বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: একটি কথা প্রচলিত আছে, সুদানের যেখানে আপনি মাটি খুঁড়বেন, সেখানে হয় সোনা, না হয় জ্বালানি তেলের খনি পাবেন। কিন্তু তাতে কী, প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর জনপদটি পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর একটি। ঐতিহাসিকভাবে বহুবর্ণ, বহুধর্ম এবং বহু জনগোষ্ঠীর দেশটির দুঃখ-দুর্দশার আধুনিক ইতিহাস এক শ বছরের বেশি পুরোনো।
অর্ধশতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ, পরিচয়ভিত্তিক বৈষম্য এবং একাধিক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সুদান ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো দুই টুকরা হয়ে যায়।
দুই টুকরা হওয়ার পরও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশটি যুদ্ধ, সংঘাত কিংবা দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পায়নি। ২০২৩ সালে নতুন করে অন্তর্ঘাতমূলক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সুদান। আফ্রিকার অন্যতম বৃহত্তম দেশটি কেন বারবার গৃহযুদ্ধ ও অন্তর্ঘাতমূলক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে, সুদান কি আবারও দুই টুকরা হবে, শান্তি আলোচনা কত দূর এগোল—এ লেখায় সে আলোচনা করা যাক।
ঔপনিবেশিক বিভাজন
মিসরে ১৮৭৯ থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে আহমেদ উরাবির নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী একদল সেনা কর্মকর্তা বিদ্রোহ করেন। নিজেদের সেনাবাহিনী ও সরকারে বিদেশি, বিশেষ করে ব্রিটিশ ও ফরাসি কমানো ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। বিদ্রোহ দ্রুত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ব্রিটিশরা কায়রোতে হামলা চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করে। তখন মিসর ওসমানী সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও বিদ্রোহ দমনের মধ্য দিয়ে দেশটিতে ব্রিটিশ প্রভাব স্থায়ী হয়।
উত্তর সুদানে এ সময়ে (১৮৮৫-৯৮) মাহদি শাসন জারি হয়। প্রতিবেশী মিসর এটাকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। তাই ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ ও মিসরের যৌথ বাহিনী হামলা চালিয়ে সুদানের মাহদি শাসনের অবসান ঘটায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলে মাহদি শাসন জারি হলেও ওই সময়ে সুদানের অন্যান্য অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিজেদের শাসন বজায় রেখেছিল, যা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চলে আসছিল।
বশিরের প্রায় ৩০ বছরের দমন-পীড়নের অবসানে সুদানের তরুণেরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, সেনাযুগের অবসান হলো, নতুন যুগের সূচনা হলো। গণতন্ত্র বুঝি সমাগত। কিন্তু আরব বসন্তের মতো সেই আশা মরীচিকার মতো মরুভূমির অপর প্রান্তে অধরাই রয়ে গেল।
সফলভাবে মাহদি শাসনের অবসান ঘটানোর পর ১৮৯৯ সাল থেকে সুদানকে শাসন করতে শুরু করে মিসর ও ব্রিটেন, যা অ্যাংলো-মিসরীয় কন্ডোমিনিয়াম নামে পরিচিত। মিসর সঙ্গে থাকলেও সবকিছু ব্রিটিশদের কথায় চলত। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের ব্রিটিশ শাসনের ফলে ধর্ম ও জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় সুদানে বিভক্তি তীব্র হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার লড়াই-সংগ্রামও বাড়তে থাকে।
এমন এক টালমাটাল সময়ে ১৯৫৬ সালে সুদানের নেতৃত্বের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের কন্ডোমিনিয়াম শাসনের বিলুপ্তি ঘোষণা করে ব্রিটিশ ও মিসর। জন্ম হয় প্রজাতন্ত্রী সুদানের।
প্রথম গৃহযুদ্ধ
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের আগের বছর, ১৯৫৫ সাল থেকে উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে কার্যত একধরনের গৃহযুদ্ধ চলছিল। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। দক্ষিণের পোজুলু, মুরু, নুয়ার, লোটুকো, মাদি, বারি, আছোলি, জান্ডে, ডিঙ্কাসহ নানা জাতিগোষ্ঠী মিলে ১৯৬৩ সালে সামরিক জোট ‘আনিয়ানিয়া’ গঠন করে। মা’দি ভাষার শব্দটির অর্থ ‘সাপের বিষ’, যা শক্তি ও প্রতিরোধের প্রতীক। তারা দক্ষিণের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ছিল।
