হাসিনার অঘোষিত দ্বিতীয় বাকশাল ও স্বৈরাচারিতা

রহমান উজ্জ্বল: আধুনিক যুগে শেখ হাসিনার মতো এরকম ভয়ংকর খুনি ও প্রতিহিংসাপরায়ন নারী শাসক পৃথিবী আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নেশাগ্রস্ত শেখ হাসিনা একজন চরম নিষ্ঠুর লোভী ধরনের সাইকো। নিজের স্বার্থের জন্য হাসিনা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে কিংবা জনগণের উপর প্রচন্ড ক্রুরতা দেখাতে বিন্দুমাত্র ভাবতেন না। বিরোধীদলের বা ভিন্নমতের মানুষকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি না মনে করে সরাসরি শত্রু ভাবতেন।
দেশের সব মানুষই যেন তার পরিবারের হত্যাকারী -এরকম একটা ভাবনা থেকে হাসিনা রাজনীতির চর্চার চাইতে প্রতিহিংসার চর্চাই বেশি করতেন। শেখ হাসিনা বহুবার তার আলাপচারিতায় কিংবা মিডিয়ার সামনে বসে এদেশের মানুষের প্রতি তার রাগ -ক্ষোভের কথা বলেছেন। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কথা বলেছেন। যার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই- এদেশের অসংখ্য মানুষকে খুন -গুম করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মাধ্যমে।
দুর্নীতি -লুটপাট করে দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দেয়ার মাধ্যমে। পতন ও পলায়নের আগে মাত্র ২১ দিনে মানসিক ভারসাম্যহীন এই মহিলা ২ হাজার মানুষকে হত্যা করে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে পঙ্গুত্বের অভিশাপ চাপিয়ে দেয় চিরতরে। পুলিশের ছোড়া ছররাগুলিতে প্রায় চার হাজার মানুষ চিরতরে অন্ধ হয়ে যায়।
পতনের পরেও ভারতে আশ্রয় নেয়া এই মহিলার মধ্যে পূর্বের মতোই ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়। কোন প্রকার অনুশোচনা তার মধ্যে দেখা যায়নি এতো রক্ত ঝরানোর পরও। তার ষড়যন্ত্রে থেমে নেই। পলাতক হাসিনা ও তার বিদেশি প্রভু ভারত মিলে বাংলাদেশকে অনবরত অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। পৃথিবীর অন্যান্য স্বৈরাশশাসকদের মতোই হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিও ছিল দুর্বল।
মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। দেশের মানুষের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালালেও বিদেশি সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগদ অর্থ অথবা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনায় অবিরত ছাড় দিয়ে গেছে শেখ হাসিনা। দেশের জনগণের মতামতদের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন সব চুক্তি করেছে যা দেশে স্বাধীনতাকে দুর্বল করে দেয়। দেশের স্বার্থকে বিনষ্ট করে। আবার কিছু কিছু গোপন যুক্তি আলোর মুখই দেখেনি অর্থাৎ জনগণ চুক্তিগুলো সম্পর্কে অজ্ঞাত।
বিগত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল তার বাবা শেখ মুজিবের বাকশালেরই আধুনিক সংস্করণ। গুন্ডা ধরণের শেখ মুজিব তারপর কাজে-কর্মে হোম্বিতোম্বি করলেও চতুর হাসিনা তার কাজগুলো নীরবে সেরে ফেলতেন। মুজিব বাকশাল গঠন করে ঘোষণা দিয়ে ও আয়োজনের মাধ্যমে। আর হাসিনা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে চুপচাপ। বিরোধী দল , মতকে দমিয়ে ও কিছু দালালকে বশীকরণের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের পরে এক শেখ মুজিবকে ঘিরে সবকিছু আবর্তিত হতো। শেখ হাসিনার আমলে সেও ছিল পিতার মত সর্বেসর্বা। শক্ত হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর শেখ হাসিনা তার পিতা মুজিবকে একজন মহামানব বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। একাজে হাসিনা দেশের দালাল মিডিয়াগুলোকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তারা অসংখ্য গালগল্প তৈরি করে মুজিবকে মহামানব বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
