সেপ্টেম্বরে বন্ধ হচ্ছে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল 

খুলনা ব্যুরো: লোকসানী প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করা যাচ্ছে। এসব পাটকলে কর্মরত ২৫ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় বিদায় দেয়া হবে। যেজন্য সরকারের প্রয়োজন হবে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।
শ্রম আইন অনুযায়ী এজন্য দু’মাস আগে অর্থাৎ আগামী মঙ্গলবার (৩০ জুন) নোটিশ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সভায় এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ৪০% এবং বাকী ৬০% পাওনা টাকা পরবর্তী দু’টি অর্থ বছরে অর্থাৎ প্রতি বছর ৩০% করে পরিশোধ করা হবে বলেও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে বলা হয়।
এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে অবসরে গেছেন এমন নয় হাজার শ্রমিকের পাওনা ১৪শ’ কোটি টাকা এককালীন দেবে সরকার। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের জন্য সরকারকে গুনতে হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
পক্ষান্তরে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের( স্কপ) পক্ষ থেকে সরকারকে দেয়া প্রস্তাবনায় বলা হয়, তিন ধাপে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে মিলগুলোকে আধুনিকায়ান করা হলেই বন্ধ না করে লাভজনক পর্যায়ে চালু রাখা সম্ভব। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, মিলগুলো বন্ধ করা হলে প্রতিটি শ্রমিক প্রায় সাড়ে ১২ লাখ থেকে শুরু করে ৫৪ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবে।
একইসাথে মিলগুলো আবারো পিপিপি অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীর ভিত্তিতে চালানো হলে এসব শ্রমিকই সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। যদিও পিপিপি’র অতীত ইতিহাস কলংকের বলেও মনে করেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা। সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই পাটকল নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এমন আশংকাও অনেকের।
যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এজন্য আইন-শৃংখলা সংক্রান্ত যে কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সকল গোয়েন্দা ও আইন-শৃংখলা বাহিনী একযোগে কাজ করবে।
গত ২৫ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এক সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের বিষয়ে সার্বিক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। এতে পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী সভাপতিত্ব করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে সার্বিক বিষয় অবহিত করার জন্য আগামীকাল সোমবার (২৯ জুন) দুপুরে ঢাকার শ্রম ভবনে বৈঠক আহবান করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এতে সভাপতিত্ব করবেন।
যদিও গত ২৫ জুনের সভায় বেগম মন্নুজান সুফিয়ান উল্লেখ করেন, এ ব্যাপারে তার পূর্বে কিছু জানা ছিল না। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে তার পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। শ্রমিকদের পাওনা কীভাবে পরিশোধ করা হবে তা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কেননা ইতোপূর্বে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে পাটকল বন্ধ করা হলেও সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলে তা অবশ্যই পালন করতে হবে বলেও তিনি মনে করেন। যদিও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথেও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মত দেন।
ওই সভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলসমূহে বিরাজমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান এবং পাটখাতকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে গঠিত আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ, পাটকলসমূহে শ্রমিক সংগঠনের কার্যকলাপ, বিজেএমসি’র ক্রমাগত লোকসানের ফলে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় এনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলসমূহের বিরাজমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানের জন্য পাটকলসমূহ বন্ধ এবং তাতে কর্মরত স্থায়ী/নিয়মিত শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নসহ কিছু প্রস্তাবনা পেশ করা হলে প্রধানমন্ত্রী তাতে অনুমোদন দেন।