দুই পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর উত্তর সুদানে আরব ও মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর তেলসম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে পশ্চাৎপদ দক্ষিণ সুদান। সেখানে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী এবং নানা আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর (অ্যানিমিস্ট) আধিপত্য ছিল।
দক্ষিণের অভিযোগ ছিল, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে উত্তরের আরব ও মুসলিমরা তাদের ওপর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আধিপত্য চাপিয়ে দিচ্ছে। ১৭ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর ১৯৭২ সালে আদ্দিস আবাবা চুক্তির মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। দক্ষিণ সুদানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। এ যুদ্ধে আড়ই লাখ থেকে পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ
গৃহযুদ্ধের একধরনের অবসান হলেও সুদানে নানা ধরনের সংকট ও বিশৃঙ্খলা লেগেছিল। এ পরিস্থিতিতে অভিন্ন জাতীয় পরিচয় তৈরি, রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর একাংশের সমর্থন নিয়ে ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট জাভর আল-নিমেইরি শরিয়াহ আইন চালু করেন।
১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নিমেইরি দক্ষিণ সুদানের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেন। এতে করে জাতীয় ঐক্যের বদলে উল্টো ফল হয়। নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দ্রুত ‘আনিয়ানিয়া ২’ গঠন করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি (এসপিএলএ) গঠিত হয়। তারা সুদান সেনাবাহিনী সুদানিজ আর্মড ফোর্সেসের (এসএএফ) বিরুদ্ধে দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধ করে।
বশিরের উত্থান-পতন
গৃহযুদ্ধের মধ্যেই ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন ওমর আল-বশির। বশির পূর্বসূরি নিমেইরির পথেই হাঁটেন। তাঁরা দুজনই ঔপনিবেশিক মিসরের সেনাবাহিনী থেকে আসা সেনা কর্মকর্তা।
১৯৮৫ সালে নিমেইরি পতনের পর শরিয়াহ আইন অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বশির তা আবার কড়াকড়িভাবে আরোপ করতে শুরু করেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠীকে কাছে টেনে নেন।
২০০৫ সালে কমপ্রিহেনসিভ পিস অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটে। ২২ বছরের এ গৃহযুদ্ধে প্রায় দুই কোটি মানুষ মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়।
শর্ত অনুযায়ী, গণভোটের মাধ্যমে ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যায়। দেশভাগের পরও আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সুদান তথা উত্তর সুদানে শান্তি আসেনি।
বশিরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দ্রুত রাজধানী খার্তুম, দারফুরসহ অন্যান্য বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। চার-পাঁচ মাসের বিক্ষোভের মুখে ২০১৯ সালে ওমর হাসান আল-বশিরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।
বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে সেনাবাহিনী তথা এসএএফ ও আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বশিরের প্রায় ৩০ বছরের দমন-পীড়নের অবসানে সুদানের তরুণেরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, সেনাযুগের অবসান হলো, নতুন যুগের সূচনা হলো। গণতন্ত্র বুঝি সমাগত। কিন্তু আরব বসন্তের মতো সেই আশা মরীচিকার মতো মরুভূমির অপর প্রান্তে অধরাই রয়ে গেল।
বুরহান ও হেমেদতির ক্ষমতা দখল
সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় বেসামরিক সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে সুদান গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, অনেকে এমনটা মনে করেছিলেন। কারণ, নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল, প্রণয়ন করা হয়েছিল নতুন সংবিধান।
কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ও আরএসএফ প্রধান জেনারেল হামদান দাগালো ওরফে ‘হেমেদতি’ যৌথভাবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। অন্তর্বর্তী সরকারের বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নবিশেষজ্ঞ আবদাল্লাহ হামদককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করেন।