দেশজুড়ে শেখ মুজিবের হাজার হাজার ভাস্কর্য ও মুরাল তৈরি করা হয়। দেশের বুদ্ধিজীবী নামক আগাছা- অকর্মা মানুষগুলো এসময় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মজিব বন্দনায় লিপ্ত হয়। মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগানের স্বীকৃতি দেয়া হয়।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচিত হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পর বিএনপি বেগম খালেদা নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়। ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা তার উল্টাপাল্টা আচরণ কথাবার্তা ও ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক করে। ২০০০ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত শেখ হাসিনাকে রং হেডেড মহিলা বলে অভিহিত করে। পরের বার নির্বাচনে জিতে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠন করে। এই সরকারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম থেকে আলী আহসান মুজাহিদ ও মাওলানা মতিউর নিজামীকে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদকাল শেষে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। সংসদ ভেঙে দিয়ে ২৮ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এ সময় বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ না করার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করে। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সমাবেশে নেতা-কর্মীদের লগি, বৈঠা নিয়ে হাজির থাকার ঘোষণা দেয়া হয়।
সমাবেশে আওয়ামী লীগের লোকেরা বাঁশের লাঠি, লগি-বৈঠা নিয়ে হাজির হয় । এই দিন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের সমাবেশ ছিল। দুটি সমাবেশ স্থল থেকে একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ৪০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। শতাধিক মানুষ আহত হয়। যাদের প্রায় সবাই ছিল বিএনপি- জামায়াতের কর্মী। লগি- বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ঢাকার ব্যস্ততম সড়কে মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়।
হত্যার পর নিহত মানুষের বুকের উপর উঠে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নৃত্য করার দৃশ্য দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এরপর প্রায় আড়াই বছর দেশে সেনা সমর্থিত মঈন -ফখরুদ্দিনের শাসন চলে। যা দেশের ইতিহাসে ওয়ান ইলেভেনের সরকার নামে পরিচিত। ওয়ান ইলেভেনের সরকার দেশে প্রচুর ধরপাকড় চালায়। দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে তারা ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে । কয়েকটি কিংস পার্টির জন্ম দিয়ে দেশে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়।
এ সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে ব্যাপকভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় ।এক পর্যায়ে তারেক রহমানের মেরুদন্ডের দুটি হাড় ভেঙ্গে গেলে এবং তার শারীরিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি হলে উচ্চ আদালতে নির্দেশে হুইলচেয়ারে বসিয়ে তারেক রহমানকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার- এই দুই সরকারের অবর্ণনীয় নিপীড়ন -নির্যাতনে বিদেশের মাটিতে অসুস্থ হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
ফখরুদ্দিন- মঈনের আমলে পর্দার আড়ালে অনেক কিছু ঘটতে থাকে। সেনাবাহিনী তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে। যার প্রধানতম লক্ষ্য রাজনীতিবিদ ও ব্যাবসায়ীরা। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিবে কি-না, এটা নিয়ে এ সময় সংশয় ছিল। সেনা শাসনকালে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া দ্বিধামুক্ত ছিলেন না।
অন্যদিকে আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মিথ্যাচারে অভ্যস্ত আওয়ামী লীগের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগান এ সময় তরুণ ভোটারদের কিছুটা আকৃষ্ট করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয় । যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে প্রচুর সমালোচনা হয়। নির্বাচনে বিএনপি’র পরিকল্পিত ভরাডুবি ঘটানো হয়। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি অভিযোগ তুলে সরকারের দিকে।
পরবর্তীতে শোনা যায়, সেনা সমর্থিত সরকারের সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার প্রতি। অনেকটা কিংস পার্টির মতো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পার করে দেয় সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার। পরবর্তীতে সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ বিদেশে চলে যায়।
