রাউজানে অবৈধ ইটভাটার জন্য জলাশয়ে বাঁধ দিয়ে কাটা হচ্ছে জমির টপ সয়েল : ব্যহত হচ্ছে কৃষিখাত

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার খালের সঙ্গে সংযুক্ত জলাশয়ে বাঁধ দিয়ে গত দুই মাস ধরে অন্তত ৩০ একর কৃষিজমির টপ সয়েল কাটা হয়েছে অবৈধ একটি ইটভাটার ইট তৈরির জন্য। খালের জোয়ারের পানি যাতে জমিতে প্লাবিত করতে না পারে, এ জন্য অবৈধভাবে বাঁধ দেন ইটভাটা কর্তৃপক্ষ। খালের পাশের জমি থেকেই মাটি নেওয়ার জন্য ২০ থেকে ২৫ ফুট গভীর করে গর্ত খোঁড়া হয়েছে।
এর ফলে খালের পানি যারা সেচের কাজে ব্যবহার করতেন, তারা এখন বিপাকে পড়েছেন। অনেক চাষা এবারের মৌসুমে চাষ করতে পারেনি। গভীর করে কৃষি জমির মাটি কাটার কারণে আশপাশের অনেক জমিতেই ভাঙন দেখা দিয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পরিবেশদূষণের দায়ে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে রাউজানের মোকামীপাড়া গ্রামে অবস্থিত ইটভাটাটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহ পার না হতেই পূনরায় চালু করা হয় ইটভাটাটি। চালুর পর হালদার সঙ্গে সংযুক্ত সকর্দা খালের একটি জলধারায় বাঁধ দিয়ে জমির মাটি কাটা শুরু করে ইটভাটা কর্তৃপক্ষ।
গত বুধবার মোকামীপাড়ার এ আলী ব্রিকস নামের এ ইটভাটায় পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, হালদার শাখা সর্কদা খালের এক পাশের লেকে ২০ থেকে ২৫ ফুট মাটি দিয়ে ভরাট করে পানি আটকানো হয়েছে। ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার এলাকার কৃষিজমি খনন করা হয়েছে, যার গভীরতা ২০ থেকে ২৫ ফুটের মতো। খালের এক পাশে বাঁধ দেওয়ায় চাষের জমিতে পানি দিতে পারছেন না এলাকার কৃষকেরা। পরিদর্শনে আরও দেখা যায়, খনন করা ওই জমির তিন পাশে অন্তত ৫০ একর জমিতে নানান সবজির চাষ করেছেন কৃষকেরা।
বাঁধ দিয়ে এখান থেকে মাটি কেটে খনন করায় ওই সব ফসলি জমি ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি শীতকালীন সবজিখেতে সেচ দিতে দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষকেরা।
একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামের ২০০ মিটার দূরত্বে এই ইটভাটার অবস্থান।
ইটভাটার মালিকেরা ব্যক্তিগত জমি থেকে মাটি কাটার কথা বললেও খাসজমি থেকেও তারা মাটি কাটছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি থেকেও মাটি কাটা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দা তাসলিমা আকতার। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা ইজারা নিয়ে বসবাস করেন। তাদের ঘরের পাশ থেকেও মাটি কেটে এই ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক নাজমুল আলম বলেন, তিনি এ মৌসুমে কয়েক একর জমিতে সবজি চাষ করেছেন। এক মাস ধরে খালের পাশে বাঁধ দেওয়ায় তারা চাষ করা শীতকালীন সবজিতে পানি দিতে পারছেন না। তার মতো আরও ২০ থেকে ৩০ জন কৃষক একই সমস্যায় আছেন।
ওই এলাকার ২০ একর জমির মালিক সৈয়দ মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, তাদের জমির পাশ থেকে মাটি কাটায় এক একরের মতো জমি তলিয়ে গেছে, যা এখন হাতছাড়া হয়ে খাদে চলে গেছে। এ ছাড়া মাটি কাটার কারণে জমির ভাঙন অব্যাহত আছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, সামনের বর্ষায় আরও জমি খাদে তলিয়ে যাবে।
এই অবৈধ ইটভাটার মালিক পাশের ইউনিয়ন উরকিরচরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল আলমের তিন ছেলে। তাদের একজন জাহেদুল আলম গত মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ইটভাটাটির বৈধতা নেই। তিনি বলেন, ‘কারও ক্ষতি করে আমরা ইটভাটা চালাচ্ছি না। কৃষিজমির মাটি যেখান থেকে কাটা হচ্ছে, সেগুলো আমাদের কেনা জমি।’ তবে এখান থেকে মাটি কাটার কারণে অন্যের জমি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেটি তিনি তদারক করে দেখবেন।
হালদাপাড়ে অবৈধ ইটভাটা আবার চালু করা প্রসঙ্গে নদী গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদার মতো দেশের জাতীয় ঐতিহ্য এ নদীরপাড়ে ইটভাটা থাকা ক্ষতিকর। কারণ ইটভাটার ধোঁয়ায় নদীর জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অংগ্য জাই মারমা বলেন, কৃষিজমির টপ সয়েল কেটে ইট বানানোর সুযোগ নেই। কেউ করলে দণ্ডনীয় অপরাধ। ওই ভাটায় খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, এ আলী ব্রিক ইটভাটাটির কোনো নিবন্ধন নেই। এটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন অভিযান করলে তারা সহযোগিতা করবেন।
চট্টগ্রামের পরিবেশ সংগঠন এ্যাডভিশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব মো মাসুদ রানা বলেন, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে গ্রামের ভিতরে অযৌক্তিকভাবে ইটভাটা করে পরিবেশ ধ্বংস করছে তারা। এটা কখনো পরিবেশ সম্মত নয়। দ্রুত এ পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা বন্ধে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান।
এদিকে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের মহাসচিব মো কামাল উদ্দিন বলেন, রাউজানে মোকামী পাড়ায় যে ইটভাটা রয়েছে সেটি প্রশাসন একবার ঘুরিয়ে দিলেও কর্তৃপক্ষ প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পূনরায় চালু করেছে। তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে এবং পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা বন্ধ করতে হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান স. . জিয়াউর রহমান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.