হায় ট্রেন ; হায় রেলস্টেশন!

মোঃ আমানুল্লাহ আমান:  রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গের ট্রেনে লাগাতার শিডিউল বিপর্যয়ে জনভোগান্তি চরমে উঠেছে। ঈদের মৌসুম হওয়ায় অতিরিক্ত যাত্রীদের আনাগোনাতে রেলস্টেশন,ট্রেনের ভিতরেও ‘গিজগিজ’ করছে। ট্রেনের বগিতে পা ফেলার জায়গা নেই। শত শত যাত্রী স্টেশনে বসেই অপেক্ষার প্রহর গুনতে আছে ট্রেনের জন্য। এভাবে ঈদের পর থেকেই রাজশাহী স্টেশনে ব্যাপক দুর্ভোগের মধ্যে ট্রেনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ঢাকায় যেতে হচ্ছে যাত্রীদের। এমনকি আগের দিন রাতের ধূমকেতু ট্রেনটি ছেড়ে যাচ্ছে পরের দিন সকালে বা ভোরে। আর রাতভর স্টেশনে বসে মশার কামড় খেয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ নিয়ে চরম ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়েছে যাত্রীদের মাঝে। কিন্তু তার পরেও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় থামানো যাচ্ছে না। সময়ক্ষেপণে বেশ সমস্যায় পড়ছেন যাত্রীরা। ঈদের পর লালমনিরহাটের আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ের ৩৩ ঘণ্টা পরে। আর রংপুর এক্সপ্রেস ২২ ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে।

সম্প্রতি ঈদের আগে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বে ও ঈদের পর কোর্টচাঁদপুরে ট্রেন লাইনচ্যূতের ঘটনায় পুরো পশ্চিমাঞ্চলে এর প্রভাব পড়েছে। একারণে সময়সুচি মেনে ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। তবে প্রতিটি ট্রেন সাপ্তাহিক ডেঅফ পেলে শিডিউলে শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।

ঢাকার একটি বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরি করেন রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার আতাউর রহমান। ছুটি শেষে সোমাবার কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন। টিকিটিও অগ্রিম কেটেছিলেন। রবিবার  (১৮ আগস্ট) রাজশাহী-ঢাকা পদ্মা ট্রেনে যাবেন।  কিন্তু স্টেশনে এসে ট্রেনের খবর জানতেই তাঁর চোখ যেন ছানা-বড়া। স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মচারীদের কাছে আতাউর জানতে পারেন আগেরদিন  শনিবার রাতে ছেড়ে যাওয়া সিল্কসিটি ট্রেনটিই তখনো স্টেশনে এসে পৌঁছেনি! সিল্কসিটি আসার পরে আসবে ধূমকেতু। এরপর সেটি আবার পদ্মা হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। তবে রবিবার বিকেল চারটা ২০ মিনিটের পদ্মা কখন ছাড়বে তাঁর কোনো ঠিক নাই। এত লম্বা সময় তো বসে থাকা যায়না বাধ্য হয়ে রিকশা নিয়ে রাজশাহী শহর ঘুরতে শুরু করেন। এরপর রাত ৯টার দিকে স্টেশনে এসে জানতে পারেন আরো এক ঘন্টা দেরি আছে। শেষে রাত ১০টার সময় ছেড়ে যায় রবিবার বিকেলের পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটি।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে,পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্মকর্তাদের চরম অদক্ষতার কারণেই ঈদের আগে-পরে ট্রেনের এমন সিডিউলের মহাবিপর্যয় ঘটেছে। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও তদারকি না থাকাসহ একই লাইনে তিনটি বিরতিহীন ট্রেন চালু করার ফলেই এই সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। তবে জনদুর্ভোগের বিষয়টি রেলওয়ে কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।

রাজশাহী স্টেশনের ম্যানেজার আব্দুল করিম শিডিউল বিপর্যয়ের বিষয়ে বলেন, রবিবার সকালের সিল্কসিটি ছেড়ে গেছে ওইদিন রাত ১১টার দিকে। আর বিকেলের পদ্মা ছেড়ে গেছে ওইদিন রাত ১০টায়। ওইদিন রাত ১১টা ২০ মিনিটের ধূমকেতু গতকাল সোমবার ভোরে দিকে ছেড়ে গেছে। আর সকালের সিল্কসিটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে বিকেল চারটার দিকে। বিকেলের পদ্মা ট্রেনটি কখন ছেড়ে যাবে তার কোনো হদিশ দিতে পারেননি রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এমএম শাহনেওয়াজ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদকে বলেন, ‘ ঈদে লাইনে চাপ বেড়েছে। একটি মাত্র রেললাইন। কিন্তু এই লাইনেই তিনটি বিরতিহীন ট্রেনছাড়াও সবমিলিয়ে ৫টি আন্তঃনগর ট্রেন যোগ হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে ট্রেন দ্রুতগতিতে চালানোও যাচ্ছে না। এ কারণেও অনেকটাই সিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদেরও ভোগান্তি হচ্ছে। আগামীতে সিডিউল বিপর্যয়রোধে আমরা ঈদের সময় ঢাকায় একটি করে ট্রেন স্ট্যান্ডবাই রাখবো। যাতে কোনো ট্রেন অতিরিক্ত দেরি করলেই ওই ট্রেনটি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসতে পারে। আবার অফ ডে বলবত থাকবে। তাহলে আশা করি এতোটা সঙ্কট হবে না।’ তিনি এই অঞ্চলে দ্রুত ডাবল লাইন চালু করার প্রতি জোরালো দাবি জানান।

কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন। ঢাকার সাথে উত্তরাঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় ২৪টি ট্রেন চালানোর সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে চলাচল করছে ৪৪টি ট্রেন! আর বিরতিহীন ট্রেন চলে তিনটি। আবার যেতে হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে। ফলে অন্য সকল ট্রেনই পড়ছে বিলম্বের কবলে। তবে সেবা নিশ্চিত করতে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সকল শাখায় সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। রেলসেবায় কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর গাফিলতি পেলে কোনো ছাড় দেয়া হবে না-এমন হুঁশিয়ারি জারি করে সকল শাখায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েরই একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঈদের মধ্যে ট্রেনের বাড়তি চাপ নতুন নয়। কিন্তু এবারের মতো এরকম শিডিউল বিপর্যয় এর আগে কখনো হয়নি। এর আগেও ঈদের সময় করে কিছুটা শিডিউল বিপর্যয় হয়ে থাকে। যাত্রীদের চাপ থাকে অনেক। কিন্তু সেটি ৬-৭ ঘন্টার ওপরে যায়নি। কিন্তু এবার শিডিউল বিপর্যয় কখনো কখনো ১২ ঘন্টারও বেশি হচ্ছে । যা অতিতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

এরই মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক খোন্দকার শহিদুল ইসলামকে বদলি করা হয়েছে। মঙ্গলবার তাকে বদলি করা হয়। যদিও একটি সূত্র বলছে, শহিদুল ইসলামকে অতিরিক্ত ডিজি করে বদলি করা হয়েছে। তিনি সেই পদে যোগদানও করেছেন ঢাকায়। এই শিডিউল বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি  গঠন করে তাদেরকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে।

তবে কেউ কেউ বলছেন, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্মকর্তাদের চরম অদক্ষতার কারণেই ঈদের আগে-পরে ট্রেনের এমন সিডিউলের মহাবিপর্যয় ঘটেছে। ঈদের সময় ট্রেন চলাচলে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের পূর্বপ্রস্তুতি না নেয়া,  দায়িত্বহীনতা ও পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে এতটা জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে।

এদিকে পশ্চিমাঞ্চলে রেলের নতুন মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেই ‘সারপ্রাইজ ইন্সপেকশনে’ রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে যান হারুন অর রশীদ। বুধবার (২১শে আগস্ট) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে স্টেশনের পরিবেশ ঘুরে দেখেন। ওয়েটিং রুমের বেসিন, টয়লেট ও পরিবেশ নোংরা থাকায় তাৎক্ষণিক স্যানেটারি ইন্সপেক্টর আমিনুল ইসলামকে বরখাস্তের নির্দেশ দেন।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নবনিযুক্ত মহাব্যবস্থাপক মো. হারুন অর রশীদ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদকে বলেছেন, সরকারের নির্দেশনা রয়েছে যাতে যাত্রীরা কোনোভাবেই হয়রানি বা দুর্ভোগে না পড়েন। এজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কয়েক দফা বৈঠক করেছি। সিডিউল বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে পাকশী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি খতিয়ে দেখছে কী কারণে এমন বিপর্যয় ঘটেছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অন্যদিকে গত কয়েকদিন রাজশাহী রেলস্টেশনের সরেজমিনে অপেক্ষামাণ (ওয়েটিং রুম) কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের ভীড়ে যেন ধাপ ফেলানোর জায়গা নাই। সবাই অপেক্ষা করছেন যে যার মতো ট্রেনের জন্য। সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটের সিল্কসিটি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা হোসনে আরা নামের এক তরুণী অভিযোগ করে বলেন, ‘আগে ম্যাসেজ দিলে ট্রেন কতক্ষণ দেরি আছে জানা যেত। এখন তাও জানা যাচ্ছে না। ফলে স্টেশনে এসেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যারা রাজশাহী শহরের বাসিন্দা তাদের একটু ভোগান্তি কম হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা শহরের বাইরের থেকে এসেছি, তাদের ভোগান্তির শেষ নাই। ট্রেন কখন ছাড়বে জানতে না পেরে স্টেশনে এসেই ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার স্টেশনেও বসার মতো তেমন জায়গা নাই। ফলে বাধ্য হয়েই একই কক্ষে গাঁদাগাঁদি করে লোকজন অপেক্ষা করছে।’

আরেক ট্রেনযাত্রী শফিকুল ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদকে বলেন, ‘ ট্রেন কখন ছাড়বে নির্দিষ্টভাবে স্টেশন থেকে কেউ বলতে পারছে না। এমন সিডিউল বিপর্যয় এর আগে কখনো দেখিনি। দিনরাত স্টেশনেই কেটে যাচ্ছে। কেউ কেউ বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে জেনে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার যাদের শহরে বাড়ি তারা বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করছেন। একটু পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছি আমরা ট্রেনযাত্রীরা। কিন্তু এই ভোগান্তির কোনো সুরাহা দেখছি না। ঈদের আগে-পরে সবসময় চলছে এমন ভোগান্তি।’

লেখক : কলামিস্ট, সাংবাদিক ও ধর্মীয় আলোচক।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি আমানুল্লাহ আমান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.