২০০৮ সালের ফখরুদ্দিন-মঈন সরকারের অধীনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে জাতির কাঁধে এক মহাকালের অভিশাপ চেপে বসে। সেই অভিশাপ শেষ পর্যন্ত দানবের রূপ ধারণ করে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। বিগত ১৬ টি বছর ধরে বাংলাদেশের ভিন্ন দল- মতের মানুষকে জ্বালিয়ে -পুঁড়িয়ে ছারখার করে দেয় সাইক্লপ হাসিনা। পতনের পর ব্যক্তি মানুষ হিসেবে শেখ হাসিনার এমন সব কাহিনী বেরিয়ে আসে- যা শুনে দেশের মানুষ আতংকে শিউরে উঠে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে লুটপাট এবং নিষ্ঠুরতার এক মহা অধ্যায় শুরু করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেই জাতীয় পার্টির সাথে পাল্টি দেয় মিথ্যুক হাসিনা। নির্বাচনের আগে আরেক স্বৈরাচার এরশাদকে প্রেসিডেন্ট বানানোর আশ্বাস দিলেও নির্বাচনের বৈতরনী পার হয়ে পরে তা দিতে অস্বীকার করে। নানাদিক দিয়ে হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদকাল ছিল ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ। সরকার গঠনের পর হাসিনার মন্ত্রিসভা কয়েকবার সম্প্রসারিত করে। খুনি হাসিনার দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের মাত্র ৫১ দিনের মাথায় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার একটি অধ্যায় রচিত হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে বিডিআর বিদ্রোহের নাটক করে হাসিনা তার বিদেশী প্রভুর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন মানুষ নিহত হয়। অথচ শেখ হাসিনা ইচ্ছা করলে পাশের সেনা ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানবাহিনীর মাধ্যমে সামান্য সময়ের মধ্যে এই পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা সম্ভব ছিল। ৫৭ জন মেধাবী ও সাহসী সেনা কর্মকর্তাকে হারিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিডিআর অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শেখ হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় মেয়েদের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচার করা ও রায় কার্যকর করা।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় (১৯৯৬ থেকে ২০০১) মামলার কার্যক্রম অনেকটা গুছিয়ে রেখেছিলেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া ১২ জন আসামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্নেল ফারুক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে মহিউদ্দিন ও মেজর বজলুল হুদার ফাঁসি কার্যকর করে।
৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার দ্বিতীয় মেয়েদের শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামাত ইসলামের গোলাম আযম, মাওলানা দেলোয়ার সাঈদী, মাওলানা আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আব্দুল আলীম প্রমুখকে গ্রেফতার ও বিচারেরকার্যের সম্মুখীন করা হয়। ভয়াল ফ্যাসিজম এ সময় আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের দাবিতে সরকারের মদদে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে শাহবাগে এ সময় গঠন করা হয় গণজাগরণ মঞ্চ।
গণজাগরণ মঞ্চ থেকে শাহবাগ অবরুদ্ধ রেখে দীর্ঘদিন যাবৎ বিএনপি ও জামাত ইসলামের প্রতি বিষেদগার চলতে থাকে। এ সময় চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা শাহ আহমেদ শফি হুজুরের হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৩ দফার দাবিতে ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা শাপলা চত্বরে প্রথমবার সমাবেশ করে হেফাজত ইসলাম। পরের মাসের ৫ই মে সারা দেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক -শিক্ষার্থীরা ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে শাপলা চত্বরে সমবেত হয়ে অবস্থান নেয়। শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে হাসিনার কর্তৃতবাদী শাসনের নগ্ন প্রকাশ দেখা যায়।
রাতের বেলা বিদ্যুৎ বন্ধ করে, সাংবাদিকদের সরিয়ে দিয়ে হাসিনার অনুগত বাহিনীগুলো নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা সংঘটিত করে। আলেম- ওলামাদের রক্তে প্লাবিত হয় ঢাকার রাজপথ। শোনা যায়, এদিন খুনি হাসিনার পেটোয়া বাহিনী প্রায় ২ লক্ষাধিক গুলি ছুড়ে। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে নিহতের সংখ্যা কয়েক শত হলেও কেউ কেউ তা কয়েক হাজার বলে মত প্রকাশ করে। চতুর হাসিনা ও তার পুলিশ রাতের বেলাতেই নিহতদের লাশগুলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ট্রাকে করে সরিয়ে ফেলে এবং রাস্তাঘাট পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে। দ্বিতীয় মেয়েদের শুরু থেকেই শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বা উন্নয়নের নামে জিগির তোলে। এই মেয়াদে তারা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার ঘোষণা দেয়।
