দায়িত্ব পালনের ১ বছরে কী কী কাজ করেছেন, জানালেন কৃষি উপদেষ্টা

ঢাকা প্রতিনিধি: কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছরে কী কী কাজ করেছেন তা জানালেন এ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
আজ বৃহস্পতিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার কাজের কথা তুলে ধরেন।
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, ‘গত বছরের জুলাই মাসে সংঘটিত অভ্যুত্থানের পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর গত মাসেই পূর্ণ হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার বিকাশে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং কৃষিকে আধুনিক, প্রযুক্তি নির্ভর ও লাভজনক খাতে রূপান্তর করা ছিলো সরকারের অগ্রাধিকার। গত এক বছরে কৃষি মন্ত্রণালয় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে এবং তার ধারাবহিকতা চলমান রয়েছে। দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করেছি। ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ ও শাক-সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলমূল উৎপাদনেও আমরা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। ’
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘গত বছরের আগস্ট মাসে দেশের ২৩টি জেলায় মারাত্মক বন্যায় ফসলের ব্যপক ক্ষতি হয়েছিল। সময়মতো বীজ, সার ও প্রণোদনা দেওয়ায় কৃষকরা সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ের রেখে যাওয়া সারের বকেয়া পরিশোধ করে চাহিদামত সার আমদানি করে সরবরাহ করা হয়েছে। দেশে সারের কোনো ঘাটতি হয়নি, আগামী মৌসুমেও যাতে ঘাটতি না হয় সে লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। সার আমদানিতে সকল সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এখন থেকে সার আমদানি হবে। ’
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, ‘কৃষি জমি সংরক্ষণে কঠোর বিধান রেখে ভূমি ব্যবহার ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়ণের কাজ চলছে। কোনো অবস্থাতেই ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না। বর্ধিষ্ণু জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতে কৃষি জমি রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব ‍দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন করছে- যা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক। বিশেষ করে লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল ধান ও অন্যান্য ফসলের জাত কৃষকদের মাঝে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও আমরা বিশেষ অগ্রগতি করেছি। উদ্যানজাত ফসল, আম, কাঁঠাল, সবজি ও আলু রপ্তানিতে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এ মৌসুমে চীনের বাজারে আম রপ্তানি নতুন দিগন্ত সূচনা করেছে। বিদেশে কৃষি পণ্যের নতুন নতুন বাজার খোঁজা অব্যাহত আছে।’
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকার বাজার মনিটরিং ও বিভিন্ন নীতি সহায়তা প্রদান করেছে। কৃষিঋণ বিতরণ, সেচ ও সার সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। গত এক বছরের এ অগ্রগতি সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম এবং আমাদের কৃষক ভাইদের অবদানের ফল ‘
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা কৃষিকে আরও টেকসই ও রপ্তানিমুখী করতে চাই। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন, কৃষি-প্রযুক্তি উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি আমাদের প্রধান লক্ষ্য।’
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি এখন আপনাদের সামনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিগত এক বছরের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরছি;
১. গত এক বছরে ৮৮ লাখ ৫৫ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সার, বীজ ও চারা এবং অন্যান্য সহায়তা বাবদ ৮৯৩ কোটি ২০ লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
২. ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে আমন ১৬৫.১৪৫ লাখ মেট্রিক টন, আউশ ২৭.৯৩৪ লাখ মেট্রিক টন, বোরো ২২৬.০৮২ লাখ মেট্রিক টন, মোট ধান (চালে) ৪১৯.১৬১ মেট্রিক টন, আলু ১১৫.৭৩৬ মেট্রিক টন, গম ১০.৪১১ মেট্রিক টন, ভুট্টা ৭৩.৯৯৪ মেট্রিক টন, পেঁয়াজ ৪৪.৪৮৭ মেট্রিক টন, রসুন ৭.৮৮৭ মেট্রিক টন, আদা ২.৫১৪ মেট্রিক টন, কাঁচা মরিচ ১৬.৪২৮ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়েছে।’