বশির সরকার ২০০৩ সালে দারফুর বিদ্রোহ দমনের জন্য নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিজেদের সঙ্গে নেয়। এর মধ্যে ‘জানজাবিদ’ (রাতের অশ্বারোহী) ছিল অন্যতম। প্রধানত আরবদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনী নৃশংসতা ও লুটতরাজের জন্য কুখ্যাত ছিল।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে হামদককে আবার প্রধানমন্ত্রী করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেন। বুরহান নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং হেমেদতি তাঁর ডেপুটি হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। তাঁরা দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। কিন্তু জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করে।
দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে নতুন করে সুদানে বিক্ষোভ শুরু হয়। বুরহান ও হেমেদতি কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন করেন। খুন ও গ্রেপ্তার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। বর্তমানে বুরহান ও হেমেদতি—দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় রয়েছেন।
দারফুর যুদ্ধ ও হেমেদতির উত্থান
২০০৩ সালে সুদানের পশ্চিমাঞ্চলের চাদ ও লিবিয়া সীমান্তবর্তী দারফুরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট (এসএলএম) ও জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট (জেইএম) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়। এ সময় পুরোনো সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি-উত্তর (এসপিএলএ/এন) পুরোদমে যুদ্ধে যোগ না দিলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল।
বশির সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিজেদের সঙ্গে নেয়। এর মধ্যে ‘জানজাবিদ’ (রাতের অশ্বারোহী) ছিল অন্যতম। প্রধানত আরবদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনী নৃশংসতা ও লুটতরাজের জন্য কুখ্যাত ছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) অভিযোগ, দারফুর যুদ্ধে ফুর, জাঘাওয়া, মাসালিতের মতো অনারব জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুদান সেনাবাহিনী ও জানজাবিদ যৌথভাবে জাতিগত নিধন (জেনোসাইড) চালিয়েছিল। কয়েক দফা শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ২০১৪ সালের দিকে দারফুর যুদ্ধ শেষ হয়ে আসে। এ যুদ্ধে দুই লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় বলে ধারণা করা হয়।
যুদ্ধের শেষ দিকে ২০১৩ সালে জানজাবিদ ছোট আরও কয়েকটি মিলিশিয়া নিয়ে আরএসএফ নামে আত্মপ্রকাশ করে। বশির সরকার শুরুর দিকে তাদের ভাড়াটে সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। পরে তারা লিবিয়ায় খলিফা হাফতারের পক্ষে এবং ইয়েমেনে সৌদি জোটের অংশ হিসেবে যোগ দেয়। সুদানের সোনার খনির একটি বড় অংশ বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণে।
ক্ষমতার শেষের দিকে নিজের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ও আততায়ী হামলা ঠেকাতে আরএসএফকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বশির। কিন্তু বুরহানের সঙ্গে মিলে হেমেদতি তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। গ্রেপ্তার বশির বর্তমানে উত্তর সুদানে রয়েছেন।
বর্তমান সংকটের নেপথ্যে
শুরু থেকে বুরহান ও হেমেদতির মধ্যে নানা বিষয়ে দর-কষাকষি চলছিল। বিশেষ করে আসন্ন বেসামরিক সরকার কেমন হবে, তা নিয়ে বুরহান ও হেমেদতির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, হেমেদতির দাবি ছিল, আরএসএফের এক লাখ সদস্যকে সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করতে হবে। এরপর নতুন বাহিনীর নেতৃত্ব থাকবে তাঁর হাতে।
কিন্তু হেমেদতির এ প্রস্তাব নিয়ে বুরহানের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তাঁর আশঙ্কা হয়, হেমেদতি তাঁকে কৌশলে সরিয়ে দিতে চাইছেন। এ পরিস্থিতিতে দুজনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
চলমান অন্তর্ঘাতের শুরু