২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর -দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করে দুইটি সিটি কর্পোরেশন করা হয় । ফ্যাসিস্ট হাসিনা আদালতকে ব্যবহার করে বেগম খালেদা জিয়ার ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িটি কেড়ে নেয়। হাসিনার দ্বিতীয় মেয়েদের প্রথম পাঁচ বছরে সংবিধানকে কয়েকবার কাটা ছেঁড়া করা হয়। হাসিনার দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্ব ছিল অঘোষিত দ্বিতীয় বাকশাল গঠনের প্রথম ধাপ। প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন, গুম- হত্যা ও মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে শেষ হয় হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম পাঁচ বছর।
এ সময় হাসিনা অতি নিষ্ঠুরভাবে বিরোধী মতকে নিঃশেষ করার পরিকল্পনা করে। র্যাব,পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসনকে লোভ কিংবা ভীতির মাধ্যমে নিজের অনুগত লাঠিয়ালে পরিণত করে। হাসিনার নির্যাতন সেল আয়নাঘর ছিল মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্যতম নিদর্শন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার প্রয়াস হিসাবে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এটা নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করলেও বন্দুকের নলের সামনে আন্দোলন বেশিদূর এগোতে পারেনি। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আবার আরেকটি রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল গণতন্ত্রের সাথে মশকরা করার মত । বিরোধী দল ও ভোটারবিহীন এ নির্বাচনের আগেই প্রার্থীরা ১৫৩ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় । ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাকি ১৪৭ টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট ২৩৪ আসনে বিজয়ী হয়। বিএনপি -জামাতসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়। সহিংসতার দিক থেকে এই নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। নির্বাচনের দিন সহিংসতা সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হয়।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগে -পরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৪১ দিনে মোট ১২৩ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি অতীতে আর দেখা যায়নি। দেশে-বিদেশে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও তাতে কর্ণপাত করেনি হাসিনা ও আওয়ামীলীগ।
ভোটারবিহীন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১২ই জানুয়ারি তৃতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে। শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরেও শেখ হাসিনা তার উন্নয়নের জিকির অব্যাহত রাখে। এ সময় মেগা প্রকল্পের নামে মেঘা দুর্নীতি চালু করে ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী।
নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের চেহারা আরও পাল্টে যায়। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ মিলে দেশকে মাফিয়া তন্ত্রে পরিণত করে। ২০১৪ সাল থেকে সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধ করার জন্য গণমাধ্যমনীতি প্রণয়ন করে। জনগণের কাছে কোন দায়বদ্ধতা না থাকায় দেশজুড়ে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের রাজত্ব কায়েম করা হয়। আওয়ামীলীগ ও সরকারের লোকেরা দেশটাকে নিজেদের বাপ-দাদার সম্পত্তি ভাবতে শুরু করে।
