সাতক্ষীরায় বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন, ভাংচুর, লুটতরাজ!, সংহিতায় নিহত সংখ্যা বেড়ে-১৫

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সাতক্ষীরায় বিরাজ করছে পাথরের নীরবতা। আতঙ্কে গা-ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী। ব্যবসায়ী ও সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের মানুষের কাছে চাঁদা দাবি ও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
জেলার অধিকাংশ বাজারের সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সন্ধ্যার পর জেলা জুড়ে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক। দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগ অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, একজন সংসদের বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে সাতক্ষীরা। জেলার ৮টি থানার ৫টি-ই আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে ছাই হয়েছে থানার নথি ও অন্যান্য সরঞ্জাম। লুট করা হয়েছে থানায় রক্ষিত বিভিন্ন মালামাল। লুট হওয়ার থানার পাহারা দেয় দৃবৃত্তরা।
এদিকে সাতক্ষীরা কারাফটক ভেঙে সকল আসামীদের বের করে দেওয়া হয়। এছাড়া ধমীয় সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত সোমবার দুপুর দুটোর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীসভার পদত্যাগের পর আন্দোলনকারিরা শহরের খুলনা রোডের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও জেলা পুলিশ সুপারের বাসভবনের ফটক ভাংচুরে করে। পরে তারা সদর থানার ফটক ও ট্রাফিক পুলিশ অফিসে হামলা চালায়।
থানা ফটকের সামনে ও ট্রাফিক পুলিশ অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপরপরই আন্দোলনকারিরা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পলাশপোলের বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহম্মেদের বাড়ি, সুলতানপুরে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহম্মেদ শুভ্র, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নানের সিটি কলেজের সামনের বাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের শ্রমিকলীগের অফিস, পাকাপুলের পাশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পুরাতন অফিস, বৈকারী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান অসলের বাড়ি, কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যুবলীগ নেতা শাহাজাদার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তালা উপজেলার খলিলনগর ইউপি চেয়ারম্যান প্রণব ঘোষ বাবলুর বাড়ি, তালা যুবলীগের সভাপতি মীর জাকির হোসেনের অফিস, তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নুরুল ইসলামের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কালিগঞ্জের নারায়নপুরে আওয়ামী লীগ নেতা তৌহিদের নিয়ন্ত্রণাধীন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ, কালিগঞ্জ রিপোর্টার্স ক্লাব, নলতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আশাশুনির প্রতাপনগরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের বাড়ি, মানিকখালি ব্রীজের টোলপ্লাজা, শ্যামনগরের রমজাননগরের ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি বরেন্দ্র বৈদ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নূরনগর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানার বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে দৃবৃত্তরা।
ভাঙচুর করা হয় পুরাতন সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগ অফিস, পোষ্ট অফিস মোড়ের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জজ কোটের পাশে অ্যাড. তামিম আহম্মেদ সোহাগের বাড়ি, কাটিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের সদস্য সচীব হাসান ইমামের বাড়ি, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেনের বাড়ি, আবাদেরহাটের বুলবুলের ফলের দোকান, কাশেমপুরের সাংবাদিক সেলিম হোসেনের বাড়ি ভাংচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ, তুজুলপুরের সাংবাদিক ইয়ারব হোসেনের অফিস, শিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের অফিস, আগরদাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইন্দিরা গ্রামের হাবিবুর রহমান হবির বাড়ি, কুচপুকুরের নজরুলের বাড়ি, ঝাউডাঙা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রমজান আলী বিশ্বাসের বাড়ি, তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সনৎ ঘোষের বাড়ি, আশাশুনির বড়দল ইউপি চেয়ারম্যান জগদীশ সানার বাড়ি, আশাশুনি সদরের রণজিৎ কুমার বৈদ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শ্যামনগরের ভেটখালি বাজারের কৃষ্ণপদ রায়ের চায়ের দোকান, তার ছেলে মিলন রায়ের মোটর সাইকেল, আল ফারুক ও তার ছেলে লিঙ্কনের মাইক্রোবাস ও মটর সাইকেল, কালিগঞ্জের নলতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আনিছুজ্জামান খোকনের বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল খালেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্ঠান ঐক্য পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি পাটকেলঘাটা বাজারের সার, কীটনাশ ও বীজ ব্যবসায়ি বিশ্বজিৎ সাধুর বাড়ি ও অফিস, রুপায়ন হাজরার মোবাইল দোকান, সাতক্ষীরা- ১ (তালা- কলারোয়া) আসানের সাংসদ ফিরোজ আহম্মেদ স্বপনের বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।
