বিটিসি বিনোদন ডেস্ক: হলিউড আকাশে কিছু নাম আছে, যেগুলো হঠাৎ করে আলো ছড়িয়ে দেয়। আলোটা কখনও উজ্জ্বল, কখনও রহস্যময়, আবার কখনও বা বিধ্বংসী। সেই আলোরই এক নতুন নাম সিডনি সুইনি। বয়স মাত্র ২৮, অথচ ইতোমধ্যে তিনি হয়ে উঠেছেন নতুন প্রজন্মের এক আইকন; যিনি একই সঙ্গে সংবেদনশীল, বেপরোয়া, আত্মসচেতন আর এক অদ্ভুত বাস্তবতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
ওয়াশিংটনের শান্ত, নির্জন, পাহাড়ের কোলঘেরা ছোট্ট শহর স্পোকেন। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু এই প্রতিভাবান অভিনেত্রীর। সাধারণ এক মধ্যমবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সিডনি ১১ বছর বয়সেই নিজের ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা লিখে ফেলেছিলেন এক খাতায়। পাঁচ বছরের লক্ষ্য, কোন কোন অডিশনে অংশ নেবেন, কাকে কীভাবে মুগ্ধ করবেন–সবকিছুরই ছিল খুঁটিনাটি রোডম্যাপ। সেই কঠোর পরিকল্পনা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাঁকে নিয়ে আসে লস অ্যাঞ্জেলেসে। শুরু হয় অভিনয়ের এক অনিশ্চিত ও চ্যালেঞ্জিং লড়াই।
২০০৯ সালে ‘হিরোস’ বা ‘ক্রিমিনাল মাইন্ডস’-এর মতো জনপ্রিয় টিভি সিরিজে ছোট ছোট চরিত্রে তাঁর দেখা মিললেও, সাফল্যের দুয়ার খুলে যায় নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘এভরিথিং সাকস!’-এ অভিনয়ের পর। এরপর এল এইচবিওর ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’-এ ইডেন স্পেনসার চরিত্রে তাঁর অভিনয়, যা তাঁকে মূলধারার দর্শকদের নজরে আনে। তাঁর খ্যাতির সত্যিকার বিস্ফোরণটি ঘটে এইচবিওর কাল্ট সিরিজ ‘ইউফোরিয়া’-তে।
ক্যাসি হাওয়ার্ড নামের এক জটিল, আবেগপ্রবণ, ট্রমাটিক ও আত্মসমালোচনামূলক কিশোরী চরিত্রে তিনি যেন জীবন্ত শিল্প হয়ে ওঠেন। প্রেম, শরীর, যৌনতা, বন্ধুত্ব আর আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েনে ভরা এই চরিত্রে সুইনি তাঁর সমস্ত অন্তর্গত আবেগ ঢেলে দেন। তাঁর চোখে ফুটে ওঠা কষ্ট, হাসির ফাঁকে লুকিয়ে থাকা গভীর হতাশা, আর মুহূর্তের মধ্যে আবেগের রূপ বদলে ফেলা। সব মিলিয়ে ক্যাসি চরিত্রটি হয়ে ওঠে এক আধুনিক প্রতীক–কিশোর বয়সের ভেতরকার বিশৃঙ্খলা, হতাশা ও সৌন্দর্যের জটিল দ্বন্দ্বের জীবন্ত দলিল। সমালোচকেরা বলেন, ‘সিডনি তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে যে ভঙ্গুর ও শক্তিশালী সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অনেক প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীর পক্ষেও করা সম্ভব হয়নি।’
‘ইউফোরিয়া’র সাফল্যের পর সিডনি নিজেকে আটকে রাখেননি এক ধরনের চরিত্রে। তিনি অভিনয় করেন ‘দ্য হোয়াইট লোটাস’-এ। মাইক হোয়াইটের এই সিরিজে তাঁকে দেখা যায় এক ধনী পরিবারের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সর্কাস্টিক, কিন্তু ভিতরে গভীরভাবে একাকী তরুণী অলিভিয়া মসব্যাচার চরিত্রে।