২০১৪ সালের সাজানো বিজয়ের পর সরকার তার পুরনো জঙ্গি নাটকের পুনঃ পুনঃ অবতারণা ঘটায়। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজেন রেস্তোরায় তথাকথিত জঙ্গি হামলায় মোট ২৮ জন নিহত হয়। যে ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার লোভে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে দেশে অবৈধভাবে আশ্রয় দেয় শরণার্থী হিসেবে। তার এই হঠকারীতার মূল্য এখনও দেশকে দিতে হচ্ছে । আগত রোহিঙ্গাদের এখনো ফেরত নেয়নি মায়ানমারের জান্তা সরকার। ক্রমাগত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ফলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। দিন দিন বাড়তে থাকে দেশের বৈদেশিক ঋণ। যার অনিবার্য পরিনিতি স্বরূপ দেশে দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। ভেঙে পড়তে থাকে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর আর বাড়তে থাকে বেকারত্ব।
হাসিনার তৃতীয় মেয়াদে দেশের মানুষ খুন- গুম, হামলা- মামলা নাজেহাল হয়ে পড়ে। বিরোধীদল ও নাগরিকদের কোণঠাসা করে ফেলে সরকার। এমতাবস্থায় দেশে পরবর্তী আরও একটি নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসে। ২০১৮ সালের নির্বাচন শেখ হাসিনার চরম ফ্যাসিস্ট শাসনের আরো একটি বড় নজির। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনা নির্লজ্জভাবে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়। এই নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক প্রশ্ন এবং বিতর্ক সৃষ্টি হলেও শেখ হাসিনা কোন কিছুই গ্রাহ্য করেনি। নির্বাচনকে জায়েজ করার জন্য শেখ হাসিনার বিদেশী প্রভু ভারত বরাবরের মত তার পাশে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তাদের অনুসারী পুলিশ ,আনসাররা মিলে আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরে রেখেছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সারাদেশে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বিএনপি ও তাদের জোট ঐক্যফ্রন্টের অনেক প্রার্থী অভিযোগ করেছিল, তারা এলাকায় যেতে পারছে না। ভোটের আগের রাত থেকে ভোটের দিন সকাল পর্যন্ত প্রার্থীরা বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে ফোন করে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের ব্যালটে সিল মারার বিষয়টি তুলে ধরেছিল। কিন্তু যেখানে প্রশাসনই আওয়ামী লীগের সাথে মিলে অপকর্ম করছিল ,সেখানে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল- অরন্যে রোদনের মত। ভোট শুরুর ঘন্টাখানেকের মধ্যে আওয়ামী লীগ এর সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যায় ভোট কেন্দ্র গুলো। আগের রাত্রে ব্যালট বাক্সগুলো ভরে রাখলেও তারা স্বস্তি পায়নি। তারা দিনের বেলাতেও আবার ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারতে থাকে। কেন্দ্রগুলো থেকে বিরোধীদলের এজেন্টের ভয়-ভীতি দেখিয়ে বের করে দেয়া হয় এ সময়।
অনেক ভোটারই ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পায় তাদের ভোট আগেই হয়ে গেছে ।ভোটাররা যখন জানতে পারে, রাতের বেলাতেই ভোট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে তখন কেন্দ্রগুলো থেকে ভোটার উপস্থিতি কমতে থাকে। নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীরা একের পর এক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ এক পাক্ষিক। এমন হাস্যকর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার জোট সঙ্গীরা পায় ২৮৮ টি আসন । আর বিএনপি জোট পায় ৭ টি আসন এবং অন্যান্যরা পায় তিনটি আসন। ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্য ফ্রন্ট নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন বাতিল করে পুনঃনির্বাচনের দাবি তুলে ধরে বলেন- অনেকে বলে থাকেন ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে আমরা ভুল করেছিলাম। কিন্তু এবার প্রমাণ হলো যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আমরা পুরো নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি। ভোটের পরের দিন বেহায়া নির্বাচন কমিশনার বলেন- মোট ভোটারের ৮০ পার্সেন্ট তাদের ভোট দিয়েছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতা হয় ।বেশ কয়েকটি জায়গায় সহিংসতায় কমপক্ষে ১৫ জন মানুষ মারা যায়। প্রচুর মানুষ আহত হয়। এ সময় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের উপর ২৮৩৩ টি হামলায় ১২৯২৩ জন মানুষ আহত হয় । ৫৬ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে সরাসরি হামলা শিকার হয়। ২০০০ বিএনপি- জামাত কর্মীকে গ্রেপ্তার হয়।