সাতক্ষীরায হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৫ জন নিহত হওযার খবর পাওযা গেছে। গত বিকেল থেকে  মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকাল পর্যন্ত এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
নিহতদের মধ্যে সাবেক ইউনিযন পরিষদ চেযারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেনসহ অধিকাংশই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী রয়েছেন বলে জানা গেছে। তালিকায় বিএনপির দুই নেতাকর্মীও আছেন।
নিহতরা হলেন—আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিযন আওযামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন, তার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন, ভাতিজা সজিব হোসেন, ভাগ্নে আশিকুর রহমান, আতœীয সাকের আলী ও গাড়ি চালক শাহিন হোসেন।
এছাডা ওই আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক চেযারম্যান জাকির হোসেনের ছোডা গুলিতে কল্যাণপুর গ্রামের আদম আলী (২৫), কোলা গ্রামের আনাজ বিল­াহ (১৭) ও কুড়িকাউনিযা গ্রামের আনাজ আলী (১৮) নিহত হযেছেন। তারা শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
প্রতাপনগর ইউনিযন পরিষদের চেযারম্যান আবু দাউদ ঢালী ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান, কিছু লোক শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আনন্দ মিছিল বের করে ও জাকির হোসেনের বাডিতে ভাংচুর শুরু করে। এ সময, জাকির হোসেন তার অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে তিন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
পরে গ্রামবাসীরা জাকির হোসেনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে গণপিটুনি দিলে জাকির হোসেনসহ ছয জন নিহত হয। মঙ্গলবার দুপুরের পর সেনাবাহিনী এলাকায এসে তাদের দাফনের ব্যবস্থা করে।
অন্যদিকে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আসাফুর রহমান (৪০), মৃগাডাঙ্গা গ্রামের তৌহিদ ইসলাম (৩০), সাইফুল ইসলাম (২৫), বিএনপি কর্মী জাহিদ হোসেন (২৮) ও ফারুক হোসেন (৩৫) নিহত হয়েছেন।
জানা গেছে, সোমবার দিবাগত রাতে সদর উপজেলার বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আসাফুর রহমানকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রাত নয টার দিকে মৃগিডাঙ্গা গ্রামের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে মৃগিডাঙ্গা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী তৌহিদ ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, বিএনপির কর্মী জাহিদ হোসেন ফারুক হোসেন নিহত হয।
এছাডা তালা সদরের দক্ষিণ আটারই গ্রামের বিএনপি কর্মী কাদের মোডলও (৬৫) নিহত হয়েছেন। জানা গেছে, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চলে এ ধ্বংসযজ্ঞ। আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউপির সাবেক চেয়াম্যান নাকনা গ্রামের জাকির হোসেনের বাড়িতে হামলা করা হলে তিনি ছাঁদ থেকে গুলি ছুঁড়লে আন্দোলনকারিরা কুড়িকাহনিয়া গ্রামের হারেজ আলী মোড়লের ছেলে হাফেস আনাস বিল্লাহ, কল্যানপুর গ্রামের নূর হোসেনের ছেলে আদম আলী ও কোলা গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে আলম নিহত হন।
গুলি শেষ হয়ে গেলে ক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়িতে লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে জাকির হোসেন ও স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে কুপিয়ে, জাকির হোসেনের এক ভাইপো, এক ভাগ্নে ছাড়াও তার দাই দেহরক্ষীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এদিকে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুড়িয়ে দেওয়ায় বন্ধ রয়েছে সব কার্যক্রম। ফলে কেউ আক্রান্ত হলে অভিযোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। মঙ্গলবার বিকালে সেনাবাহিনীর তরফে আইনশৃঙৃখলা বজায় রাখতে মাইকিং করেছে। এদিন সন্ধ্যায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে সাতক্ষীরা শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করে। বুধবার তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালায়। এছাড়া শহরে যানজট নিরসনে ও দুর্ঘটনা রোধে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর সাতক্ষীরা সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ, দুইজন ইউপি চেয়ারম্যান, দুটি পত্রিকা অফিস, কমপক্ষে ৫টি থানা, একজন চিকিৎসকের বাড়ি, আওয়ামীলীগ সভাপতিসহ কমপক্ষে ৫০টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা সংরক্ষিত নারী সাংসদ লায়লা পারভিন সেঁজুতির বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে একটি মোটর সাইকেলসহ দৈনিক পত্রদূত পত্রিকা অফিসে আগুণ লাগিয়ে দেয়।