এমন এক উত্তপ্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরএসএফ সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী এটিকে হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে। প্রতিক্রিয়ায় এসএএফ সদস্যদের রাজধানী খার্তুমের রাস্তায় নামানো হয়। কয়েক দিনের উত্তেজনা শেষে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল খার্তুমে টানা অনেকগুলো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শুরু হয় তীব্র বন্দুকযুদ্ধ।
কোন পক্ষে আগে বন্দুক চালিয়েছে, তা নিয়ে এসএএফ ও আরএসএফ সদস্যদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান সংঘাতকে অনেক বিশেষজ্ঞ গৃহযুদ্ধ বলতে নারাজ। তাঁদের মতে, এটা মূলত জেনারেলদের ক্ষমতার লড়াই। সাধারণ মানুষ এর মাশুল গুনছে।
প্রায় তিন বছরের অন্তর্ঘাতমূলক সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় লক্ষাধিক মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১ কোটি ৪০ লাখের মতো মানুষ। দুই কোটির বেশি মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৬০ লাখের মতো মানুষ দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে রয়েছেন।
গণহত্যার অভিযোগ
আরএসএফের বিরুদ্ধে চলমান সংঘাতে দারফুরে অনারবদের গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। ২০২৪ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) দাবি করেছে, দারফুরে মাসালিত ও অন্যান্য অনারব জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরএসএফ ও তাদের মিত্র মিলিশিয়া বাহিনী জাতিগত নিধন চালিয়ে থাকতে পারে।
এর আগে একই মাসে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ সশস্ত্র ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শিশু ধর্ষণ ও নিপীড়নের অভিযোগ আনে। এক বছর বয়সী শিশুরাও এমন নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি। নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে কোনো কোনো শিশু আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনের পর জাতিসংঘ একটি তদন্ত পরিচালনা করে। এতে সুদানে জাতিগত নিধন সংগঠিত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেননি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁরা আরএসএফ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে আরএসএফ ও তাদের মিত্র মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে জাতিসংঘের তদন্তকারী কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, আরএসএফের যোদ্ধারা অনারব নারীকে যৌন নিপীড়নের সময় বর্ণবাদী ভাষায় গালিগালাজ করার প্রমাণ পেয়েছেন। আরএসএফের যোদ্ধারা অনারব নারীদের ‘আরব শিশু’ জন্ম দিতে বাধ্য করেছেন।
অবশ্য আরএসএফ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গণহত্যায় সহযোগিতা করার অভিযোগে সুদান সরকার আন্তর্জাতিক বিচার আদলতে (আইসিজে) সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল। কিন্তু আইসিজে মামলাটির শুনানি করতে রাজি হননি। আদালত জানান, এটা তাঁদের এখতিয়ারের মধ্যে নেই।
আমিরাত আইসিজের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। কিন্তু জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আরএসএফকে আমিরাতের সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের কাছে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আছে।
কোন দেশ ও গোষ্ঠী কার পক্ষে
সাতটি প্রতিবেশী দেশসহ মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কিছু দেশ সুদানে সেনাবাহিনী এসএএফ ও আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফের পক্ষে-বিপক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
পূর্ব দিকের ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া বর্তমানে আরএসএফকে সমর্থন দিচ্ছে। আরএসএফ একসময় ইথিওপিয়া টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল। জবাবে টিপিএলএফ সুদানের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে।