২৯ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে থ্রি জি ও ফোর জি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। নির্বাচনের নামে এই প্রহসন দেখে বিশ্ববাসী স্তম্বিত হয়ে পড়ে। জাপানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত বলেন- আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখার হয়- এমন নির্বাচনের কথা কখনো শুনিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২০ সালের ১১ মার্চ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে ঘোষণা দেয়। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে কেউ কেউ আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। চাটুকার- চামচাদের পাল্লায় পড়ে হয়তো শেখ হাসিনাও তার চুরি-চামারি আর বাটপারির কথা ভুলে যেত। তার অনবরত বলা মিথ্যাচারগুলো মানুষ বিশ্বাস করছে- এমনটাই বোধহয় ধারণা ছিল তার। দেশের মানুষকে উন্নয়নের কথা বলে ক্ষুধার্ত পেটে রাখার ধান্দাবাজিতে এক সময় নাগরিকরা প্রচন্ড রকম বিরক্ত হয়।
পায়ের নিচের মাটি সরে গেলে তবুও শেখ হাসিনার বিশ্বাস ছিল বন্দুকের নলে। এজন্য জনগণের ন্যায় সংক্রান্ত কোনো দাবিকেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা গ্রাহ্য করেনি। অহংকারী হতে হতে শেখ হাসিনা কোন প্রকার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করত না। বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠিন হাতে দমন করত। এজন্য নাগরিকদের কতটুকু রক্ত ঝরবে- এটা কখনোই চিন্তা করত না হাসিনা। বস্তুত শেখ হাসিনা তার বাপ মুজিবের মতই অহংকারী ও একরোখা, দাম্ভিক ও গর্দভ টাইপের ছিল।
এখন মানুষ বলাবলি করে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জাহেলিয়া যুগ শুরু হয়েছিল। সামান্য একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে ছাত্রলীগ। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে যুব সমাজে নেশার প্রকোপ বাড়ানো ছিল ভারতীয় প্রেসক্রিপশন। ভারতীয় সীমান্ত জুড়ে শত শত ফেন্সিডিল, ইয়াবা ও হিরোইনের কারখানা গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ মানেই আতঙ্ক। সে মন্ত্রী থেকে শুরু করে কিশোর গেং সদস্য যেই হোক। আওয়ামী জমানায় মহল্লার গলিতে গলিতে ছিল কিশোর গেং।
অন্যদিকে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলেও সহজলভ্য হয়ে যায় ইয়াবা ,হিরোইনের মত প্রাণঘাতী নেশা । দেশে আওয়ামী রেজিম এমন একটা অবস্থা শুরু করেছিল যে, এই দেশের রাজনীতি করার এবং বসবাস করার অধিকার শুধু তাদেরই আছে। অবশ্য হাসিনা নিজেই বারবার বলেছে, -এদেশ আমার বাবা স্বাধীন করেছে সুতরাং এই দেশ আমার।
শেখ হাসিনা পুরো দেশটাকে বাবার সম্পত্তি মনে করে দেশের গ্রাম -মহল্লাগুলো ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুন্ডাদের কাছে তালুকদারী দিয়েছিল। তাদের অন্যায় আবদার ,অত্যাচার, খুনখারাবিতে দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও শেখ হাসিনা তাদের নাম দিয়েছিল- “সোনার ছেলে”। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিরোধীদলের বেশির ভাগ নেতাকর্মীদের এলাকায ছাড়া করা হয়। তাদের অনেকেই আবার গ্রাম ছেড়ে প্রবাসেও চলে যায়।
এ সময় প্রতিপক্ষহীন শেখ হাসিনার সোনার ছেলেরা নিজেদের মধ্যে খুন-খারাবি করে দেশের প্রতিটি জনপদ অশান্ত করে তোলে। দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দল এ সময় আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর্থিক সংকট এবং অপুষ্টিতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকেই নিরবে মারা যায়। অনেকের সংসার জীবন ও অর্থনৈতিক অবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন পালিয়ে থেকে অবশেষে হকারী, অটোচালক এসব পেশায় জড়িত হয়।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার ২০১৯ থেকে ২০২৪ এর শাসনকাল স্রেফ নিষ্ঠুরতা আর মিথ্যাচারের ইতিহাস। সরকারকে টিকিয়ে রাখার কৃতিত্ব দাবি করে প্রশাসন এ সময় রাজনীতিবিদদের উপর কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে। এ সময় কোন কোন সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারী দলীয় কর্মীদের চেয়েও বেশি আওয়ামী সরকার টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিল। এ সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে জয় বাংলা বলার প্রতিযোগিতা ছিল। ভিন্নমতের কেউ বা পরিবারের কারোর সাথে বিরোধী দলের সংশ্লিষ্টতা আছে -এমন সরকারি চাকুরীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হতো।