প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি মিলের সবক’টি আগামী পয়লা সেপ্টেম্বর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ঘোষণা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শ্রম আইনের ২৬ ধারার ১ উপ-ধারার ‘খ’ এর বিধান অনুযায়ী ৬০ দিন পূর্বে অর্থাৎ ৩০ জুন শ্রমিকদের চাকরীর অবসায়নের নোটিশ প্রদান করা যায়। তবে মিল বন্ধ ঘোষণার পর কোন দুষ্টচক্র বা স্বার্থান্বেষী মহল যাতে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সে লক্ষ্যে শ্রমিকদের চাকরীর অবসায়নের নোটিশ জারির অন্তত: একদিন পূর্ব হতে সব ক’টি মিল এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক আইন-শৃংখলা বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া মিল বন্ধের পর তার সকল সম্পত্তি সংরক্ষণ ও সুরক্ষা এবং বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে শ্রমিকদের পাওনাসহ মিলসমূহের অন্যান্য দায়-দেনা ২০২০-২০২১ হতে পরবর্তী দু’ অর্থ বছরব্যাপী যথাক্রমে ৪০%, ৩০% ও ৩০% হারে পরিশোধ করা যেতে পারে।
বন্ধের সুপারিশ করা মিলগুলো হচ্ছে, নরসিংদীর ইউনাইটেড মিল ও বাংলাদেশ জুট মিল, ঢাকার লতিফ বাওয়ানী জুট মিল ও করিম জুট মিল, নারায়নগঞ্জের জুটো-ফাইবার গ্লাস ইন্ডাষ্ট্রি, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস লি:, রাজশাহীর রাজশাহী জুট মিল, চট্টগ্রামের মিলস ফারনিশিংস লিমিটেড, গালফ্রা-হাবিব লিমিটেড, আমিন জুট মিলস্ লি:, হাফিজ জুট মিলস্ লি:, কেএফডি, এমএম জুট মিলস্ লি:, আরআর জুট মিলস্ লি:, বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরী ও গুল আহমদ জুট মিলস্ লি:, খুলনার দি ক্রিসেন্ট জুট মিলস্ লি:, দৌলতপুর জুট মিলস্ লি:, ইস্টার্ণ জুট মিলস্ লি:, খালিশপুর জুট মিলস্ লি:, প্লাটিনাম জুট মিলস্ লি:, স্টার জুট মিলস্ লি: ও আলিম জুট মিলস্ লি: এবং যশোরের যশোর জুট মিলস্ লি: ও কার্পেটিং জুট মিলস্ লি:।
অপরদিকে, স্কপের সুপারিশমালায় বলা হয়, লোকসানের অজুহাতে মিলগুলো বন্ধ না করে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে আধুনিকায়ন করা হলেই বর্তমান শ্রমিকদের দিয়েই মিলগুলো লাভজনক পর্যায়ে চালু রাখা সম্ভব।
এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেয়া হয়েছে। ওই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বাড়বে তেমনি কমে আসবে লোকসান। এক পর্যায়ে মিলগুলো লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছে অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
এ ব্যাপারে খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের শ্রমিক নূর ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, যাদের দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে মিলগুলো লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে মিল বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা পাট শিল্পের সাথে সরাসরি মাত্র ২৫ হাজার শ্রমিক জড়িত থাকলেও পরোক্ষভাবে এর সাথে তিন কোটি মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। সুতরাং বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার এক গভীর চক্রান্ত চলছে। মিল ধ্বংসের জন্য শ্রমিকরা নয়, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অপর শ্রমিক আবুল বাশার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ঘরে ঘরে চাকরী দেবে। কিন্তু আজ মিল বন্ধের মধ্যদিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে বেকার হচ্ছে। এটি একটি ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের সাথে কারা জড়িত সেটি খতিয়ে দেখারও দাবি জানান তিনি।
শ্রমিকদের নিয়ে রাজপথে বরাবর আন্দোলন করে আসছে বাম সংগঠনগুলো। এমন একটি সংগঠনের নাম বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। ওই দলের খুলনা জেলা সমন্বয়ক জনার্দ্দন দত্ত নান্টু বলেন, পাটকলগুলোর মেশিনারীজ অত্যন্ত পুরাতন।
এ মেশিনারীজ দিয়ে মিলগুলো আর লাভজনক করা সম্ভব নয়। এজন্য স্কপের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা দিয়ে নতুন মেশিনারীজ স্থাপন করে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা খরচ করলেই মিলগুলো লাভজনক করা সম্ভব। সুতরাং মিল বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করে তিনি আধুনিকায়নের মাধ্যমে মিলগুলো চালু রাখার দাবি জানান।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.