সুন্দরবনে চলছে মধু সংগ্রহ মৌসুম: মৌয়ালদের সংগ্রামে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি টাকা

খুলনা ব্যুরো: বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে চলছে মৌচাক থেকে মধু ও মোম সংগ্রহের বার্ষিক মৌসুম। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ৩১ মে পর্যন্ত চলবে এই সংগ্রহকাল। বৈধ পাসধারী মৌয়ালরা বন বিভাগের অনুমতিসাপেক্ষে প্রবেশ করছেন বনের অভ্যন্তরে। বন বিভাগ জানিয়েছে, এবারের মৌসুমে প্রায় ৩,৪৯০ কুইন্টাল মধু এবং ১,০৪৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার বিপরীতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মোঃ ইমরান আহমেদ বিটিসি নিউজকে বলেন, “মৌয়ালদের থেকে ১ কুইন্টাল (১০০ কেজি) মধুর জন্য ১,৬০০ টাকা এবং মোমের জন্য ২,২০০ টাকা হারে রাজস্ব নেওয়া হচ্ছে। এটি পরিবেশ রক্ষা ও সরকারি আয়ের একটি অন্যতম উৎস।” তিনি জানান, পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের আওতায় বৈধভাবে পারমিটপ্রাপ্ত নৌকাগুলো প্রতিদিন মধু ও মোম আহরণে নিয়োজিত রয়েছে।
সুন্দরবনে প্রথমে আসে খলিশা ফুলের মধু, এরপর গরান, এবং সবশেষে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু সংগ্রহ করা হয়। মৌয়াল রিয়াছাদ আলী সানা বলেন, “খলিশা ফুলের মধু দেখতে সাদা ও গাঢ়, এবং এটি সবচেয়ে সুস্বাদু ও দামি। একটি পরিপূর্ণ চাক থেকে ৫-৭ কেজি মধু পাওয়া যায়।”
একটি মৌয়াল দল ৭-৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়, যার নেতৃত্ব দেন ‘সুজুনি’। তারা দুই মাস সুন্দরবনের গভীরে অবস্থান করেন। সঙ্গে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, মিষ্টি পানি, রান্নার উপকরণ, কেরোসিন ও ওষুধ।
তবে সংগ্রহকাল জুড়ে জীবনের ঝুঁকি থাকে সর্বত্র। একদিকে বন্যপ্রাণীর আক্রমণ, অন্যদিকে চোরাকারবারীদের উৎপাত মৌয়ালদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মৌয়াল অভিযোগ করেন, “মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই কিছু অসাধু ব্যক্তি ‘জেলের ছদ্মবেশে’ মধু চুরি করে নেয়। ফলে আমরা বৈধভাবে পাস নিয়ে ঢুকে খালি বা অর্ধেক ভর্তি চাক পাই।”
সনাতনী পদ্ধতিতে মধু আহরণে আগুনের ধোঁয়া ব্যবহার করা হয়, যা মৌমাছিদের ডানার ক্ষতি করে। এতে বহু মৌমাছি মারা যায়, এমনকি রানী মৌমাছিও নষ্ট হয়। পরিবেশবিদরা বলছেন, এতে মৌমাছির প্রজনন হুমকিতে পড়ছে।এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এজেডএম হাসানুর রহমান বিটিসি নিউজকে বলেন, “চোরাকারবারীদের রুখতে টহল জোরদার করা হয়েছে। বন্যপ্রাণীর আক্রমণ এড়াতে মৌয়ালদের সচেতনভাবে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর আনোয়ারুল কাদির বিটিসি নিউজকে বলেন, “এই মধু আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যান্ডিং করলে বিশাল বৈদেশিক আয় সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধতা রক্ষা, প্রশিক্ষিত মৌয়াল, এবং দায়িত্বশীল আহরণ পদ্ধতি।” তিনি বন বিভাগকে প্রতি বছর মৌয়ালদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মোঃ বাবুল হাওলাদার বিটিসি নিউজকে বলেন, “কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগর ও শরণখোলার হাজারো পরিবার সুন্দরবনের সম্পদের উপর নির্ভরশীল। মধু, কাঁকড়া ও মাছ আহরণ করেই তাদের জীবিকা চলে।” তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “বনদস্যুদের পুনঃউৎপাত এবং প্রশাসনের সীমিত তৎপরতার কারণে তাদের জীবনযাত্রা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।”
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনের মধু কেবল একটি পণ্য নয়, এটি দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। সরকারের উচিত এই খাতকে পুষ্ট করে তোলা, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, যাতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায় এবং মধু রপ্তানি হয়ে উঠতে পারে এক লাভজনক শিল্প।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.