করেছেন গ্রেফতার বাণিজ্য \ ক্ষুদ্ধ নেতৃবৃন্দ: বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানীর অভিযোগ সদর ওসি মেহেদী’র বিরুদ্ধে

বিশেষ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি: সদ্য বিলুপ্ত সংসদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং গত ৫ আগষ্ট ও ৬ আগষ্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়া (মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে সংসদ বাতিল) আওয়ামীলীগ সরকারের নির্দেশে আওয়ামী বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানী এবং গ্রেফতার বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান এর বিরুদ্ধে। তিনি সদর থানায় যোগদানের পরই শুরু করেন গ্রেফতার ও অর্থ বানিজ্য।
কোটা আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের যোগসাজস ও অংশ গ্রহনের দায়ে অভিযুক্ত করে সরকারের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে এই অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান। তারপরও বহাল তবিয়তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওসি মেহেদী হাসান। ফলে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, ১৫ জুলাই/২৪ শিক্ষার্থীদের লাগাতার কোটা আন্দোলন শুরুর পরই চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে সদর থানা পুলিশ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান এর নির্দেশে রাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশী চালিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে পুলিশ সদস্যরা। আন্দোলন চলকালিন সময়ে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের মাঝে নেমে আসে গ্রেফতার আতংক। রাত হলেই নেমে আসতো ভয়ংকর পরিস্থিতি। ঘুমাতে পারেন নি রাতের পর রাত। এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীরা। মামলা বা ওয়ারেন্ট থাক বা না থাক, পূর্বের তালিকা থেকেই বিএনপি-জামায়াতের বেশ কিছু নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা শহরের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বলেন, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিনা দোষে তার এক আত্মীয়কে ধরে নিয়ে যায় সদর থানা পুলিশ। তাকে দেখতে এবং তাকে কোন অপরাধে আটক করা হয়েছে, জানতে গেলে ক্ষিপ্ত হয়ে যান ওসি মেহেদী হাসান। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ধরে নিয়ে যাওয়া আত্মীয়র বিষয়ে বলতে যাওয়ায় ওসি অসৌজন্যমূলক আচরন করেন এবং বেশী তদবীর বা জানতে চাইলে আপনাকেও নিয়ে আসা হতে পারে বলেও হুশিয়ারী দেন ওসি। পরে আমার ওই আত্মীয়কে চালান দেয় এবং আওয়ামীলীগ সরকার পরিবর্তনের পর জামিনে বের হয়ে এসেছেন তাঁর ওই আত্মীয় বলেও জানান তিনি।
এব্যাপারে জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব আলহাজ্ব মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সদর থানায় যেসব ওসি দায়িত্ব পালন করেছেন, সকলেই আওয়ামীলীগ সরকারের মদদপুস্ট এবং বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপর হয়রানী-নির্যাতন, গ্রেফতার বানিজ্য করেছেন। এমনকি বাসায় গিয়ে ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সকলের সামনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। ছেলে কে না পেলে বাবা অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের ধরে নিয়ে গিয়ে অর্থ বানিজ্যও করেছে, মামলা দিয়ে আদালতেও পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বিএনপি নেতা-কর্মীরা অংশ গ্রহণ না করলেও মিথ্যা অভিযোগে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার হয়রানী করেছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান ওসিকে অবশ্যই সদর থানা থেকে সরাতেই হবে, এখানকার এস.আই, এ.এস.আইসহ আওয়ামীলীগের সকল মদদপুস্ট কর্মকর্তাকে বদলী করতে হবে।
তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, পুলিশের যেসব কর্মকর্তা আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে জেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা সকলেই কম বেশী বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের উপর অত্যাচার-হয়রানী করেছেন। গ্রেফতার আতংকে দিন কাটিয়েছে নেতা-কর্মীরা। এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হওয়ার দরকার বলেও মন্তব্য করেন জেলা বিএনপির এই নেতা।
এব্যাপারে সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক লতিফুর রহমান জানান, আওয়ামীলীগ সরকারের তাবেদার হয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা যা করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। প্রশাসনের লোকজন এক একজন আওয়ামীলীগের নেতার চেয়েও বেশী আওয়ামীলীগার মনে হয়েছে। একরকমই শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জামায়াত বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে, গ্রেফতার বানিজ্যও করেছে সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান।