পরে তার ব্যবহৃত নতুন নোহা গাড়িটি বাড়ি থেকে বাইপাস সড়কে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। প্রায় একই সময় আন্দোলনকারীরা শহরের বাস টার্মিনাল এলাকায় দৈনিক কালের চিত্র অফিসে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। তবে খবর পেয়ে ফায়ার ব্রিগেড এলেও তাদেরকে আগুন নিভাতে দেওয়া হয়নি। রসুলপুরের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আজিজুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুর ও লুট্পাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ভাঙচুর করা হয় শহরের আলবারাকা মার্কেটে।
একইভাবে ধুলিহর বাজারে ডাঃ দীনেশ দত্তের ফার্মেসী ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। থানা থেকে পুলিশ চলে যাওয়ার সূযোগে মামলা থাকার পরও প্রতিপক্ষ কালিপদ দাসের ছেলে সরোজিৎ কুমার দাস ও রণজিৎ কুমার দাস ৩০/৪০ জন ভাড়াটিয় সন্ত্রাসী নিয়ে দেবনগরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নিরঞ্জন দাসের বাড়ির প্রাচীর ভেঙে, ১১টি আমগাছ, মেগহনি গাছ, নারিকেল গাছ কেটে জোর করে ইট দিয়ে বাড়ির উপর দিয়ে রাস্তা বানিয়েছে। বাধা দেওয়ায় নিরঞ্জন দাস ও তার স্ত্রীকে মারপিট করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সদরের রামচন্দ্রপুরের রুহুল আমিন হাজীর গোয়াল থেকে গরু ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় মাসুদ-রিপন বাহিনী। তারা ব্রহ্মরাজপুর বাজারের একাধিক সংখ্যালঘুর দোকান দখল করে নিয়েছে। সংখ্যালঘু ও ব্যবসায়ীদের নিকট দাবি করছে জনপ্রতি দেড় থেকে তিন লক্ষ টাকা। চাঁদা না দিলে দেওয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি। এতে আতঙ্কে ওই বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ রেখেছেন বলে জানান।
এদিকে, সাতক্ষীরা সদর থানায় আন্দোলনকারিরা দফায় দফায় হামলা চালায়। করা হয় অগ্নিসংযোগ। এ সময় পুলিশ শূন্যে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। এরপরও হামলাকারিরা থানায় থাকা কমপক্ষে ৭০টি মটর সাইকেল লুট করে নিয়ে যায়। থানার ভবন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, তদন্ত ওসির কক্ষ, উপ-পরিদর্শকদের বসার কক্ষ ডিউটি অফিসারের কক্ষ, ব্রাকসহ কমপক্ষে সাতটি কক্ষ ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এরপর একটি কক্ষে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
একইভাবে শ্যামনগর থানায়ও ভাঙচুর, লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তালা থানার মধ্যে দুটি মটর সাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও দুটি মটর সাইকেল লুট করা হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় কলারোয়া ও আশাশুনি থানায়। এছাড়া দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও পাটকেলঘাটায় হামলার আতঙ্কে পুলিশ কর্মকর্তারা থানা ছেড়ে চলে যায়। নামমাত্র দুই তিনজন সিপাহী ওইসব তিন থানার ভিতরে তালা মেরে অবস্থান করছেন।
এদিকে কালিগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সজল মুখার্জীর বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় পুড়ে জখম হয় তার প্রতিবন্ধী বোন রমা মুখার্জী। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় ওই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাজা’র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রতনপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফুল আলমের বাড়ির গ্লাস ভাঙচুর করা হয়।
লুটপাট শেষে আগুন দেওয়া হয় রতনপুর বাজারের জুয়েলারী ব্যবসায়ি খোকন দত্তের দোকান। একই উপজেলার শ্রীধরকাটি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সিদ্দীকুর রহমানের বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি, বিষ্ণপুর গ্রামের কলেজ শিক্ষক সনৎ গাইনের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
ভাাড়শিমলা ইউপি সদস্য বরুন কুমার ঘোষের চাউলের গুদাম “মা লক্ষী ভাণ্ডার” এ লুট করা হয়। ভাংচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয় শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান অসীম মৃধা, বুড়িগোয়ালিনীর ডালিম ঘরামী, ভবতোষ মন্ডল, সাবেক চেয়ারম্যান অসীম কুমার জোয়ারদার, কদমতলার সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম, মলয় রপ্তান, উৎপল জোয়ারদার, হরিনগর বাজারের অসীম মণ্ডলের কসমেটিকস দোকান, নিরঞ্জন মণ্ডলের ম্যাকানিকের দোকান, মোস্তফার চায়ের দোকান, কলবাড়ি বাজারের কার্তিক মণ্ডল ও বলাই মণ্ডলের দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সদর ইউনিয়নের চিংড়িখালি গ্রামের দেবদাস এর বাড়ি থেকে টাকা, সোনার গহনা ও মটর সাইকেল লুটপাট করা হয়।
চিংড়িখালি দুর্গা মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি রামপদ মণ্ডলের বাড়িতে ঢুকতে না পেরে উঠানে আগুন জ্বালানো হয়। ফুলবাড়ি গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য রামপদ এর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। ভাংচুর ও লুটপাট করা হয় দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক তিলকুড়া গ্রামের ফারুক হোসেন রতনের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান ও নওয়াপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন ওরফে সাহেব আলীর অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিক মাহামুদুল হাসান শাওনের সখীপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