এসপিএলএ/এনসহ দারফুরে প্রায় সব বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরএসএফকে সমর্থন দিচ্ছে। পূর্ব দিকের ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া সীমান্তের অধিকাংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠীও আরএসএফকে সহায়তা করছে। তবে এই অঞ্চলের ‘বেজা কনফারেন্স’ নামে সুদানের পুরোনো রাজনৈতিক দলটি সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। বেজা কনফারেন্সের প্রধান মুসা মুহাম্মদ আহমেদ ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বশিরের উপদেষ্টা ছিলেন।
মিসরের সঙ্গে সুদানের সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ঐতিহাসিক। নীল নদের পানি ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশটি যথারীতি সেনাবাহিনীকেই সমর্থন করছে। চলতি সংঘাতে সুদান সেনাবাহিনীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক মিসর।
অঞ্চলবহির্ভূত সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) আরএসএফের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। ইউএইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশটি আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। দেশটির ড্রোন দিয়েই তারা সম্প্রতি সাফল্য পেয়েছে।
তবে আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ অস্বীকার করেছে আমিরাত। মূলত সোনার লোভে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশটি আরএসএফের পক্ষ অবলম্বন করছে।
সৌদি আরব সরাসরি কোনো পক্ষকে সমর্থন করছে না। দেশটি মূলত শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রিয়াদের বিরুদ্ধে সুদান সেনাবাহিনীকে সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি আরব ও আমিরাত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিত্র হলেও এখানে তারা পরস্পর বিরোধী শিবিরে রয়েছে।
আমিরাতের অস্ত্র প্রথমে সুদানের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ চাদে যায়। সেখান থেকে তা আরএসএফের কাছে যায়।
দক্ষিণ সুদান অর্থনৈতিকভাবে সুদানের ওপর নির্ভরশীল। সুদানের ভেতর দিয়ে দেশটির জ্বালানি তেল বিদেশে রপ্তানি হয়। তাদের মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ জ্বালানি পণ্য থেকে আসে। তারা সুদানের সেনাবাহিনী ও আরএসএফ—দুই পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ আছে। চাদ ও মিসরের পর সুদানের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে দক্ষিণ সুদানে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রায় চার বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও সুদানে তারা সেনাবাহিনীকেই সমর্থন করছে। তবে রাশিয়ার একসময়কার ভাড়াটে বাহিনী ভাগনার গ্রুপ (২০২৩ সাল থেকে আফ্রিকা কোর) যুদ্ধ শুরুর আগে-পরে আরএসএফকে সমর্থন দিয়েছে।
তুরস্ক, কাতার ও ইরান সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছে। তুরস্ক ও ইরানের ড্রোন সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। তুরস্ক ও কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মূলত ‘আল-বারা ইবনে মালিক ব্রিগেডের’ মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। এসব গোষ্ঠীর সহায়তায় বশির দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন।
আলজেরিয়া সুদান সেনাবাহিনীকে যুদ্ধবিমান দিয়ে সহায়তা করছে। জানা যায়, দেশটি মূলত আমিরাতের বিরোধিতা করতে গিয়ে সুদান সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছে। কারণ, পশ্চিমা সাহারা নিয়ে বিরোধে আমিরাত মরক্কোকে সমর্থন করেছে। তাই তারা আমিরাতের সমর্থনপুষ্ট আরএসএফের বিরোধিতা থেকে সুদানের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছে।
সুদানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিবেশী মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের (সিএআর) সঙ্গে রাশিয়ার সুসম্পর্ক। দেশটিতে ভাগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনা রয়েছে। দেশটি বর্তমানে আরএসএফকে সমর্থন করছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশ এখন পর্যন্ত সুদানের কোনো পক্ষ নিয়েছে বলে শোনা যায়নি। তবে আমিরাতের হয়ে যুক্তরাজ্যের অস্ত্র আরএসএফের হাতে গেছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাজ্য তা তদন্ত করছে। অন্যদিকে সুদান সেনাবাহিনীর কাছে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র বিক্রি করে চীন। সার্বিয়ায় তৈরি অস্ত্রও সুদানে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কার নিয়ন্ত্রণে কোন অংশ