ওসির নির্দেশে জেলা জামায়াতের আমির দুপুরে বাসা থেকে আবু জার গিফারী, কাজী আব্দুল বারীসহ জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার এবং হয়রানী করেছে। অবশ্যই তাকে (ওসি) কে এ সদর থানা থেকে বদলী এবং নেতা-কর্মীদের হয়রানীর জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা স্বৈরাচার সরকারের খুশি করতে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন এবং এদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন বর্তমান দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাগণ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান এর গ্রেফতার ও গ্রেফতার বানিজ্য বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র মিডিয়াকর্মী বলেন-অভিযোগ রয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান থানায় যোগদান করার পর থেকেই বিভিন্নভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন লাগাতার শুরু হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার অভিযান চালায়। গ্রেফতার করে এনে অনেক কে টাকা নিয়ে (১০ থেকে ১৫ হাজার) ছেড়ে দিয়েছেন, টাকা দিতে না পারায় অনেক কে আদালতে সোপর্দ করেছেন। কোন অভিযোগ না থাকলেও শুধুমাত্র বিরোধী দল করায় এসব নেতা-কর্মীদের বিভিন্নভাবে হয়রানী নির্যাতন করেছেন।
এছাড়া তিনি যোগদানের পরই জেলা শহরের মহানন্দা ক্লিনিকে প্রসুতি মৃত্যুর ঘটনায় কৌশল করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেন এবং ভূক্তভোগী মৃতের স্বামী থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযোগ দায়ের না করতে বাধ্য করেন। এঘটনায় মিডিয়াকর্মীদের সাথেও দূর্ব্যাবহার করেন ওসি মেহেদী হাসান ও থানার এক এস.আই।
তিনি আরও বলেন, তার বদলীর আদেশ হলেও বর্তমানে দেশের ক্লান্তিকালকে পুজি করে এখনও ওসির দায়িত্বে আছেন। তবে, সদর থানায় এমন ওসি থাকলে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা শতস্ফুর্তভাবে দলীয় কার্যক্রম চালাতে হিমসীম খাবে বলেও মত দেন সিনিয়র এই সংবাদিক। এছাড়াও ওসি মেহেদী হাসানের গ্রেফতার বানিজ্যের বিষয়ে নানা মন্তব্য করেছেন কয়েকজন মিডিয়াকর্মী।
তবে, কোটা আন্দোলন চলাকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ সহনশীল আচরন করে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু জেলায় শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে জেলার বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ কোনটায় না থাকলেও উপরের নির্দেশে এই গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়।
সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মেহেদী হাসান এর গ্রেফতার বানিজ্য ও হয়রানীর বিষয়ে জানতে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিথ্যা সাজানো মামলায় গ্রেফতার হওয়া কাজী আব্দুল বারি জানান, গত ১৭ জুলাই মহানন্দা সেতুতে পলিটেকনিট এর শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে ঘন্টাব্যাপী বিক্ষোভ করে। সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচী শেষ করে। কিন্তু সদর থানা পুলিশের ওসি মেহেদী হাসানের নির্দেশে হামলা, সংঘর্ষ, বিষ্ফোরক উদ্ধার, পুলিশের উপর ককটেল হামলা দেখিয়ে একটি সাজানো মামলা হয়। এস.আই এনামুল হক বাদী হয়ে করা মামলায় আসামী করা হয় শতাধিক ও অজ্ঞাতনামা। সেই সাজানো মামলায় বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানী শুরু করে সদর থানা পুলিশ।
এই গ্রেফতারের অংশ হিসেবে আমাকে, জেলা আমির আবু জার গিফারী, মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার তহরুল, গণপরিষদের নেতা ওয়ালিদ, বারঘরিয়ার কালু মেম্বার, চুনাখালী মাদ্রাসার সুপার মাওলানা এত্তাজুল হকসহ প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জনকে গ্রেফতার করে এবং কারাগারে পাঠায়।
তিনি বলেন, প্রথমে আমাকে বাসা থেকে বাল্য বিয়ে পড়ানোর মিথ্যা অভিযোগের কথা বলে ওসির নির্দেশে থানায় নিয়ে গিয়ে জামায়াত কর্মী বলে ওই সাজানো বিষ্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে। এদিকে, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচী শেষ করার ব্যাপারে বারঘরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ একটি প্রত্যয়নপত্রও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এতে পুলিশের পেশাদারিত্ব ও ভাবমূর্তী নষ্ট করেছে। তাই, সাজানো মামলা দিয়ে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের হয়রানী, পরিবারের মাঝে আতংক, সম্মান ক্ষুন্ন কাজের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানাচ্ছি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান এর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানী বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ‘জানা নেই’ বলে ফোন কেটে দেন। এদিকে, তিনি বলেন, সদর মডেল থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা কোথায় যায়নি। সকলেই থানাতেই আছেন এবং কাজ করছেন।
উল্লেখ্য, এই অভিযানে জেলায় গ্রেফতার হয় বিএনপি-জামায়াতের ১০৭ জন নেতা-কর্মী। গত ৬ ও ৭ আগষ্ট কোটা আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হওয়া বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জামিনে মুক্ত হয় এবং কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন।
এদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান এর বদলীর আদেশ হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান কর্তৃক বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের উপর নির্যাতন, হয়রানী করায় কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবী জানিয়েছেন ভূক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.