স্মরণকালের বৃহত্তর বিক্ষোভে অচল ইয়াঙ্গুন

(স্মরণকালের বৃহত্তর বিক্ষোভে অচল ইয়াঙ্গুন–ছবি: সংগৃহীত)
বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অর্ধশতাধিক গাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। একে আন্দোলনের নতুন পদ্ধতি আখ্যা দেয়া হচ্ছে। লক্ষাধিক বিক্ষোভকারী এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আয়োজকদের প্রত্যাশা এটিই হতে যাচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ।
মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষদূত সম্ভাব্য সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। গত ০১ ফেব্রুয়ারী সামরিক অভ্যুত্থানের পর আটক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভ করছেন মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ।
অং সান সূ চি সহ আরও বেশ কয়েকজন নেতা তাদের সামরিক বাহিনীর হাতে আটক আছেন।
গতকাল মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারী) সূ চির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে দ্বিতীয় মামলাটি করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। পরদিন ইয়াঙ্গুন শহর অচল করে দিল বিক্ষোভকারীরা।
গতকাল মঙ্গলবার মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দিহান আন্দোলনকারীরা।
রোড ব্লকিং ডে বা সড়ক অবরোধ দিবস: সামাজিক মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সড়ক অবরোধের আহ্বান জানানো হয়। আজ বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারী) সকাল থেকে সড়ক অবরোধ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের লক্ষ্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে কাজে যোগ দিতে না পারেন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া।
রোড ব্লকিং ডে’র বেশ কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসময় বিক্ষোভকারীদের বিভিন্ন দাবি এবং স্লোগান সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন হাতে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। গাড়ি দিয়ে সড়ক অবরোধ এবং বিক্ষোভকারীদের সরব উপস্থিতির কারণে শহরতলীতে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
বিবিসি বার্মিসের রিপোর্টার জানান, ইয়াঙ্গুনের জংশনে বহু পাবলিক বাস আটকে পড়েছে। চালকদের কেউ কেউ সড়ক অবরোধ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে বলেও জানানো হয়।
জান্তা সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করে দেশটিতে আয়োজিত সবশেষ বিক্ষোভ এটি। দেশব্যাপী চলমান এ বিক্ষোভে চিকিৎসক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা অংশ নেন। বর্জন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন পণ্য এবং তাদের সেবা।
সড়ক অবরোধের কারণে আন্দোলনকারীরা ‘সুল বুদ্ধ মন্দিরে’ যেতে পারছেন না বলে সমালোচনা করেছেন এক বিক্ষোভকারী। রয়টার্সকে মোং সোয়ং খা বলেন, সড়ক অবরোধ দিবস প্রত্যাহার করে আন্দোলনকারীদের যতদ্রুত সম্ভব আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে যেতে সহায়তা করা উচিৎ।
সুলের বিশাল বিক্ষোভে অংশ নেয়ার জন্য লক্ষাধিক মানুষ আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছেন।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে মিয়ানমারের। আয়োজকদের প্রত্যাশা বুধবারের বিক্ষোভ এ যাবতকালের মধ্যে সর্ববৃহৎ হতে যাচ্ছে।
সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক বার্তায় অং সান সূ চি’র ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির জ্যেষ্ঠ সদস্য খিন সান্দার নাগরিকদের উদ্দেশে বলেন, লাখ লাখ মানুষের জমায়েতে অংশ নিয়ে সামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করুন।
‘আসুন আমরা গণবিক্ষোভ করি। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি প্রদর্শন করি। সামরিক সরকার আমাদের দেশের ভবিষ্যত ধ্বংস করে দিচ্ছে।’
গতকাল মঙ্গলবার মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষদূত টম অ্যান্দ্রেজ দেশটিতে বৃহত পরিসরে সংঘাতের তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন। আন্দোলনকারীদের জমায়েতের জায়গায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পরই তিনি এ সতর্কতা উচ্চারণ করেন।
‘বিক্ষোভকারীরা বিশাল জমায়েতের ঘোষণা দিয়েছে। জমায়েতের জায়গায় বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আমার শঙ্কা এ দুটি বিষয়ে। আমি আতঙ্কিত, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী বড় ধরনের কোনো অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেয় কিনা?’
এসবের মূলে কি?: সূ চি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দেশটির নভেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
সেনাবাহিনীর দাবি, এনএলডি জালিয়াতি করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, নির্বাচনে কারচুপির কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু সামরিক বাহিনী জালিয়াতি করা ভোট ফেরত দেয়ার দাবি জানায়।
বর্তমানে দেশটির কমান্ডার ইন চিফ মিং অং হ্ল্যাং ক্ষমতায় আছেন। সূ চি গৃহবন্দি।
প্রথমে সূ চির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ওয়াকিটকি ব্যবহারের অভিযোগে মামলা হয়। পরে দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ভঙ্গের দায়ে দ্বিতীয় দফায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। সবশেষ মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
বিক্ষোভকারীরা সূ চিসহ এনএলডি’র শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবী জানাচ্ছেন। অভ্যুত্থানবিরোধী চলমান বিক্ষোভকে দেশটিতে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত কথিত জাফরান বিপ্লবের চেয়ে বৃহৎ বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে।
চলমান বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী এবং আন্দোলকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে যাচ্ছে জান্তা সরকার।
মিয়ানমারের মূল পরিচয়: মিয়ানমার বার্মা নামেও পরিচিত। ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশটি সামরিক বাহিনীর কঠোর শাসনে থাকায় একে জাতিবিচ্যুত রাষ্ট্র বলেও দীর্ঘদিন অভিহিত করা হয়। ২০১০ সালে সামরিক শাসন থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৫ সালে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশটির জ্যেষ্ঠ গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সূ চি’র সরকার গঠন হয়।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ নৃশংসতা চালায়। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় অন্তত ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা। সেনাবাহিনীর নৃশংসতাকে পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে জাতিসংঘ।
নভেম্বরের নির্বাচনে এনএলডি বিশাল জয় পাওয়ায় গত ১ ফেব্রুয়ারী সূ চি’র সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.