রহমান উজ্জ্বল:প্রবাদ আছে, যে জাতি বীরদের সম্মান করতে জানে না- সে জাতিতে কোন বীরের জন্ম হয় না।২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর যে বিষয়টি জাতির হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তা হলো- আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা না হওয়া, অথবা চিকিৎসা ব্যবস্থায় ত্রুটি বা অসঙ্গতি।
যাদের রক্ত, শ্রম, ঘাম এবং অঙ্গহানির মধ্য দিয়ে এই জাতি দানবরুপী স্বৈরাচারকে পরাস্ত করল- তাদের চিকিৎসায় অবহেলা জাতিকে খুবই কষ্ট দেয়। অথচ তেতো হলেও সত্য , এ দেশের হাসপাতালগুলোতে বিজয়ের ছয় মাস পরেও আহত মানুষগুলো ব্যাথায় কাতরাচ্ছে অথবা চিৎকার করছে। অথচ স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পরে সর্বপ্রথম কাজটা হওয়া উচিত ছিল আহতদের চিকিৎসা করানো।
২০২৪ এর গণআন্দোলন ছিল অন্যরকম একটি মুক্তির আন্দোলন। স্বাধীনতাকে স্বাধীন করে স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলন। দেশের সার্বভৌমত্ব,পতাকা ও মানচিত্রকে শেয়াল- শকুনের টানাটানি থেকে রক্ষার আন্দোলন। অথচ প্রথমদিকে আন্দোলনটি ছিল একটি নিরীহ ধরনের ছাত্র আন্দোলন।
রক্তখেকো হাসিনার অহংবোধ, প্রতিহিংসা এবং দাম্ভিকতা যৌক্তিক আন্দোলনটিকে রক্তাক্ত করে তোলে। শিক্ষার্থীদের চাকরির জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসের জঘন্যতম নরঘাতকদের একজন শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে ছাড়ে। হাসিনার বিগত ১৬ বছরের শাসনামল ছিল পোড়ামাটি নীতির প্রতিফলন।
হাসিনার দুর্নীতি ,লুটপাটে যারা বাধা হতো কিংবা তার শাসনকার্যে যে বা যারা ভিন্নমত পোষণ করত -তাকে বা তাদেরকে হাসিনা খুন-গুম অথবা হামলা-মামলা দিয়ে শেষ করে দিত। স্বজনহারাদের অভিশাপ আর ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার হাসিনার শাসনামলকে অভিশপ্ত করে তোলে। যার অভিসম্ভাবী পরিনতি হাসিনার করুন বিদায়।
রক্তচোষা হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে প্রায় ২ হাজার নাগরিককে হত্যা করে এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আহত বা অঙ্গহানির শিকার হয়। এর মধ্যে এক চোখ বা দুই চোখ হারিয়ে অন্ধত্ব বরণ করে অসংখ্য মানুষ। এই বিশাল সংখ্যক আহত জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত ছিল।
এ ব্যাপারে সরকারের ঢিলেঢালা আচরণ বা অবহেলা দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সন্তান, ভিটেমাটি বা স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে আহতদের চিকিৎসা নেয়ার সংবাদগুলো মানুষ কোনোভাবেই ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি। অনেক সময়েই আহতদের কন্ঠ থেকে আফসোস ঝরতে দেখা গেছে।
তারা অভিমান নিয়ে বলেছে- ‘এ রকম হবে জানলে তারা আন্দোলনে অংশ নিতেন না’ । আন্দোলনে আহতদের এই চিকিৎসা অবহেলা, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জার। পাশাপাশি, আন্দোলনের সময় যে সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে- তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত কোন শ্রেণী -পেশার মানুষের আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, হকার, বেকার, পথশিশু- সব শ্রেণীর মানুষেরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। আন্দোলনে অংশ নিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে দাঁড়িয়ে যায়। কোটি কোটি মানুষ আন্দোলনে শরিক হয়। ফলে নিহতদের পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যক মানুষ আন্দোলনে আহত হয়।
অথচ এইসব আহত মানুষদের চিকিৎসা অবহেলা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে কিছুটা হলেও কালীমা লেপন করে। যা জন আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা ব্যর্থতা হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জনগণের ভাত ,ভোট ও কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়ে বিগত ১৬ বছরে খুনি হাসিনা জন মানসে এক ঘরে হয়ে পড়েছিলেন।
অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দেয়া ছাড়া এ সময় আর কিছুই করার ছিল না। ফ্যাসিস্ট হাসিনা শেষ পর্যন্ত এতটাই অহংকারী ও নিষ্ঠুর হয়ে পড়েছিল যে -তার আমলে সংগঠিত গণহত্যাগুলো এবং পাতানো নির্বাচনগুলো নিয়েও মিডিয়ার সামনে বসে আস্ফালন করতে দেখা যেতো তাকে।
