স্থানীয় প্রশাসন মানছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় ভারত সীমান্তবর্তী সাতটি জেলায় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারির সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সাত জেলায় কঠোর লকডাউন দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকেও স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন দেওয়া যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কেন্দ্রীয় এসব মতামত আমলে নিচ্ছে না।
সীমান্তবর্তী সাত জেলার করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। ওই দিন তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। রোববার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে তারা ওই জেলাগুলোর ওপর নজর রাখছেন। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
আর গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, লকডাউনের ব্যাপারে স্থানীয় পর্যায়ে আগেই নির্দেশনা দেওয়া আছে, যাতে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা না হয়। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তারা লকডাউনেরন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এতে করে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। কারণ কোনো কোনো এলাকার সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা।
লকডাউনে বিলম্ব হলে সংকট বাড়বে- স্বাস্থ্যমন্ত্রী :উচ্চ সংক্রমিত ভারতের সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতে দেরি হলে সংকট বাড়বে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটি পর্যালোচনা করছে। আম চাষিদের অবস্থা বিবেচনা করে হয়তো দেরি করছে। কিন্তু আমরা চাই সুপারিশ করা সাতটি জেলায় দ্রুত লকডাউন দেওয়া হোক।
সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে জাহিদ মালেক বলেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে হয়। আমরা আলাপ করব যে, তারা কবে থেকে লকডাউন দেবেন। কিন্তু আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, যেসব জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে, সেখানে লকডাউন দেওয়া হোক।
সীমান্ত জেলার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।ভারতীয় ধরনে উচ্চ সংক্রমিত সীমান্ত জেলাগুলোতে কঠোর লকডাউনের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি লকডাউনের সুপারিশ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও দ্রুত লকডাউন দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু লকডাউন এখনও হয়নি। লকডাউনের ক্ষমতা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদের হাতে। তারা তো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নন। তারা সমস্যাগুলো কীভাবে বুঝবেন। সীমান্ত জেলাগুলোতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। অথচ এটি নিয়ে খামখেয়ালিপনা করা হচ্ছে। এতে করে সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেটি হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় গতকাল ৩০০ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর মধ্যে রাজশাহীতে ১২৭ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯৩ জন রয়েছেন। এদিন মারা গেছেন আটজন। আগের দিন রোববার রাজশাহী বিভাগে ৩৩৭ জনের শরীরে করোনারভাইরাস শনাক্ত হয়। এটাই ছিল এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। এ নিয়ে বিভাগে করোনায় আক্রান্ত হলেন ৩৫ হাজার ৪৭৫ জন। আর মারা গেছেন ৫৫৮ জন।
ভয়াবহ আকারে সংক্রমণ ছড়ালেও রাজশাহীতে কঠোর লকডাউনে আগ্রহ নেই প্রশাসনের। রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কঠোর লকডাউন চলছে। রাজশাহীসহ অন্যান্য জেলায় আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজন হলে দেওয়া হবে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. হুময়ুন কবীর বলেন, শনাক্তের হার ওঠানামা করছে। এখন যে নমুনার ফলাফল পাচ্ছি, তার অনেকগুলোই লকডাউনের আগের। লকডাউনের উপকারিতা আসছে কিনা তা দেখতে হলে আরও দু’দিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। খারাপের দিকে গেলে চিন্তা করা হবে।
লকডাউনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামীকাল জেলা পর্যায়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই সভায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে লকডাউনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন।
এদিকে, খুলনায় হঠাৎ করেই আক্রান্তের হার এবং হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। রোববার রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত করোনা হাসপাতালে ৯৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। চলতি বছর এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী। অবশ্য গতকাল অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন। এদিন দুপুর পর্যন্ত ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ৬৭ জন।
লকডাউনের সুপারিশকৃত সাত সীমান্ত জেলার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে যশোর। এ জেলায় করোনা সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে জেলায় করোনা সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশ বা তার নিচে। গত এপ্রিলে এই হার ছিল ২১ শতাংশ। মে মাসে সেটি ১৬ শতাংশে নেমেছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় যশোরের ২২০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৯ জনের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। সংক্রমণের হার ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর আগের দিন ২৪১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়।
করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ও জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান টুকুন জানান, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে সংক্রমণের হারের দিক বিবেচনায় যশোরে লকডাউনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ফলে এখনই লকডাউন ঘোষণা না করে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে কঠোর নীতি নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন অফিসের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্য জেলায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্ত ৫০ শতাংশের কাছে। তবে কুষ্টিয়ায় শনাক্ত কম। তাই প্রশাসন ধীরে হাঁটছে। জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম বলেছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মেনে তারা এখনও কাজ করছেন। করোনা সংক্রমণ যাতে না বাড়ে তারা সজাগ রয়েছেন। লকডাউন দেওয়ার প্রয়োজন হলে অবশ্যই কমিটির সুপারিশ মেনে তা কার্যকর করা হবে।
এদিকে দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে বাংলাদেশীদের যাতায়াতের ফলে সীমান্ত এলাকায় করোনা সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা বেড়েছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে গতকাল পর্যন্ত চোরাকারবারি ও ভারতের কেরালায় যাতায়াতকারী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি এ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সম্প্রতি কেরালাফেরত একজনকে বিজিবি আটক করে দৌলতপুর থানায় সোপর্দ করেছে। বিষয়টি গণমাধ্যমকে  নিশ্চিত করেছেন ওসি নাসির উদ্দিন ।
রোববার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৭ জনের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেছে। সংক্রমণের হার ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাতক্ষীরায় লকডাউন ঘোষণার সুপারিশ করলেও স্থানীয় প্রশাসন আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, করোনা সংক্রমণ রোধে জেলায় বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সীমান্তের চোরাপথে লোকজনের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এজন্য সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, কালিগঞ্জ, দেবহাটা এবং শ্যামনগরের কৈখালি ইউনিয়ন সংলগ্ন সীমান্ত পাহারায় স্থানীয়ভাবে প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে থাকছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, বিজিবি প্রতিনিধি ও ইউপি চেয়ারম্যানরা।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ১১ জন। সংক্রমণের হার ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে নাটোর জেলা ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করা হচ্ছে। জেলায় করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করলেও কঠোর লকডাউনের পক্ষে স্থানীয়রা। জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বলেছেন, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী কঠোর লকডাউনের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। মঙ্গলবার করোনা প্রতিরোধ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নওগাঁয় সর্বাত্মক লকডাউনের সুপারিশ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এ মুহূর্তে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে শ্রমজীবী মানুষ। বিশেষ করে এই জেলা এবার আম উৎপাদনে রেকর্ড করেছে। সেই আম-বাণিজ্যে ভাটা দেখা দিতে পারে। অবশ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সভাপতি অ্যাডভোকেট ডি এম আব্দুল বারী বলেছেন, আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তা যেভাবেই হোক। তবে কঠোর লকডাউন ঘোষণার আগে সবদিক বিবেচনায় রাখতে হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো: মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.