অশ্লীলতা-নোংরামি দিয়ে রাজশাহীতে ভালবাসা দিবসের বিদায়!

নিজস্ব প্রতিবেদকফেব্রুয়ারি মানেই স্বরণীয়। ফেব্রুয়ারি মানেই উৎসব। ভাষার এই মাসটির আছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। আছে বিশ্ব সম্পর্কিত একাধিক দিবস। বাঙ্গালী তরুণ তরুণীদের প্রথম দু’সপ্তাহ চলে ভিন্নরকমভাবে। প্রতিবছর উৎসব ভিন্নরকম মোড় নেয়। ভাষার মাসের মূল তাৎপর্য গ্রহনে পিছপা থাকলেও বিশ্ব ভালবাসা দিবসের নোংরামি কার্যকলাপে খুবই তৎপর কলেজ-ভার্সিটির কিছু ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ শিক্ষার্থী। কিছু বললে ভুল হবে ; সিংহভাগ শিক্ষার্থীই বিপথগামী।

একদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বাঙ্গালী কালচারে রূপদানের অপপ্রয়াস। অপরদিকে পেটে তিন বেলা উন্নত দানা না ঢুকলেও ‘লাল গোলাপ’ কিনে ক্ষণিকের প্রিয় মানুষটিকে দেয়ার অতি আবেগ প্রবণতা।

শিক্ষানগরী রাজশাহীতে বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তথাকথিত বিশ্ব ভালবাসা দিবস বিদায় হলো। আনুষ্ঠানিকতা চলছিল মাসের শুরু থেকেই। যুবসমাজে সাড়া ফেলেছিল অন্যরকমভাবে। তবে চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবারে। সকাল থেকেই রাজশাহীর আবহাওয়া ছিল গোলাপময়। নানারকম ফুলে নগরীর জিরো পয়েন্ট ফুলপট্টি তো মুহুমুহু গন্ধে বিমোহিত। তবে দামও ছিল চড়া। ১০ টাকার ফুল বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। এদিন বেশ লাভবান হয়েছেন ফুল বিক্রেতারা।

শফিকুল নামের এক ফুল বিক্রেতা বিটিসি নিউজকে বলেন, মোটামুটি ভালই লাভ হয়েছে। সারাবছর এরকম হলে তো ভালই হয়।

ফুল দোকানিরা বিটিসি নিউজকে জানান, সাধারণ দিনগুলোতে গোলাপ ১০ থেকে ১৫ টাকা প্রতি পিস বিক্রি হলেও বিশেষ দিনগুলোতে গোলাপ ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। রজনীগন্ধার স্টিক ১৫-২০ টাকা, ফুলের তোড়া সর্বনিম্ন সাড়ে ৩শ’ থেকে ১ হাজার টাকা, জারবেরা ২০ থেকে ৩০ টাকা। স্বাভাবিক দিনে প্রতি হাজার গাঁদা ফুল ৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও বিশেষ দিনগুলোতে ৮০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এখানকার ফুল ব্যবসায়ীরা ঢাকা, যশোর, কালিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ফুল আমদানি করে বিক্রি করে থাকেন।
নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টের পুষ্প বিতানের মালিক আবুল কাশেম জানান, সারা বছরের মধ্যে এ সময়টি এমন একটি সময় পরপর দুই দিন ফুলের চাহিদাটা অত্যন্ত বেশী থাকে। এজন্য ফুলের দাম বাড়াটাই স্বাভাবিক। ফুল এমন একটি জিনিস যা বেশিদিন ধরে সংরক্ষন করে রাখার উপায় নেয়। তাই অধিক চাহিদার কারনে দাম বেশিই থাকে।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নগরীর জিরো পয়েন্টে অবস্থিত ১০-১৫ টি  দোকানে শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই ৬০-৭০ লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি হয়। এই মাসে বেশকটি উৎসব থাকে। তবে বিশেষভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক বেচাকেনা জমজমাট চলে।

তবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে হলেও শিক্ষার্থীরা ফুল আদানপ্রদান থেকে পিছপা হননি। যেখানে একটি ফুলের টাকা দিয়ে মেসে ৪/৫ দিন তিনবেলা খাবার হয়; সেখানে এরকম ফুল কিনে টাকার অপচয়ও ছিল বেশ সমালোচিত। অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাও বন্ধুদের সাথে এরকম উৎসব নিয়ে ব্যস্ত।

আর পার্কের কথা তো বর্ণনা করাই দুষ্কর। সকাল থেকেই তরুণ তরুণীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল পার্কচত্বর। বিশ টাকার টিকেট মূল্য বৃদ্ধি হয়ে ত্রিশ টাকা করা হলেও ভিড় ছিল রেকর্ডসংখ্যক।

নগরীর ভদ্রা পার্ক,জিয়া পার্ক চিড়িয়াখানা,পদ্মা গার্ডেন,পদ্মা নদীর চর,টি-বাধ, মুক্তমঞ্চসহ বিভিন্ন জায়গায় জোড়া জোড়া শিক্ষার্থীদের বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

সরেজমিনে ঘুরে শহরের বিভিন্ন স্থানে  তাদের অবৈধ কার্যকলাপও চোখে পড়েছে। জড়িয়ে ধরে একে অপরের সাথে মেলামেশা এবং কাপড়চোপড় এলোমেলো হয়ে তাদের আনন্দঘন মুহূর্তও ছিল লজ্জাজনক।

তবে দিন দুপুরে এতকিছু অশ্লীলতা চললেও কেউ কিছু বলছেন না। প্রশাসনও নিরব। যে যার মতো ঘুরছেন আর তাদের দেখে কেউ কেউ হাসি দিচ্ছেন কেউবা আবার আফসোস করে বলছেন,’এইতো ডিজিটাল পোলাপান’!