৩. সারের বকেয়া ২০,৬৯১ কোটি টাকাসহ মোট ২৭,৬৮৪.৯৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। রাশিয়া থেকে বিনামূল্যে ৩০,০০০ মেট্রিক টন সার প্রাপ্তির কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। সার আমদানির সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ায় সরকারের ২৩৩.৬১ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ হালনাগাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পাটকলের অব্যবহৃত গুদামকে সার মজুদের জন্য ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন বিএডিসিকে সার ক্রয়ে ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণ প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
৪. জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বালাইনাশক বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে।
৫. গত এক বছরে ২,৬৪৬.১১ টাকা ব্যয়ে ০৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং তিনটি পরিমার্জন ও দুটি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
৬. শাক-সবজি সংরক্ষণে ১০০ মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা হচ্ছে। পেঁয়াজ ও আলু সংরক্ষণের জন্য এয়ারফ্লো মেশিন ও বিশেষ ঘর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। যার সুফল আমরা ইতিমধ্যে পাচ্ছি। আলুর দাম হিমাগার গেইটে সর্বনিম্ন ২২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে ৫০,০০০ মে.টন আলু ক্রয় করা হবে।
৭. উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে চারটি এমওইউ স্বাক্ষরিত  হয়েছে ও দ্য এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এপিএআরআই) নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ লাভ।
৮. কৃষিপণ্য রপ্তানি আয় ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনে প্রথমবারের মতো আম রপ্তানি হয়েছে। চীনে কাঁঠাল ও পেয়ারা রপ্তানির প্রক্রিয়াগত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এ মৌসুমে ৬২ হাজার ৫১ টন আলু রপ্তানি হয়েছে; গাবতলীতে রপ্তানির জন্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ হচ্ছে।
৯. ফল ও সবজি চাষে উন্নত কৃষি চর্চার (জিএপি) অনুসরণ করা হচ্ছে। ১৫ টি ফসল যথা আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বেগুন, বরবটি, লাউ, পটল, কাঁচা পেঁপে, আলু, বাঁধাকপি, চিচিঙ্গা, করলা, কচুর লতি, আনারস ও জারা লেবুর জিএপি প্রোটোকল চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
১০. দেশে উৎপাদিত আঁশ তুলাকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা ০৫ জুন, ২০২৫ বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে।
১১. পরিবেশ রক্ষায় আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসের চারা ধ্বংস করা হয়েছে, বিপরীতে প্রতি চারায় ৪ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ৩৩ লাখ দেশীয় জাতের ফলজ ও বনজ গাছ বিনামূল্য বিতরণ করা হয়েছে।
১২. টেকসই, আধুনিক কৃষি ও সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে কৃষি উন্নয়ন রূপরেখা পরিকল্পনা ২০২৫-২০৫০ তৈরি করা হচ্ছে।
১৩. বিনা, ব্রি, বারি ও বিএআরসি উদ্ভাবিত বিভিন্ন ফসলের জাত কৃষকের হাতে সময় মতো পৌঁছানো হয়েছে। নতুন বীজ উদ্ভাবন দ্রুত মাঠে পৌঁছাতে সমন্বিত বীজ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
১৪. দেশের প্রতিটি ভূমি মৌজাকে ডাটাবেইজের আওতায় এনে সার, বীজ, বালাইনাশক, সেচ, ফসল বৈচিত্র্য, আবহাওয়া ও রোগ-বালাইসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য সন্নিবেশিত করে একটি মোবাইল অ্যাপস ‘খামারি’ চালু করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের জন্য ‘খামারি অ্যাপস’ ও ‘ক্রপ জোনিং সিস্টেম’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
১৫. কৃষকের পণ্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে প্রণোদনা হিসেবে কৃষি বিভাগের ট্রাক ও ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহারের , কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণায় সম্পৃক্তকরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
১৬. বীজ ব্যবস্থাপনা অনলাইনভিত্তিক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
১৭. কৃষি মন্ত্রণালয় এবং অধীনস্থ দপ্তর/সংস্থার ১০৯ জন বঞ্চিত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে; ১৯ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা; ৬৪৫ জন কর্মকর্তাকে বদলি ও শতাধিক কর্মকর্তার দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য দুদুকে প্রেরণ করা হয়েছে।
১৮. রাষ্ট্রীয় অর্থে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ঢাকা প্রতিনিধি মো. লিটন চৌধুরী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.