এই সিরিজটি সামাজিক শ্রেণি বিভাগ, আধুনিক সম্পর্ক ও ভণ্ডামি নিয়ে নির্মিত। সিডনি সেখানে এমন নিখুঁতভাবে নিজের চরিত্রকে মিশিয়ে ফেলেছেন যে দর্শক আর আলাদা করে চিনতেই পারে না। কোথায় অভিনয় শেষ, আর কোথায় বাস্তবের সিডনি শুরু। এই চরিত্রই তাঁকে এনে দেয় প্রথম বড় ধরনের স্বীকৃতি–এমি অ্যাওয়ার্ডের নমিনেশন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে মুক্তি পায় রোমান্টিক কমেডি ‘এনিওয়ান বাট ইউ’। এই ছবিতে সুইনি ও গ্লেন পাওয়েলের রোমান্স সামাজিক মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দর্শকরা ভালোবেসে ফেলেন তাদের প্রাণবন্ত কেমিস্ট্রি, আর সমালোচকরা লিখেন, ‘সিডনি পুরোনো রোমান্টিক ঘরানায় নতুন প্রাণ ও আধুনিকতা এনেছেন।’ ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। সিডনি প্রমাণ করেন, তিনি কেবল নাটকীয় ও ভারী চরিত্রেই নয়, হালকা মেজাজের কমেডি ও রোমান্সেও সমান দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য।
এই মুহূর্তে সিডনি শুধু হলিউডের এক তারকা নন; তিনি এক প্রজন্মের কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু অভিনয়ই নয়, নিজের গল্প বলারও মালিকানা নিচ্ছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রযোজনা সংস্থা ‘ফিফটি ফিফটি ফিল্মস’ সক্রিয়ভাবে নতুন ও প্রান্তিক নারী পরিচালকদের সুযোগ দিচ্ছে।
তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যদি আমি নিজেই নিজের গল্প না বলি, তাহলে কে বলবে?’ এই কথাটাই যেন সংজ্ঞায়িত করে তাঁর বর্তমান যাত্রাকে। অভিনয়, প্রযোজনা, আত্মঅন্বেষণ–সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ ও শক্তিশালী শিল্পী হয়ে ওঠা।
আসছে নভেম্বরে মুক্তি পাচ্ছে সিডনি অভিনীত নতুন সিনেমা ‘ক্রিস্টি’। এই সিনেমায় তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন এক নারীযোদ্ধার চরিত্রে। এটি ৯০-এর দশকের কিংবদন্তি মহিলা বক্সার ক্রিস্টি মার্টিনের বায়োপিক। নাম ভূমিকায় সিডনিকে দেখা যাবে সম্পূর্ণ নতুন এক রূপে। শরীরের গঠন থেকে ভঙ্গি, উচ্চারণ থেকে চেহারার ক্লান্তি–সব কিছু বদলে নিয়েছেন তিনি এই চরিত্রের জন্য।
রয়টার্স জানিয়েছে, ছবিটি টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং সিডনির অভিনয়কে বলা হচ্ছে ‘অসাধারণ এক শারীরিক ও মানসিক রূপান্তর’। এ বছরই আসছে তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘দ্য হাউসমেইড’। এটি পরিচালনা করেছেন পল ফেইগ। এই সিনেমায় সিডনি অভিনয় করেছেন এক ধনী পরিবারের রহস্যময় গৃহপরিচারিকার চরিত্রে, যার অতীত অন্ধকারে মোড়া। ইতোমধ্যে ছবিটিকে তুলনা করা হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ান মাস্টারপিস ‘দ্য হ্যান্ডমেইডেন’-এর সঙ্গে। ট্রেলারেই স্পষ্ট। এটি হতে যাচ্ছে সিডনির ক্যারিয়ারের আরেকটি শক্তিশালী ও স্মরণীয় অধ্যায়।
অন্যদিকে, এইচবিও সূত্রে জানা গেছে, ‘ইউফোরিয়া’র তৃতীয় সিজন আসছে। ফলে দর্শকরা আবারও ফিরে পাবেন তাদের প্রিয় ক্যাসি হাওয়ার্ডকে, অর্থাৎ সিডনিকে। বিষয়টি নিয়ে সিডনি নিজেই বলেছেন, ‘ক্যাসির গল্প এখনও শেষ হয়নি, এবার তাকে আরও গভীর ও বাস্তব রূপে দেখা যাবে।’
হলিউডে অনেক তারকা আছেন, কিন্তু খুব কম জনই নিজেদের চরিত্রের ভেতর দিয়ে সমাজ, শরীর, মন ও যৌনতার জটিলতা এতটা নিখুঁত ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেন। সিডনি সুইনি সেই ক’জনের একজন। তিনি একদিকে সৌন্দর্যের প্রতীক, অন্যদিকে সংগ্রাম, স্বাধীনচেতা মন ও আত্মনির্ভরতার জীবন্ত রূপক। তাঁর এই যাত্রা নিঃসন্দেহে হলিউডকে দেবে এক নতুন সংজ্ঞা। #