নিজস্ব প্রতিবেদক:বাংলাদেশের উত্তর জনপদ তথা বরেন্দ্র ভৃমির প্রাণকেন্দ্র রাজশাহী। এই শহরটি শিল্প সংস্কৃতি শিক্ষা ক্রীড়া ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বহুকাল পূর্ব থেকেই সমগ্র দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করে আসছে যা সর্বমহলে সুবিদিত।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৮৮২ সালে রাজশাহী শহরে “ভিক্টোরিয়া ক্লাব” নামে একটি ক্রীড়া বিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। রাজশাহী জমিদারীর কর্নধার রানী ভবানীর পরবর্তী বংশধর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৬) ছিলেন একজন উচ্চমানের ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক।
তিনি ১৯০১ সালে কলকাতা শহরে ‘নাটোর ইলেভেন’ নামে একটি ক্রিকেট দল গঠন করেছিলেন। ১৮৮২ সালে রাজশাহী শহরে ভিক্টোরিয়া ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভের পর উল্লেখ করার মতো আরও কয়েকটি প্রাচীন ক্রীড়া সংগঠনের জন্ম হয়েছিল।
এ গুলো হলো: বোয়ালিয়া ক্লাব (১৮৮৪), টাউন ক্লাব (১৮৮৬), মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব (১৯০৬), ইয়াং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব (১৯২১), এ্যালাইড ক্লাব (১৯২৮), দি রাজশাহী মুসলিম ক্লাব (১৯২৮), রাজশাহী ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংঘ (১৯২৯) প্রভৃতি সহ উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো ক্রীড়া সংগঠন।
এই শহরে জন্মেছেন এমন অনেক প্রতিভা সম্পন্ন ক্রীড়াবিদ যাঁরা ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, মুষ্ঠিযুদ্ধ, বডি বিল্ডিং ও সাঁতার সহ অ্যাথলেটিকস ইত্যাদি ক্রীড়ার নানা ক্ষেত্রে অসাধারন নৈপুন্য প্রদর্শন করে দেশ বরেণ্য হয়েছেন।
এছাড়াও রাজশাহীতে জন্মলাভকারী একাধিক ক্রীড়া সংগঠক রয়েছেন যাঁদের কর্ম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিস্তৃতি লাভ করেছিল। রাজশাহীতে ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য এরা ছিলেন রায় বাহাদুর ধরনীমোহন মৈত্র, অ্যাডভোকেট সিকান্দার বখ্ত, অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেন, অ্যাডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকার, এ্যাডঃ আবদুল হাদি, নূরুন্নবী চাঁদ, জাফর ইমাম, খোদাবক্স মৃধা প্রমূখ।
ক্রীড়া ক্ষেত্রে যাঁরা দেশে ও বিদেশে নিজ নিজ প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, মনীন্দ্রনাথ চৌধুরী ওরফে মনি (ফুটবল), অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু (ফুটবল), মো: মোহসীন ওরফে জামাল (ফুটবল), শামসুল ইসলাম মোল্লা ওরফে শামসু (ফুটবল), ফজলে সাদাইন খোকন (ফুটবল), রবিউদ্দিন মিন্টু (হকি), খালেদ মাসুদ পাইলট (ক্রিকেট), রওশন আলী (সাঁতার), মোহাম্মদ গোলাম মেহবুব (শরীর গঠন), মো: মোশারফ হোসেন (মুষ্ঠিযুদ্ধ), আনছার আলী আনফোর (অ্যাথলেটিকস) প্রমূখ।
রাজশাহীর ক্রীড়াঙ্গনের উল্লিখিত গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যের পরম্পরা ধরে রেখেছেন বর্তমান সময়ের এক ঝাঁক তরুন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক। গৌরবময় এ সকল উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অন্যতম একজন আমাদের অতি পরিচিত হাসিনুর রহমান টিংকু।
রাজশাহী শহরের কুমারপাড়ার এক ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া পরিবারে টিংকু জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা আবদুর রহমান, মাতা: সুফিয়া রহমান। শফিকুর রহমান বাবলু ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। অগ্রজ তৌফিকুর রহমান লাভলু ছিলেন রাজশাহীর একজন স্বনামধন্য বাস্কেটবল খেলোয়াড় ও দক্ষ অ্যাথলেট।
১৯৭০ সালে তিনি রাজশাহী কলেজে বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে অ্যাথলেটিকসে ইনডিভিজুয়াল চ্যাম্পিয়নশীপের বিরল গৌরব অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল টিমকে একাধিকবার নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। তার আরেকজন অগ্রজ মোস্তাফিজুর রহমান বাবু ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম অলিম্পিকে একজন দক্ষ দৌড়বিদ হিসেবে রাজশাহী বিভাগকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
হাসিনুর রহমান টিংকুর অনুজ মাসুদুর রহমান রিংকু ছিলেন একজন উচু মানের ক্রিকেটার। শহরের প্রভাতী সংঘ নামক ক্লাবের পক্ষ থেকে একাধিকবার প্রিমিয়ার লীগ ক্রিকেটে একজন ব্যাটার হিসেবে খেলেছেন। এই লীগে তিনি একাধিক শতক এবং অর্দ্ধশতকের অধিকারী হয়েছিলেন। এরূপ একটি অনুক‚ল ক্রীড়া পরিবেশে টিংকুর ক্রীড়া প্রতিভার উন্মেষ ঘটে যা অচিরেই বিকশিত হতে শুরু করে।
একজন ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক টিংকু:
