সৌদি-ইরান সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে যে বার্তা দিলো

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সৌদি আরব ও ইরান সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় সম্পর্ক জোড়া লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ১৯৭৯ সালে মিশর ও ইসরাইলের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি কিংবা ১৯৭২ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীনের সফরের মতো বিশাল কোনো ঘটনা নয়। তা সত্ত্বেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ঘটনা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক মহলকে নাড়া দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনকে দেশটির দীর্ঘদিনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ আকস্মিক কোনো ব্যাপার নয়। রিয়াদ ও তেহরান অনেক দিন ধরে এ নিয়ে পর্দার আড়ালে কাজ করেছে। চীন একে একটি যৌক্তিক পরিণতি দিয়েছে। অর্থনৈতিক শক্তি চীনকে কূটনীতির অঙ্গনেও ভূমিকা রাখার পথ সুগম করেছে। সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গে চীনের আগে থেকে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, যে কারণে এই মধ্যস্থতা করা সহজ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের সঙ্গেই চীনের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। চীন বুঝিয়ে দিয়েছে, তোমরা আমার জন্য কিছু করলে আমিও তোমাদের জন্য কিছু করব। একই সঙ্গে সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এই বার্তাও দিয়েছে যে, আমার সামনে অন্য বিকল্পও খোলা রয়েছে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। যেমন মিশর, সৌদি আরব ও ইসরাইল। কিছু দেশের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা নাই। আবার কয়েকটি দেশের বা পক্ষের সঙ্গে চলছে বৈরী সম্পর্ক। বৈরী দেশের এক নম্বরে আছে ইরান। চীন ও ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় অভিযোগের বিষয় মানবাধিকার। কিন্তু মিশরের মানবাধিকার রেকর্ড, ইয়েমেন সৌদির একতরফা যুদ্ধ এবং ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে যা করছে তা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে ওয়াশিংটন।
ইরানের ওপর নতুন আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা ইসরাইলকে দিয়ে যুদ্ধ বাঁধানো ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন কূটনৈতিকভাবে কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। সৌদি আরবকে যে এখন আর বাগে আনা সম্ভব নয় সেটা বাইডেনের গত বছরের সফর থেকে স্পষ্ট। তেল উত্পাদন বাড়াতে বাইডেনের অনুরোধে সাড়া দেয়নি রিয়াদ। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন বেশি কিছু করার নাই। এক্ষেত্রে তারা চীনের জন্য মাঠ খালি করে দিয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
সৌদি-ইরান সম্পর্ক এক হিসেবে চীন-মার্কিন বৈরিতার পুরোনো ইতিহাস সামনে নিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ওয়াশিংটন ও বেইজিং কি পরস্পরের সহযোগী না প্রতিপক্ষ হবে সেটাই এখন প্রশ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ প্রভাব ছিল। বিশ্ব তখন মূলত দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক দেশগুলো। এর ফলে একটি ভারসাম্য তখন ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ঐ ভারসাম্যে ছেদ পড়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে নয়া বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। অধিকাংশ দেশই শান্তি চায়, একই সঙ্গে এটাও চায় যে, অন্য কোনো দেশ তার ওপর হস্তক্ষেপ না করুক। সোভিয়েত যুগ অবসানের পর গত তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্বকে কিছু উদারনীতি গ্রহণের জন্য বারংবার বলে এসেছে। যেমন সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, মানবাধিকার, মুক্তরাজার অর্থনীতি ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়েছে তা বেশির ভাগ মানুষের ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপমূলক নীতি সমর্থন করে না বহু দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে জোরপূর্বক এটি করতে গিয়ে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত।
চীনের নীতি এক্ষেত্রে ভিন্ন। দেশটি অপর কোনো দেশের ওপর নিজের মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয় না। কোনো দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে বাধ্য করে না। গণতন্ত্রকামী মহলে এই নীতি সমাদৃত না হলেও এর বাস্তবমূল্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরও বটে। চীন, সৌদি আরব বা ইরান কোনোটিই ঘোষিত গণতান্ত্রিক দেশ নয়। যদিও ইরানে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়।  #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.