এসডিজি অর্জনে শিশুর অধিকার বাস্তবায়ন


পিআইডি ফিচার: পৃথিবীতে একজন শিশুর আগমনের পর পরই নানা অধিকার ভোগের অধিকারী হয়। মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের কাছ থেকে সেবা-যতœ, আদর, সোহাগ, ভালোবাসা ইত্যাদি পাওয়ার অধিকার লাভ করে। এরপর যতই বড় হতে থাকে তার অধিকার ততই বাড়ে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তার মত অধিকার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে একজন শিশুর জন্য। বর্তমানে বাংলাদেশের আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

এটা চরম সত্য যে, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলি অর্জনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একজন শিশুর যে অধিকার ভোগ করার কথা তা নিশ্চিত করাও একান্ত প্রয়োজন।

১৭ মার্চ জাতীয় শিশু, ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিশু অধিকার ও ৩ অক্টোবর বিশ^ শিশু অধিকার দিবস পালন করা হয় মহা আড়ম্বরে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশু অধিকার রক্ষার জন্য কাঠামোগত অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন সম্ভব হয়নি। বন্ধ করা যায়নি শিশু শ্রম ও শিশু নির্যাতন।

এখনো গণমাধ্যমে প্রায়ই শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়, দেশের ৫৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শাস্তি শিশুকে ভালো পথে নিয়ে যায়। ২৭ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি না হলে শিশুরা বখে যায় এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি দিলে শিশুরা শিক্ষকদের কথা শোনে। তাই সন্তানদের ভালোর জন্য ঘরে বাইরে শিশুদের উপর শাস্তি অথবা নির্যাতন চলছেই।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি শিশু। এর মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু দরিদ্র। এই দরিদ্র শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, পথশিশু, বাল্য বিবাহের শিকার শিশু এবং চর-পাহাড় ও দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোন রকম টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।

২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এবং শিশুদের দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশসহ সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বহুবিধ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
শিশু উন্নয়ন কার্যক্রম ঃ

১. শিশুর বিকাশে প্রারম্ভিক শিক্ষা (ইএলসিডি) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে গর্ভ থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের পারস্পরিক ক্রিয়ামূলক ঘর নিশ্চিতকরণসহ শিশু বিকাশের অনুকূল নিরাপদ পরিবেশ, বাড়ি, কমিউনিটি ও শিক্ষা কেন্দ্রে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে শিশুদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক, ভাষাগত ও আবেগিক বিকাশ সাধনপূর্বক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।

২. এনাবলিং এনভায়রনমেন্ট ফর চাইল্ড রাইটস (ইইসিআর) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুর অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে সামাজিক মূল্যবোধসমূহ সমুন্নত রেখে সুশীল সমাজ ও সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধিকল্পে কৌশলগত সুরক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ এবং সমাজে শিশু নিপীড়ন, নির্যাতন, সহিংসতা ও শোষণ থেকে তাদের রক্ষা করে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত সারা দেশে নির্বাচিত ২০টি জেলায় ৪০,০০০ শিশুর মধ্যে ২,০০০ টাকা হিসেবে ১৮ মাসব্যাপী ক্যাশ ট্রান্সফার কার্যক্রম চালু রয়েছে।

৩. এছাড়া দেশে নির্বাচিত ২০টি জেলায় ১৫,০০০ জন কিশোর কিশোরী (বয়স ১৪-১৮) এর মধ্যে প্রত্যেককে এককালীন ১৫,০০০ টাকা করে স্টাইপেন্ড প্রদানের কার্যক্রম চালু রয়েছে।

৪. শিশু উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছর ৪২টি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়।

৫. শিশু বিকাশের প্রারম্ভিক শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিকেন্দ্রে ৩০ জন (৪-৫ বছর বয়সী শিশু) করে ২,১০৯ কেন্দ্রে ঊধৎষু খবধৎহরহম ঋধপরষরঃরবং এর মাধ্যমে শিশু বিকাশ এবং প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা হয়।

৬. শিশুদেরকে অধিক হারে পাঠে মনোযোগী করে তোলার লক্ষ্যে ৫১টি শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে।

৭. শিশুদের জন্য একটি মাসিক “শিশু” পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

৮. এছাড়াও ৫ খন্ডে “শিশু বিশ^কোষ” প্রকাশ করা হয়েছে।

৯. বছরে প্রায় ৪ লক্ষ শিশু লাইব্রেরীতে বই পড়ার সুযোগ লাভ করে এবং লাইব্রেরীভিত্তিক প্রতিযোগীতায় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার শিশু অংশগ্রহণ করে।

১০. সারাদেশে ৬টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে মোট ৭০০ জন দুস্থ ও অসহায় শিশুকে সামাজিক সম্পৃক্ততাসহ শিশুর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।

১১. গার্মেন্টস ও কারখানার নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার কর্মসূচি চলমান।

১২. সারাদেশে ৪,৫৫৩টি ইউনিয়ন ও ৩৩০টি পৌরসভার মোট ৪,৮৮৩টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। ইভটিজিং বন্ধ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, জেন্ডার ভায়োলেন্স প্রতিরোধ, যৌন স্বাস্থ্য অধিকার, জন্ম নিবন্ধন, যৌতুক নিরোধ, শিশু অধিকার, নারী অধিকার, জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য দূর, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করাই ক্লাবগুলোর মূল লক্ষ্য।

২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে। ওই একই বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘে শিশু অধিকার বাস্তবায়ন বিষয়ক প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। আমরা চাই বাংলাদেশ শুধু তার অর্থনৈতিক সূচক নয়, শিশু অধিকার রক্ষার মতো আর্থসামাজিক সূচকেও বিশে^ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক।

এজন্য বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচার, শিশু শ্রম প্রতিরোধসহ শিশু অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি গণমাধ্যমসহ সামাজিক সংগঠনগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর শিশুর অধিকার রক্ষিত হলে ২০৩০ সালের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সহজ হবে।

সংবাদ প্রেরক (পিআইডি) মো. রুপাল মিয়া, সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.