বস্তুত বিগত বছরগুলোকে প্রশাসনকে পুরোপুরি আওয়ামীকরণের ফলে এক সংকট দেখা দেয়। কারোর উপর কারোর নিয়ন্ত্রণ ছিল না তখন একেবারেই। এ সময় দুর্নীতি, লুটপাট আর নিষ্ঠুরতার প্রতিযোগিতা চলে আওয়ামী লীগ, সরকারী চাকুরে আর তাদের সুবিধাভোগীদের মধ্যে। কে কত বড় আওয়ামী লীগার- এটা প্রমাণ করার জন্য সমাজে চলে চেয়ার খেলা । সমাজের প্রতিটি স্তরের অপকর্ম- দুর্নীতি চেটে চেটে, ফেলে দেয়া কাটা, হাড়গোড়গুলো পেয়ে খুশি হতো দেশের তথাকথিত সুশীল ও বুদ্ধিজীবীরা। সাংবাদিকরা এ সময় সাংবাদিকতার নামে যা করত তা হলো মিথ্যাচার।
আর সোজাসুজি বলতে গেলে বলতে হয়, মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকরা এ সময় সরাসরি আওয়ামী রেজিমের সহযোগী ছিল। মূল্যস্ফীতির ফলে সরকার বারবার নোট ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। মূল্যস্ফীতির অনিবার্য পরিনিতি স্বরূপ দ্রব্যমূল্যের দাম এক গুন, দুই গুন থেকে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঘাড়ে সার্বক্ষণিক খড়গের চাপের মতো একটা বিষয়। এ সময় সংসার চালানোর চাপে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় একটা অংশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পরিণত হয়।
অন্যদিকে আওয়ামী রেজিমের লোকেরা ফুলে ফেঁপে কলা গাছ হওয়ার বদলে বটগাছ হয়ে যায় । প্রতিবছর ১৫ বিলিয়ন ডলার করে বিদেশে পাচার করেছে তারা। সরকারি চাকুরে এবং আওয়ামী লীগের হাজার হাজার মানুষ বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডার মত দেশে তারা বেগম পাড়ার মতো আবাসস্থল গড়ে তুলেছে। দুবাই, মালেশিয়া, ভারত বা অন্যান্য দেশেও বাড়ি -গাড়ি করেছে তাদের কেউ কেউ।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলে থাকেন- ফ্যাসিস্ট হাসিনা কোন কোন ক্ষেত্রে নাৎসি হিটলারকেউ ছাপিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার অঘোষিত বাকশাল আমলে সরকার তথা আওয়ামী লীগ এবং জনগণ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। বিগত ১৬ বছরে বহুবার নাগরিকদের সাথে সহিংসতা -সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সরকার। তাদেরকে দমন করার জন্য বারবার দেশে গণহত্যা চালায় । আর খন- গুম ,হামলা -মামলা এগুলো ছিল হাসিনা সরকারের জন্য ডাল ভাত। অবস্থাটা এক পর্যায়ে এমন দাঁড়ায় যে, ভিন্নমতের মানুষেরা নিজ দেশেই রোহিঙ্গাদের মত বাস করা শুরু করে।
শেখ পরিবার ও ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর লুটপাট, দুর্নীতির কারণে দেশের সব ডলার পাচার হয়ে যায়। নাগরিকদের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায় । ২৬ লক্ষ শিক্ষিত বেকারসহ দেশে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ লাখের উপরে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর আর শেয়ার মার্কেট মুখ থুবড়ে পড়ে। রুগ্ন স্বাস্থ্যসেবার চিত্র আরো স্পষ্ট হয় করোনাকালীন ২০২০-২১ সালে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনকালের শেষ পাঁচ বছরেই শুধু ১৬ হাজারের বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। বীভৎস্য এক নারকীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা কতটা হিংস্র আর নিষ্ঠুর ছিল তা বোঝানোর জন্য দৈনিক যুগান্তরের ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত রিপোর্টের অংশ বিশেষ নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো। হাসিনার শেষ পাঁচ বছরে ১৬ হাজারের বেশি হত্যাকান্ড শিরোনামের লেখাটিতে বলা হয়েছে- ” সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালের শেষ পাঁচ বছরে ১৬ হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে; গড় হিসেবে প্রতিদিন ৯ জনেরও বেশি মানুষ হত্যা শিকার হয়েছে।
এ সময় অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে প্রায় আড়াই হাজার। পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে উঠে এসেছে এ তথ্য। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে অনুযায়ী, এই পাঁচ বছরের নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও আঁতকে ওঠার মতো। ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খুন ও অপহরণের পাশাপাশি ছিনতাইয়ের অভিযোগ মিলেছে ৯৯৫৫টি । আর ডাকাতির মামলা হয়েছে ১৬০০টি “। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.