। প্রকল্প অনুমোদনের পর অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়।
সূত্র জানায়, তালিকায় রাজশাহীর দুর্গাপুরে ১২ জনের নাম সুপারিশ করে পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের নাম পাস হয়ে আসে। তবে বীর নিবাসের বাজেট দেয়া হয় ৯ জনের। বাদ দেয়া হয় ৩ জনকে। ১২ জনের তালিকায় ৪ নম্বরে ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনছুর আলীর নাম। ৮ নম্বরে আরেক অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনিসুর রহমান মোল্লার নাম থাকলেও তাকেও রহস্যজনকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। ১১ নম্বরে থাকা জোনাব আলীও বাদ পড়েন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বীর নিবাস পাওয়া মো. হাবিবুর রহমান গাজীর জমির পরিমাণ প্রায় ৮ বিঘা। এক দাগেই রয়েছে ১.৭৮ একর (৫ বিঘার বেশি) জমি। জমিগুলোর কাগজপত্রও ভোরের কাগজের হাতে এসেছে। তিনি দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের আপন মামা শ্বশুর। তালিকায় হাবিবুরের নাম ছিল ৭ নম্বরে। এছাড়া ৫ নম্বরে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ও ম নুরুল আলম হিরুর নামেও বরাদ্দ হয়েছে ঘর। তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার জমি রয়েছে প্রায় ১৮ বিঘা। হিরু স্থানীয় সংসদ সদস্যের ‘ডান হাত’ খ্যাত আ.লীগ নেতা আমিনুল হক টুলুর শ্বশুর। ১২ নম্বরের মৃত জোনাব আলীর স্ত্রী ঘর পেয়েছেন। তিনিও ১৩ বিঘা জমির মালিক। বীর নিবাস পাওয়া কয়েকজনের সন্তান সরকারি চাকরিজীবী। অথচ ৮ নম্বরে থাকা আনিসুর রহমান মাত্র ২ বিঘা জমির মালিক হয়েও পাননি বীর নিবাস। আর মুনছুরের এক বিঘা জমিও নেই। ১৬ শতাংশের বসতভিটায় টিন দিয়ে তৈরি ছোট্ট একটি ঘরে থাকেন তিনি। ১১ শতক জমিতে ফসল আবাদ করে কোনোমতে দিন কাটে তার।
তথ্যমতে, উপজেলা পর্যায়ে ৫ সদস্যবিশিষ্ট বাছাই কমিটির তিনজন সরকারি কর্মকর্তা। কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সদস্য সচিব উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোনীত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রয়েছেন কমিটিতে। তবে কমান্ডার না থাকলে সেক্ষেত্রে ইউএনওর প্রতিনিধি হিসেবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকবেন। বাছাই কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন না এই দুই মুক্তিযোদ্ধা। অসচ্ছলদের বাদ দিতে ক্রমিক নম্বরও অনুসরণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুনছুর আলী প্রামানিক বিটিসি নিউজকে বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না, উপরের লোকদের, ওই এমপি ও চেয়ারম্যানকে ধরতে পারিনি, তাই ঘর পাইনি। ঘর না পাওয়া আমরা তিনজনই অসচ্ছল। তাও ঘর পেলাম না।
আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতি নিয়ে পাঁচজনের পরিবার। সবার খাবার জোগাতে বৃদ্ধ বয়সেও মাঠে ছুটতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা নেতারা আমাকে বলেছিল, তোমাদের বাড়ি হয়ে গেছে। কারো কাছ যেতে হবে না, কিছু বলতেও হবে না। যখন অন্যদের ইট নামতে শুরু করে; তখন বলা হয়, তোমাদের ঘর পরে হবে। বুঝে উঠতে পারছি নাÑ কাকে কী বলব। বলেও তো কোনো লাভ নাই।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য মনোনীত বাছাই কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদ ইনসান বিটিসি নিউজকে বলেন, আমি মিটিংয়ে ছিলাম না। পরে একদিন ইউএনও ডেকে স্বাক্ষর চেয়েছিল, গিয়ে স্বাক্ষর করে চলে এসেছি। কমিটির আরেক সদস্য শ্রী সন্তোষ কুমার সাহা বলেন, বাছাইয়ে অনিয়ম হয়েছে।
তবে স্বচ্ছভাবে তালিকা হয়েছে দাবি করে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা বিটিসি নিউজকে বলেন, কমিটি যাদের নাম দিয়েছে, তাদের নামই চ‚ড়ান্ত হয়েছে। রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আবাসন নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এম ইদ্রিস সিদ্দিকী বিটিসি নিউজকে বলেন, দূর্গাপুরে ৯ জনের বাজেট দেয়া হয়েছে। তালিকা থেকে ক্রমিক অনুযায়ী বীর নিবাস পাওয়ার কথা, কিন্তু মাঝ থেকে তাদের নাম কেন বাদ পড়ল বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন বলতে পারবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি সাইদুর রহমান / রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.