হাসিনার ফ্যাটিস্ট রেজিমের মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগী এবং দেশের সব শ্রেণীর জনগণ – এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় দেশবাসী। হাসিনার নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসরতার কাহিনীগুলো দেশবাসীকে চমকে দেয়। ভবিষ্যতেও চমকে দেবে। মায়েরা শিশুদের দানব হাসিনার গল্প বলে ঘুম পাড়াবে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার যুগে আওয়ামী লীগ,পুলিশ ও সরকারের নিষ্ঠুরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, নাগরিকদের আর কোন প্রকার নিরাপত্তা ছিল না। এ সময় প্রায় দেড় লক্ষ মামলায় দেশের ৬৫ লক্ষ মানুষকে আসামি করা হয়। মৃত মানুষ, প্রবাসে অবস্থান করা মানুষকেও পর্যন্ত মামলার আসামি করা হয়েছে। শিশু থেকে শত বছরের বৃদ্ধ ,জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষগুলোও আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত বা লাগাতার নির্যাতনের শিকার হয়।
আওয়ামী লীগের নিপীড়ন -নির্যাতনে অতিষ্ঠ জনগণ প্রাক ইসলামী যুগের আরব দেশের আইয়ামে জাহেলিয়াতের মত শেখ হাসিনার শাসনকালকে “আওয়ামী জাহেলিয়াত” বলে অভিহিত করত। আন্দোলনের মূল স্টেক হোল্ডার হলো আন্দোলনে নিহত মানুষগুলোর পরিবার এবং আন্দোলনে বন্ধুত্ববরণকারী বা আহত হওয়া মানুষগুলো। এইসব অঙ্গ বিসর্জন দেওয়া মানুষগুলোর চিকিৎসায় অবহেলা বা দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ- জাতি হিসাবে অবশ্যই একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। বিজয়ের পর হরহামেশাই আহতদের পক্ষ থেকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আসছে। আর চিকিৎসায় পরিকল্পনার অভাব তো স্পষ্ট এবং দৃশ্যমান।
২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম হাসপাতালে আহতদের দেখতে গেলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এ সময় তার সাথে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। এ সময় আহতরা তাদের গাড়ি আটকে দেয়। কেউ কেউ গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে।
আহত আন্দোলনকারীরা এ সময় অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তাদের কিছু না শুনেই চলে যাচ্ছেন। পুরোটা না দেখে মাত্র ২/৩ জনের সাথে কথা বলে চলে যাচ্ছেন। গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা অবহেলার প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে বদলি করা হয়। জীবনকে হাতের মুঠোয় রেখে রাজপথে নেমেছিলেন ছাত্র -জনতা। ৫ আগস্ট খুনি স্বৈরাচারের পতন করেই তারা ঘরে ফেরে।
আন্দোলনে প্রায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। পঙ্গুত্ববরনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কমবেশী আহত হয় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। আহতদের পক্ষ থেকে বরাবরই চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আছে।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- আহত পঙ্গুত্ববরণ করা এসব মানুষের সুচিকিৎসায় সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে চিকিৎসা উপযোগী করা হয়েছে।
এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইন্স হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিকস হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ আহতরা রাজধানী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা জেলা হাসপাতাল অথবা প্রাইভেট ক্লিনিকেও চিকিৎসা নিয়েছেন কেউ কেউ।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সরাসরি তদারকিতে ২০ জন এ পর্যন্ত বিদেশ গেছেন চিকিৎসা নিতে। জাতির ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিস্ট দানব শেখ হাসিনা পতনের অগ্র সেনাদের চিকিৎসায় সামান্যতম গাফিলতি জাতির জন্য লজ্জাজনক। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় শুরু থেকেই আলাদা দপ্তর গঠন করা উচিত ছিল। যাতে করে, আহতদের সবকিছুর ‘ওয়ান স্টপ’ সমাধান দেয়া যায়।
তাছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসায় এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিল থাকে- এটাও স্মরণে রাখা উচিত ছিল।
আহতদের পুনর্বাসনের বিষয়টি স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ বিভাগ মিলে করতে হবে। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি মানসিক পুনর্বাসনটাও অনেক বেশি জরুরী। একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শারীরিক ও মানসিক আঘাত প্রাপ্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুন কাঙ্খিত বাংলাদেশ দেখে তারাও যেন হাসিমুখে ভুলে যায় তাদের অঙ্গহানি বা বিসর্জনের কথা। তারা যেন কষ্টের বদলে গৌরব বোধ করে নতুন বাংলাদেশে গঠনে তাদের ভূমিকা নিয়ে। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.