বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। ছয় ঋতুর এ দেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল। প্রতিটি ঋতুর বৈশিষ্ট্য আলাদা। হেমন্তকে বলা হয় ঋতুকন্যা। খোলাচোখে এ ঋতু হৃদয় কেড়ে নেয়। হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পাকে। সম্রাট আকবর হেমন্তের শেষ মাস অগ্রহায়ণকেই প্রথম মাস ঘোষণা করে খাজনা তোলার প্রচলন করেছিলেন।
কবিগুরুর ভাষায়- হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তামার দানে…।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তার ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় নুতন ধানের নবান্ন উৎসব নিয়ে লিখেছেন, ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণির সওগাত?/নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাত/গিন্নি-পাগল’ চালের ফিরনি/তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত/শিরনি বাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!/
কবি জীবনানন্দ দাশও ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় কার্তিকের এ নবান্নের দেশে আবারও ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে লিখেছিলেন ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে এক রূপ, পরের অগ্রহায়ণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূলত হেমন্ত দুটি বিপরীতধর্মী সময়কে জোড়া লাগানোর কাজ করে। এখন যেমন সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল শেষ হওয়ার পথে। ধানের গোলা শূন্য প্রায়। এ জন্য কার্তিকের দুর্নাম করে বলা হয় ‘মরা কার্তিক’। অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। এ মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালী ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকায়। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, মিরসরাই ও দোহাজারী অঞ্চলসহ অনেক জায়গায় পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। এটা আগাম আমন ধান কাটার মৌসুম। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মহাধুমধামে চলছে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষক যারপরনাই ব্যস্ত। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন তারা।
কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ, পুরোটা জুড়েই সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। নতুন ধানে চলে নবান্ন উৎসব। আমন ধানের চালে প্রথম রান্না হয়। হেমন্তের সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় হলো প্রকৃতি। এ সময় গরম কমে যায়। চলে আসে শীত। সব মিলে দারুণ এক ঋতু হেমন্ত।#
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.