হাসিনুর রহমান টিংকু তার ক্রীড়া প্রতিভার সাক্ষর রাখতে শুরু করেন কিশোর বয়স থেকেই। তিনি দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ভোলানাথ একাডেমীর বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অ্যাথলেটিকস এ সামগ্রিক ভাবে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেন।
১৯৮৫-৮৬ সালে রাজশাহী কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় দীর্ঘ লম্ফে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে রাজশাহী কলেজ একাদশের পক্ষে ১৯৮৪-৮৫ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক আয়োজিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন।
রাজশাহী কলেজ সে বছর যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছিল। তিনি ১৯ নভেম্বর ২০১৫ সালে অলিম্পিক সলিডারিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি কর্তৃক আয়োজিত পাঁচ দিনের ‘Sport Administration Course’ এ অংশগ্রহণ করেন এবং সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হন।
একজন কৃতী ক্রীড়াবিদ হিসেবে টিংকুর পরিচয় আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। ক্রীড়াঙ্গনে তার পদচারনা শুরু হলো ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। আমরা দেখলাম ২০০৬ সালে তিনি ঐতিহ্যবাদী রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্স এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। দীর্ঘ ১৮ বছর শ্রম ও মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। ফলস্বরূপ ২০১৬ সালে রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্স (বর্তমান নাম আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল টেনিস কমপ্লেক্স রাজশাহী) এর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বর্তমানে তিনি রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্স এর সহ সভাপতি-১ এর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি রাজশাহী বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য। বর্তমানে তিনি এই সংস্থার কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধি হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা এবং সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
হাসিনুর রহমান টিংকু ২০২১/২২ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত অনুর্দ্ধ ১৪ আন্তঃ জেলা ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় রাজশাহী জেলা দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে বছর রাজশাহী জেলা দল রানার আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত এবং ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত অনুর্দ্ধ ১৮ বালিকা বিভাগে রাজশাহী বিভাগীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই বছরে (২০২২) বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত আন্তঃ বিভাগ অনুর্দ্ধ ১৮ বালক দলের ম্যানেজার হিসেবে বিভাগীয় দলের দায়িত্ব পালন করেন।
২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় মহিলা ক্রিকেট লীগে রাজশাহী দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজশাহী নগীরর ঐতিহ্যবাদী ক্রীড়া সংগঠন ব্রাইট স্টার ক্লাবের তিনি বর্তমানে নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক।
২০২৩ সালে রাজশাহীতে বিভাগীয় শেখ কামাল অ্যাথলেটিকস ও শেখ কামাল যুব প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়ের সহযোগিতায় হাসিনুর রহমান টিংকু সাফল্যের সঙ্গে উক্ত প্রতিযোগিতা সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তার অদম্য উৎসাহ এবং কর্মদক্ষতার ফলে এই নগীতে দুইটি ক্রিকেট ক্লাব গঠিত হয়েছে। এদুটি ক্লাবের একটি “কুমারপাড়া রাইডার্স ক্লাব” এবং অপরটি “রাজশাহী বুলস”। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে “কুমারপাড়া রাইডার্স” রানার আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। অপর পক্ষে “রাজশাহী বুলস” ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত মাস্টার্স ক্রিকেট কার্নিভ্যালে অংশগ্রহন করে রানার আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
হাসিনুর রহমান টিংকু বর্তমান সময়ে রাজশাহীর ক্রীড়া ক্ষেত্রে সর্বাধিক আলোচিত একটি নাম। সার্বিক ভাবে ক্রীড়ার সকল পর্যায়ে যে সমৃদ্ধি এবং বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে এর পেছনে যাদের মেধা এবং শ্রম কাজ করে চলেছে হাসিনুর রহমান টিংকু তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অগ্রগন্য।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি জি, এম হাসান-ই-সালাম (বাবুল) রাজশাহী। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.