শ্যামনগরের রমজাননগর গ্রামের হরিপদ বর্মন ও তার ভাই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুন বর্মনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট শেষে তাদেরকে কুপিয়ে জখম করা হয়। তাদেরকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় খুলনা ৫০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পূর্ব বিরোধকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলার মৃগীডাঙা গ্রামের জাহিদ, মুকুল, ফারুক ও ঘোনা গ্রামের সাইফুলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মুকুলের বাড়ি গোলা থেকে ধান ও চাল লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় মারাত্মক জখম হয় মৃগীডাঙা গ্রামের আশরাফুল ইসলাম ও মোস্তফা কামাল। তালা উপজেলার কুমিরায় কমপক্ষে ২০টি হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করা হয়।
এছাড়া বাড়ি ভাংচুর না করার শর্তে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এ ছাড়া শেখেরহাট, মাগুরা বাজার, খেজুরবুনিয়া ও খলিলনগর বাজারসহ কয়েকটি বাজারের ১০ জনেরও বেশি হিন্দু ব্যবসায়িদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট করা হয়। তালা উপজেলার মাগুরা আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ আটঘরা গ্রামের রামপ্রসাদ দাস, জালালপুর ইউপি’র ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক রায়, শ্রীমন্তকাটি গ্রামের মিন্টু ও সন্টু দাসের কাপড়ের দোকান, শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের সভাপতি মেহেদী হাসানের রড সিমেন্টের দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। জালালপুর বাজারের ফার্মেসি মালিক জেলা পরিষদ সদস্য ইন্দ্রজিৎ দাসের পানের বরজ তার কেটে ফেলে দেওয়া হয়।
এদিকে জেলখানা থেকে চলে যাওয়ার সময় আসামী ও কারা কর্তৃপক্ষের সাথে হাতাহাতিতে কমপক্ষে ৫৫ জন আহত হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন জেলর হাসনা জাহান বিথীসহ ২১ জন কারারক্ষী ও কর্মকর্তা। এসময় আন্দোলনকারীরা শতাধিক কারারক্ষীর রেশন, পিসি কার্ডের টাকা ও ক্যান্টিনের ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লুটপাট করে। কারাগার থেকে চলে যায় ৫৯৬ জন আসামী। এদের মধ্যে দুই শতাধিক আসামী মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে আবার কারাগারে ফিরে এসেছে। সার্বিক বিষয়ে ৬ আগস্ট বিকেলে সাতক্ষীরায় জেলা আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মতিউর রহমান সিদ্দিকী, জেলা বিএনপি’র আহবায়ক এডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী, জামায়াতের সাতক্ষীরা জেলা আমীর মুহাদ্দিস রবিউল বাশার, সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতী, জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর উপাধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম মুকুল, সেক্রেটারী মাওলানা আজিজুর রহমান, লেঃ কঃ আরিফুল ইসলাম, বিজিবির সিও প্রমুখ।
সেনাবাহিনীর লেঃ কর্ণেল আরিফুল ইসলাম বলেন, জেলার কোথাও কোন অরাজকতা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করলে শাস্তি পেতে হবে। জেলার সবকটি উপজেলাতে সেনা চৌকি বসানো হবে। তিনি রাজনৈতিকদল সহ সর্বস্তরের মানুষের সহযোগীতা কামনা করেন। তিনি আশ্বস্থ করেন দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসলে তারা দ্রুত ব্যারাকে ফিরে যেতে পারবেন।
পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মতিউর রহমান সিদ্দিকী বলেন, জেলার সবকটি উপজেলার থানাগুলোতে পুলিশ কাজ শুরু করার প্রক্রিয়া চলছে। সভায় জেলা বিএনপি’র আহবায়ক এডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী, জেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থির দ্রুত উন্নয়ন করতে তার দলের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগীতার আশ্বাস দেন।
সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতী বলেন, শহরের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে তার পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে। সদর থানার চার পাশে নিরাপত্তা বলায় গড়ে তোলা হয়েছে। পুলিশ কার্যক্রম শুরু করলেই জেলাতে শান্তি ফিরিয়ে আসবে।
সাতক্ষীরা জেলা আমীর মুহাদ্দিস রবিউল বাশার বলেছেন, যেখানেই দুর্বৃত্তপনা দেখবেন, তৎক্ষণাৎ এদের প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা কথা দিচ্ছি, বিদ্যমান প্রশাসনকে এ বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে সংবাদ সম্মেলন করেন। এসময় সমম্বয়ক ইমরান হোসেন বলেন, আমাদের আন্দোলন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সরকার পতনের আন্দোলনের পর এখন আমরা রাষ্ট্রসংস্কারের দাবি জানাই। শেখ হাসিনা পদত্যাগ পরবর্তী সাতক্ষীরার সহিংসতার কোন দায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেই বলে জানান তিনি।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মো. সেলিম হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.