২০২৩ সালের এপ্রিলে সংঘাত শুরু দিকে রাজধানী খার্তুম এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ রিপাবলিকান প্যালেস দখল করে নেয় আরএসএফ। গত মার্চে সেনাবাহিনী তা পুনরুদ্ধার করে। বর্তমানে উত্তর, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্য সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বলা হয়, সুদানের ৬০ শতাংশ ভূখণ্ড বুরহানের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে। গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সেনাবাহিনী দাবি করে, দক্ষিণ-পশ্চিমের নর্থ কোরদোফান রাজ্যের আল-রাহাদ শহর তারা পুনরুদ্ধার করেছে।
যুদ্ধের শুরুতে খার্তুম হারিয়ে উত্তরের লোহিত সাগরের তীরবর্তী শহর পোর্ট সুদানে নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে সরিয়ে নেয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। গত মে মাসে কামিল ইদ্রিসকে এ প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। নতুন ‘হোপ গভর্নমেন্ট’ নাম দিয়ে তিনি মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজান।
বুরহানের পোর্ট সুদানভিত্তিক সরকারকে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ সুদানের বৈধ সরকার বলে স্বীকার করে। কিন্তু হেমেদতির সরকারকে এখনো কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি।
গত অক্টোবরে প্রায় ১৮ মাসের অবরোধের পর নর্থ দারফুর রাজ্যের রাজধানী আল-ফাশের শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় আরএসএফ। এটি দখল করতে দেড় হাজারের বেশি সাধারণ মানুষকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বাহিনীটির বিরুদ্ধে, যাঁদের অধিকাংশ অনারব ও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান। ৮ ডিসেম্বর আরএসএফ দাবি করে, তারা দক্ষিণ সুদানের সীমান্তবর্তী হেগলিগ তেল খনি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। দক্ষিণ সুদানের সীমান্তবর্তী কোরদোফান অঞ্চলের কিছু এলাকাসহ আরএসএফ বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে।
আল-ফাশের ছিল দারফুরে সুদান সেনাবাহিনীর সর্বশেষ শক্তিশালী ঘাঁটি। এটির পতনের পরপর কোরদোফানের দিকে মনোযোগ দিয়েছে আরএসএফ। কোরদোফানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্য রয়েছেন। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলের আবেই এলাকায় আরএসএফের ড্রোন হামলায় বাংলাদেশের ছয় সেনাসদস্য নিহত ও আটজন আহত হয়েছেন।
সেনাবাহিনী ও আরএসএফ বর্তমানে মূলত পাল্টাপাল্টি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। তেলসমৃদ্ধ ওয়েস্ট ও নর্থ কোরদোফান রাজ্যের দখল নেওয়া আরএসএফের লক্ষ্য।
বুরহানের পোর্ট সুদানভিত্তিক সরকারকে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ সুদানের বৈধ সরকার বলে স্বীকার করে। কিন্তু হেমেদতির সরকারকে এখনো কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। বরং জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন হেমেদতির সমান্তরাল সরকার গঠনের নিন্দা জানিয়েছে।
সুদান কি আবার ভাগ হতে যাচ্ছে
গত এপ্রিলে নিজেদের সরকার গঠনের ঘোষণা দেন হেমেদতি। মে মাসে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। জুলাইয়ে হেমেদতির নেতৃত্বে প্রেসিডেনশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়। বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলকে কাউন্সিলে রাখা হয়েছে। এসপিএলএম-এনের প্রধান আবদেলাজিজ আল-হিলুকে হেমেদতির ডেপুটি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
একসময় আরএসএফ ও এসপিএলএম-এন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এসপিএলএম-এন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ হলো, তারা সাউথ কোরদোফানের বিশাল একটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
হেমেদতির কাউন্সিলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন সব রাজ্যের গভর্নরদের রাখা হয়েছে। মুহাম্মদ হাসান আল-তাইশিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কাউন্সিলের প্রধান কার্যালয় সাউথ দারফুরের নায়ালা শহরে।
