সিরাজগঞ্জ সদর পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত দিবস আজ

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ভোর রাতে সিরাজগঞ্জ শহরে পাক বাহিনী ঢোকে। মেজর মোহাম্মদ আরিফ পাক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার স্বচক্ষে সিরাজগঞ্জ জেলখানার বীভৎস্য চেহারা দেখার পর সিরাজগঞ্জ শহর ও গ্রামের ১০ মাইল পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়ার হুকুম দেন।
ঐদিন ভোর রাত হতে সিরাজগঞ্জ শহর ও আশপাশের গ্রাম সমূহ দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। ২৭-২৮ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ শহরের সকল দোকান পাট, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এভিনিউ, ধানবান্ধি, আটাচড়া, হোসেনপুর, রৌহাবাড়ী, মালশাপাড়া, পুঠিয়াবাড়ী, মীরপুর, রায়পুর, চর রায়পুর, রহমতগঞ্জ, ভাঙ্গাবাড়ী, রানীগ্রাম, দোয়াতবাড়ী, কোবদাসপাড়া, সয়াগোবিন্দ, মাহমুদপুর, মাছিমপুর, গুণেরগাঁতি প্রভৃতি পৌর মহল্লার অসংখ্য নিরীহ নাগরিকের বসতগৃহ ভস্মীভূত করা হয়।
৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখ হতে আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কলেজ মাঠ ও স্টেডিয়াম মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কলেজ মাঠে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান, ল্যান্স নায়েক লুৎফর রহমান অরুন এবং রবিউল ইসলাম (গেরিলা)। স্টেডিয়াম মাঠে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সহকারী আনসার কমান্ডার বাহাজ আলী, সেনা সদস্য আমজাদ হোসেন ও রাইফেল ক্লাবের সদস্য জহুরুল ইসলাম মিণ্টু ।
মুক্তি সংগ্রাম আমাদের জাতীয় জীবনে এক অবিষ্মরণীয় অধ্যায়। সিরাজগঞ্জের আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতার শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে এই সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম ভাগেই স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, যানবাহন, রেলস্টীমার, মিল কারখানা সব বন্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা দেন ও আওয়ামীলীগ কর্মীবৃন্দ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন মরহুম মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএলএ এবং সদস্য সচিব ছিলেন জনাব আনোয়ার হোসেন রতু।
একই সাথে জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, যার আহবায়ক ছিলেন আলমগীর। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ৩ মার্চ, ১৯৭১ জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তৎকালীন ছাত্র নেতা জনাব এম.এ রউফ পাতা প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
পাক বাহিনী যাতে সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য শাহজাদপুর উপজেলাধীন বাঘাবাড়ী ফেরীঘাটে স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শহীদ শামসুদ্দিন উক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধে সার্বিকভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এমনকি তিনি অস্ত্রাগার হতে সকল অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন।
প্রবল প্রতিরোধের কারণে এক মাস পর ২৬ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ শহরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে। পাক বাহিনী প্রবেশ করেই নির্বিচারে শহরের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, লুটতরাজ করে, নিরীহ জনগনকে হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতন করতে থাকে।
পাক সেনারা সিরাজগঞ্জ দখল করার পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধারা উচচতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং আধুনিক অস্ত্রের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে ভারতে গমন করেন। ভারতে প্রশিক্ষণগ্রহণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাগণ সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন এবং পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন।
উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে যুব শিবিরের নেতৃত্বে ভদ্রঘাট, ব্রক্ষ্মগাছা ও নওগাঁর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম যুদ্ধ ছিল। ৭ নং সেক্টরের এফ উইং এর নেতৃত্বে কাজিপুর থানা দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দুবার থানা আক্রমণ করেন এবং বড়ইতলীতে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সকল যুদ্ধে বেশ কিছু পাকসেনা হতাহত হয় এবং সাত জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৭ নং সেক্টরের এফ উইং এর নেতৃত্বে বেলকুচি থানা দখলের জন্য আরও একটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা থানার দখল গ্রহণ করে থানার সকল অস্ত্র হেফাজতে নেন এবং ১২ জন রাজাকারকে গ্রেফতার করেন। এতে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
বেলকুচির রাজাপুর, শমেসপুর ও কালিয়াহরিপুর ব্রীজে এফএফদের নেতৃত্বে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পলাশডাঙ্গা যুব শিবির, এফএফ ও বিএলএফ এর মুক্তিযোদ্ধাগণ একে একে তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া ও শাহ্জাদপুরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ঐ সকল এলাকা দখল করে নেয়।
সর্বশেষে ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সিরাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাগণের অধিকাংশ দল একত্রে সিরাজগঞ্জ শহরের উত্তরে শৈলাবাড়ি পাক হানাদার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এখানে সিরাজগঞ্জ এর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে পাক বাহিনী পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে এবং তারা ব্যাপকভাবে হতাহত হয়। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ার আহসানুল হাবিব ও সোহরাব আলীসহ ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
অবশেষে মিত্র বাহিনীর কোনরূপ সহায়তা ছাড়াই ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সিরাজগঞ্জ এর বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সিরাজগঞ্জ শহরকে এবং ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সমগ্র সিরাজগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করেন। সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্নস্থানে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে যে সকল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা  নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মরহুম মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএলএ, মরহুম আব্দুল মোমিন তালুকদার এমএলএ, সৈয়দ হায়দার আলী এমপিএ, মরহুম রওশনুল হক এমপিএ, আনোয়ার হোসেন রতু, মরহুম শহিদুল ‎ইসলাম তালুকদার, মরহুম আমির হোসেন ভুলু, মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জা, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুস সামাদ, ইসমাইল হোসেন, জহুরুল ইসলাম তালুকদার, গোলাম হায়দার খোকা, আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, মোজাফ্ফর আহমেদ, ইসাহাক আলী, এম এ রউফ পাতা, বিমল কুমার দাস, শেখ আলাউদ্দিন, সোহরাব আলী, আমজাদ হোসেন মিলন, লুৎফর রহমান অরুণ, খ ম আকতার হোসেন, ফজলুল মতিন মুক্তা, টি এম শামীম পান্না, মরহুম শাহ্জাহান আলী তারা, মরহুম ইসমাইল হোসেন, শফিকুল ইসলাম শফি, কে এম হোসেন আলী হাসান, আবু ইউসুফ সূর্য্য প্রমুখ।
সিরাজগঞ্জ জেলার সরকারী ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী কোন উপজেলা কত তারিখে শত্রুমুক্ত হয় তার একটি তালিকা দেখুন:————-
# সিরাজগঞ্জ সদর পৌরসভাসহ-১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# কামারখন্দ উপজেলা-১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# কাজিপুর উপজেলা-৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# বেলকুচি উপজেলা-১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# রায়গঞ্জ উপজেলা-১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# তাড়াশ উপজেলা-১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# চৌহালী উপজেলা-২৫শে নভেম্বর ১৯৭১,
# উল্লাপাড়া উপজেলা-১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
# শাহজাদপুর উপজেলা-১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১,
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি মোসুলতান হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.