সাতক্ষীরায় রংমিস্ত্রীর হত্যার ঘটনার নেপথ্যে সোনা ও মাদক পাচার! আটক-৪

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের থানাঘাটা শেখপাড়ার রংমিস্ত্রী আব্দুস সালাম হত্যার ঘটনার নেপথ্যে সোনা ও মাদক পাচার ছাড়াও নারী ঘটিত কোন রহস্য রয়েছে মর্মে এলাকায় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। এ ঘটনায় পুলিশ এক নারীসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।
এদিকে আব্দুস সালাম হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সোনা ও মাদক চোরাচালানি সি-িকেড এতটাই হিংস্র যে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে সাতক্ষীরা সদরের লাবসা ইউনিয়নের থানাঘাটা শেখপাড়ার নিহত আব্দুস সালামের বাড়িতে যেয়ে দেখা গেছে, বাড়ির উঠানে বুধবার রাতে কবরস্থ করা হয়েছে নিহতের লাশ।
বাড়িতে অবস্থানকারি নিহতের মামা শেখ সোহরাব হোসেন জানান, তিনিসহ তার নয় বোন ছিল। দুই বোন মারা গেছে। মা আমেনা খাতুনের অংশে পাওয়া পাঁচ কাঠা জমি সালামের মা সালেহা খাতুন বিক্রি করে দিলেও বর্তমানে তারা বড় বোন(সালামের খালা) সুফিয়া খাতুনের নামে রেকর্ডীয় এক কাঠা জমিতে বসবাস করে আসছিল। কখনো রংমিস্ত্রী আবার কখনো ঘরের মিস্ত্রী ছাড়াও বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাতো সদালাপী সালাম। একমাত্র মেয়ে তুলিকে দু বছর আগে যশোরের শার্শা উপজেলার শানকোনা গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন।
বৃদ্ধা সালেহা খাতুন বিটিসি নিউজকে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে তালের বড়া খেতে খেতে কদমতলার বাঁশতলা দক্ষিণপাড়ার মোকাদ্দেসের ছেলে হাসান বাড়ি থেকে সালামকে ডেকে নিয়ে যায়। একঘণ্টা পর তারা খবর পান যে সালামকে পার্শ্ববর্তী শাহীনের আমবাগানের নিকটে ইয়াছিনের বাড়ির সামনে কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে গেছে দুর্বৃত্তরা। এরপর তারা সালামকে প্রথমে হার্ট ফাউ-েশনে নিয়ে গেলে চিকিৎসার ৪০ হাজার টাকা, পরে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে বলা হয়। কাছে ১৭০ টাকা থাকায় তাকে পরে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
একপর্যায়ে অবস্থার অবনতি হওয়ায় খুলনায় স্থানান্তরের কথা বলা হলে সেখান থেকে বের করার কিছুক্ষণ পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে সালাম মারা যায়। সালামকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পাঁচজন তাকে কুপিয়েছে বলে জানায়। তবে সালামকে মারপিটের পর এলাপাতাড়ি কুপিয়ে জখম ছাড়াও তার অ-কোষ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। এ সময় তার পিঠে সিরিঞ্জ এর নিডিলের মাধ্যমে শরীরে হাওয়া ঢোকানো হয়েছে।
পুলিশ বুধবার দুপুরে রাস্তা থেকে ঘটনাস্থলের পাশের বাসিন্দা কদমতলা বাজারের মুদি ব্যবসায়ি মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী হাফিজা ও সালামের জানাজায় অংশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাত ৯টার দিকে কদমতলার (বাঁশতলা দক্ষিণপাড়া) মোকাদ্দেস এর ছেলে হাসানকে, রাত ১২টার দিকে রসুলপুরের আফতাব এর ছেলে মনু, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আটক করেছে। হামলাকারিদের নাম উল্লেখ না করেই সালেহা খাতুন বলেন, সন্ত্রাসীরা অনেক বেশি শক্তিশালী। মামলা করলে তাদেরকেও জীবন হারাতে হবে। তাই তারা মামলা করবেন না।