বুরহানের সমান্তরালে হেমেদতির সরকার গঠিত হওয়াকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের আশঙ্কা, ক্ষমতার লড়াইয়ে লিবিয়ার মতো সুদানও আবার দুই ভাগ হয়ে যেতে পারে। এমনটি হলে সুদানের অবস্থা লিবিয়ার চেয়েও শোচনীয় হবে।
সুদানের প্রভাবশালী প্রতিবেশী ও সেনা–সমর্থক মিসর যেকোনো উপায়ে সুদানের দ্বিতীয় ভাঙন রোধের ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সুদানের ভাঙন তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে না। এমন কিছু হলে তাঁরা পদক্ষেপ নেবে।
সুদানের প্রায় তিন বছরের সংঘাত নিয়ে দু-একবার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা তেমন একটা গতি পায়নি। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আন্তর্জাতিক মহলে সুদানের ভয়াবহ মানবিক সংকটের দিকে তেমন একটি মনোযোগ দেয়নি বা দিতে পারেনি।
সুদানের জাতিসংঘস্বীকৃত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কামিল ইদ্রিস ২২ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে একটি শান্তি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এতে জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও আরব লিগের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবের মূল কথা হলো, আরএসএফ সেনাদের দখল করে রাখা সব এলাকা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। ক্যাম্পে ফেরার পর তাঁদের যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর যেসব যোদ্ধা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত নন বলে প্রমাণিত হবে, তাঁদের সমাজে পুনর্বাসন করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করবে। তবে তার আগে সমাজের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংলাপ জোরদার করা হবে।
২৬ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রস্তাবটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা চলছিল। আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি নিয়ে ভোটাভুটি হবে।
আরএসএফ এরই মধ্যে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে। হেমেদতির উপদেষ্টা আল-বাশা তিবিক ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, এ প্রস্তাব বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। আরএসএফ সেনাদের মাঠ থেকে প্রত্যাহারের দাবির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংযোগ নেই। এটি একটি দিবাস্বপ্ন।
বুরহানের সমান্তরালে হেমেদতির সরকার গঠিত হওয়াকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের আশঙ্কা, ক্ষমতার লড়াইয়ে লিবিয়ার মতো সুদানও আবার দুই ভাগ হতে যেতে পারে। এমনটি হলে সুদানের অবস্থা লিবিয়ার চেয়েও শোচনীয় হবে।
নিরাপত্তা পরিষদে কামিল ইদ্রিসের প্রস্তাব উত্থাপনের আগে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেফ্রি বার্টোস কথা বলেন। তিনি আরএসএফ ও সুদান সেনাবাহিনীর প্রতি মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য একটি বিকল্প পরিকল্পনায় রাজি হওয়ার আহ্বান জানান।
সুদানে সংঘাত থামাতে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মিসর ও আমিরাত কাজ করছে, যা ‘দ্য কোয়াড গ্রুপ’ নামে পরিচিত। জেফ্রি বার্টোস এই গ্রুপের বিকল্প প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেছেন। নভেম্বরের শুরুতে আরএসএফ জানায়, তারা কোয়াডের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি আছে। কিন্তু আমিরাতের সংশ্লিষ্টতা থাকায় সেনাবাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করে।
গত নভেম্বরে ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুদান সংকট নিয়ে মন্তব্য করেন। তখন তিনি বলেন, ‘আমাদের আশা, সুদান সংকট বন্ধের আলোচনায় অগ্রগতি হবে। সংঘাত বন্ধে আমি সহায়তা করব।’
এর আগে ২০২৪ সালের মার্চে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সুদান সংঘাত বন্ধ নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। তখন লিবিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আরএসএফের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়েছিল সুদান সেনাবাহিনী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীই এ উদ্যোগ থেকে সরে আসে। #