কিন্ত পার্ক কর্তৃপক্ষ টাকার জন্য এরকম ‘অশ্লীল আশ্রম’ তৈরি করে ব্যবসা করে চলেছেন। তারাও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। অবগত করা হলেও প্রশাসনেরও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলপ্রসূতে গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে  পড়তে আসা শিক্ষার্থীরাও সহজে  ঝুঁকছেন অশ্লীল পথে। তরুণরা নৈতিকতা হারাচ্ছেন ; নষ্ট হচ্ছে হাজারো মেয়ের জীবন।  একটা ‘গার্লফ্রেন্ড’ ম্যানেজ মানেই যেন ‘জান্নাতের শান্তি’ হাতের মুঠোয়!
যদিও তা শিক্ষিতমহলের জন্য বেশ লজ্জাজনক।

সবকিছুর মধ্য দিয়ে শিক্ষানগরীতে ভালবাসা দিবসের নামে ‘বৈধ ইভটিজিং’ দিবসটি বিদায় নিল। গোলাপ দিয়ে শুরু এবং শারীরিক সম্পর্ক দিয়ে শেষ করেই এবছরের মতো বিদায় দিল অন্যতম নিকৃষ্ট এই দিনটিকে। দিন শেষে ফলাফল, হাজার হাজার টাকা অপচয়। আর হাজারো পবিত্র মেয়ের জীবন নষ্ট!

গ্রাম কিংবা শহরের ছেলেরা শুধু ‘গার্লফ্রেন্ড’ ম্যানেজ করে এসকল অশ্লীল কার্যকলাপ করে চলেছেন। তাদের সাথে কথা বললে না প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা স্টুডেন্ট,পড়ালেখা হবে,বাট ‘ইনজয়’ তো করতে হবে।একটাই জীবন। এই বয়সে যদি একটু ইনজয় না করব তাহলে কেমন হলো? বছরে একটা স্পেশাল দিন পাচ্ছি। বন্ধুদের নিয়ে এইদিনে একটু আনন্দ করছি তাতে আপনার সমস্যা কি?

তবে তরুণ তরুণীদের সচেতনতা নিয়ে কাজ করা সূর্যকিরণ বাংলাদেশ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল মনে করেন, নৈতিকতা রক্ষার্থে সরকারের জোরালো ভূমিকা দরকার। অন্যথায় বিপথগামী এই তরুণ তরুণীরা বিপথগামী হয়ে যাবে।

প্রচলিত প্রেমের বিরুদ্ধে কাজ করে যাওয়া তরুণ সংগঠন প্রেম বঞ্চিত সংঘের সভাপতি মোল্লাহ মোহাম্মদ সাঈদ বিটিসি নিউজকে বলেন,এসমস্ত অপসংস্কৃতির নিরসন জরুরী। শিক্ষার্থী মহলে এর কুপ্রভাব উদ্বেগজনক।

তবে সাংবিধানিকভাবে ভালবাসা দিবসের কোনো বৈধতা আছে কি না জানতে চাইলে রাজশাহী জর্জ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এ.এন. মোতাসিম বিল্লাহ বিটিসি নিউজকে বলেন,এটা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও বেআইনি। ভালবাসা দিবসের রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই।

তবে দিবসের নামে অশ্লীলতা কোনো অপরাধের মধ্যে পড়ে কি না এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এটা তো অবশ্যই নৈতিকতা বিবর্জিত। দণ্ডবিধি ২৯০ ধারা ও ৩৫৪ ধারা মোতাবেক অপকর্মকারীদের আইনের আওতাভুক্ত করে শাস্তি দেয়া যেতে পারে।
দিবসের নামে এসব অপসংস্কৃতি চর্চাকারীদের অবৈধ কার্যকলাপে বাধা দেয়া উচিত বলেও মনে করেন সিনিয়র এই আইনজীবী।

তবে সচেতন মহলের জোরালো দাবি, এবছরই যেন এর দাফন হয়। দেশ থেকে সমূলে নির্মূল করে তরুণ সমাজকে রক্ষা করা।
নতুবা তাদের আশঙ্কা, খুব শীঘ্রই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসে ভূপতিত হবে।

রাজশাহীবাসীর প্রত্যাশা, কোনো উৎসবের নামে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করা না হয়। প্রশাসন ও সরকারের বিশেষ হস্তক্ষেপে দিবসের নামে এসব অপসংস্কৃতি এবং নোংরামি প্রতিরোধ করা হোক।

রাজশাহীকে নিরাপদ রাখতে এবং নৈতিকতা ধরে রাখতে এসব অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে প্রত্যয়ী সচেতন সমাজ।

উল্লেখ্য, বিশ্ব ভালবাসা দিবসের রূপ নিয়ে প্রচলিত এই অপসংস্কৃতি সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে আগমন ঘটে।সাপ্তাহিক একটা পত্রিকায় সাংবাদিক শফিক রেহমানের একটা লেখার মধ্য দিয়ে এদেশে এর আগমন হয়। তারপর বিভিন্ন মিডিয়ার অপপ্রচারে এক শ্রেণীর ‘আত্মভোলা’ তরুণ তরুণীদের কাছে দিবসটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, তথাকথিত এই ভালবাসা দিবসের সাথে বাঙ্গালী জাতির কিংবা মুসলমানদের ইসলাম ধর্মের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি আমানুল্লাহ আমান।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.