এ দিকে স্থানীয় একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সোনা ও মাদক পাচারের একাধিক চক্র রয়েছে তাদের এলাকায়। নিহত আব্দুস সালাম, আটককৃত হাসান, নলকুড়ার সোহাগ, হারুন, একই এলাকার ইয়ারুলসহ একটি চক্র কখনো গোলাম কিবরিয়া বাবু আবার কখনো কাটিয়ার গোল্ড মনির মালামালের বহনকারি হিসেবে কাজ করে থাকে। সালামসহ কয়েকজনের সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী মক্ষীরানী হাফিজার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে মনির সঙ্গে সমঝোতা করে হাসান ও সালাম। এতে গোলাম কিবরিয়ার প্রায় দুই কোটি টাকার সোনা খোয়া যায়। ফলে টাকার শোক সইতে না পেরে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে অংশ নিতে পারেনি গোলাম কিবরিয়া। এরপর থেকে সালাম ও হাসান গোল্ড মনির হয়ে কাজ করতো। ভারতে সোনা পাঠিয়ে সেখান থেকে ফেন্সিডিল, গাজা, ইয়াবা ও ভারতীয় মোবাইল সেট নিয়ে আসতো তারা। এ সব মালামাল হাসান খুলনায় বিক্রি করতো। মাদক ও সোনা পাচারের টাকায় রসুলপুরের জাকির হোসেনের স্ত্রী দুই সন্তানের জননী মীরাকে বিয়ে করে। তার নামে নিজ বাড়ির পাশে সম্প্রতি একটি জমিও কিনেছে। কিন্তু মনি বর্তমানে ভারতের জেলে অবস্থান করায় হাসান,সালামসহ একটি গ্রুপের সময় ভালো কাটছিল না। সালাম এলাকায় খুচরা মাদক বিক্রি করতো।
এক সপ্তাহ আগে সালাম আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার হাতে ইয়াবাসহ আটক হয়। তাকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনে হাসান। ওই টাকা ফেরৎ দেওয়ার জন্য চাপসৃষ্টি করে আসছিল হাসান। লুট হওয়া সোনা ভাগাভাগি নিয়ে দেড় বছর আগে ইয়ারুলকে কদমতলা বাজারে বেধড়ক পেটায় গোলাম কিবরিয়া ও তার লোকজন। সোনা ও মাদক পাচার চক্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন যুবলীগের জেলা পর্যায়ের সাবেক এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।
তবে সালাম হত্যকান্ডের রহস্য উন্মোচনে পুলিশ, র‌্যাব, সিআউডি ও পিবিআই ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আন্তরিক ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্রটি আরো জানায়, বিগত দু’সপ্তাহ আগে ঢাকার এক ব্যবসায়ির সোনা নিয়ে সাতক্ষীরায় আসছিল বাবু মেম্বরের খালাতো ভাই থানাঘাটার হারুন। খুলনা থেকে সাতক্ষীরার মধ্যে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার সোনা ছিনতাই করে হাসান, সালামসহ একটি চক্র। ওই সোনা ভাগাভাগি নিয়ে গোলাম কিবরিয়ার সাথে হাসান ও সালামের নতুন করে বচসা হয়। এসব ঘটনার জের ধরে সালামকে মঙ্গলবার রাতে নৃশংসভাবে খুন করা হতে পারে।
এদিকে স্থানীয় অপর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া, পলাশপোল, রসুলপুর, কাশেমপুর, থানাঘাটা এলাকায় আরো একটি সোনা লুটপাটের চক্র রয়েছে। এর নেতৃত্ব দিয়ে থাকে কালিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণশ্রীপুর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের ফজর আলীর ছেলে ও সদরের থানাঘাটার আব্দুর রহমান মুহুরীর জামাতা (শ্বশুর বাড়িতে অবস্থানকারি) রাশেদ ও রসুলপুরের মনু ড্রাইভার।
বর্তমানে মনু ড্রাইভার সদর হাসপাতাল মোড় এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। রাশেদ ও মনু উভয়ের কাছে পুলিশের নকল পোশাক ও অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এদের নেৃতৃত্বে সাত মাস আগে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বাইপাস সড়কে সোনা ছিনতাই করে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলো কাটিয়া লস্করপাড়ার রেজাউল ইসলাম টুটুল, তার দুই ছেলে, টুটুলের স্ত্রী, একই এলাকার সাবিবর হোসেন, শ্যামনগরের কৈখালির বর্তমানে কাটিয়া মাঠপাড়ার ভাড়াটিয়া হারুন, কাটিয়া লস্করপাড়ার মঞ্জু। এ ছিনতাই মামলায় টুটুলের বড় ছেলে জেলে ছিলো। পরে ছিনতাই হওয়া মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িকে ফেরৎ দিয়ে ও আইনপ্রয়োগকারি সংস্থাকে ম্যানেজ করে টুটুল ও তার সহযোগিরা প্রকাশ্যে আসে বলে জনশ্রুতি আছে। মনু ড্রাইভার ও রাশেদের সহযোগী থানাঘাটার বাবলু ২০১৯ সালে সোনা লুট করতে যেয়ে ধরা পড়ে দীর্ঘদিন জেল খেটে বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম বৃহষ্পতিবার বিকেলে বিটিসি নিউজকে জানান, সালাম হত্যাকান্ডের কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা না হলে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে। সালাম হত্যাকান্ডে জড়িতরা খুব শ্রীঘ্রই গ্রেপ্তার হবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.