লিভার সুস্থ রাখতে কি করবেন?

বিটিসি হেল্থ ডেস্ক: লিভার আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। শরীরে রক্ত পরিশোধন, শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেওয়া, হজমের জন্য পিত্ত উৎপন্ন করা, শরীরে ভিটামিন এ, ডি, ই-সহ বিভিন্ন উপাদান ধরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে লিভার।
কার্যত শ্বাস নেওয়া ছাড়া শরীরের সব কিছু করতে লিভার গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ এটি আমাদের শরীরে ৫০০টিরও বেশি কাজ করে থাকে।
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়ার পর হজম শেষে গ্লুকোজ ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করে। রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ ইনসুলিনের সাহায্যে প্রবেশ করে বিভিন্ন দেহকোষে। এরপর গ্লুকোজ থেকে শক্তি তৈরি হয় এবং শরীর এই শক্তি ব্যবহার করে।
যদি কেউ অতিরিক্ত পরিমাণ শর্করা জাতীয় খাবার খায়, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তে প্রবেশ করে। এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ লিভার কর্তৃক গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত হয়ে গ্লাইকোজেন স্টোরেজে (লিভার ও পেশি) জমা হতে থাকে। প্রয়োজনের সময় গ্লাইকোজেন দ্রুত গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু গ্লাইকোজেনের পরিমাণ যখন এতটাই বেড়ে যায় যে, গ্লাইকোজেন স্টোরেজে আর কোনো ফাঁকা জায়গা থাকে না, তখন লিভার এই অতিরিক্ত গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনের পরিবর্তে ট্রাইগ্লিসারাইড নামক চর্বিতে রূপান্তরিত করে।
অতিরিক্ত গ্লুকোজ থেকে রূপান্তরিত এই নতুন চর্বি ট্রাইগ্লিসারাইড হচ্ছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা বডি ফ্যাট নামেও পরিচিত। এই ট্রাইগ্লিসারাইড বা বডি ফ্যাট লিভার থেকে তৈরি হয়ে জমা হতে থাকে শরীরের নানা অংশে, বিশেষ করে পেটের মধ্যকার নানা অঙ্গে এবং এর চারপাশে। প্রয়োজনের সময় এই ট্রাইগ্লিসারাইড ভেঙে ফ্যাটি এসিডে রূপান্তরিত হয়ে শক্তির জোগান দেয়। এ-ছাড়া অতিরিক্ত প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার খেলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অ্যামাইনো এসিডও (আমিষের ক্ষুদ্রতম অংশ) লিভার কর্তৃক ট্রাইগ্লিসারাইডে (স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা বডি ফ্যাট) রূপান্তরিত হয়ে জমা হতে থাকে, যা স্থূলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটিকে সুস্থ রাখতে আমাদের কি করা উচিৎ…
# লেবু: প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে এমন লেবু জাতীয় ফল যেমন লেবু, জাম্বুরা, মাল্টা ও কমলা। এই ভিটামিন আপনার শরীরের ভেতরে জমে থাকা নোংরা বের করে দেয়।
# জাম: বাজারে অনেক ধরনের জাম পাওয়া যায়। সবই স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ করে লিভারের জন্য ভাল। কারণ জামের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। লিভারের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে এবং এর কার্যক্ষমতা সঠিক ভাবে বজায় রাখার জন্য জাম খুবই উপকারি।
# আপেল: আপেলের পেক্টিন, ফাইবার দেহের পরিপাক নালী হতে টক্সিন ও রক্ত হতে কোলেস্টেরল দূর করে এবং সাথে সাথে লিভারকেও সুস্থ রাখে। আপেলে আছে আরও কিছু উপাদান- ম্যালিক এসিড যা প্রাকৃতিক ভাবেই রক্ত হতে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে। যেকোন ধরণের আপেলই লিভারের জন্য ভালো।
# পেঁপে: পেঁপেতে রয়েছে পেপিন নামের এনজাইম যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এর ফলে উচ্চমাত্রার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা দেহ থেকে দূষিত উপাদান পরিশোধনের মাধ্যমে লিভারকে সঠিকভাবে কাজ করতে সহযোগিতা করে। ফ্যাটি লিভার রোগীদের জন্য পেঁপে অত্যন্ত কার্যকর।
# সবজি: গবেষকরা জানাচ্ছেন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ছোট্ট বাঁধাকপি যা ব্রাসেলস স্প্রাউটস নামে খ্যাত এমন কপি জাতীয় সবজিতে থাকে একটি বিশেষ উপাদান। ইনডোল নামে ওই উপাদান ফ্যাটি লিভারের সমস্যা মেটাতে বেশ কার্যকরী। দ্য জার্নাল অফ নিউট্রিশন অনুসারে, লিভারের সমস্যা প্রতিরোধে ভীষণ ভাল হল ব্রকোলি।
# বিটরুট: ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিটরুট খাওয়া লিভারের জন্য উপকারী। বিটের মধ্যে থাকে বিশেষ পুষ্টি, যা লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
# গাজর: গাজরের মধ্যে উচ্চমাত্রার ফ্লেভিনয়েড ও বিটা ক্যারোটিন থাকে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট লিভারকে কার্যকর রাখতে সহযোগিতা করে। এই সবজিগুলো নিয়মিত রান্না করে কিংবা কাঁচা খাওয়া যেতে পারে। আবার এই সবজিগুলো জুস করে লেবু মিশিয়ে দু-এক দিন পর পর পান করলে যকৃৎ ভালো থাকে।
# শাক সবজি: সবজির মধ্যে পালং শাক আমাদের শরীরের জন্য খুব ভাল। শাকের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। তাই রোজ খাদ্য তালিকায় শাক রাখতে ভুলবেন না।
# ডাল জাতীয় খাবার: অঙ্কুরিত মুগ আর ছোলার মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি। মুগ, ছোলা খেলে লিভার ভাল থাকে। হজম ক্ষমতা বাড়ে। সেই সঙ্গে থাকে ভিটামিন আর খনিজ এবং রয়েছে উদ্ভিজ প্রোটিন। যা লিভারের কার্যকারিতাকে বাড়িয়ে দেয়।
# মসলা: লবঙ্গ লিভার ফাংশন উন্নত করতে সাহায্য করে। বেশ কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, লবঙ্গে থাকা ইউজেনল লিভার সিরোসিস ও ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। এমনকি লিভারের সাধারণ কার্যকারিতাও উন্নত করতে পারে।
# রসুন: লিভার পরিষ্কার রাখার জন্য উত্তম খাবার হল রসুন। রসুনের এনজাইম লিভারের ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান পরিষ্কার করে। এর আরও দুটি উপাদান যার নাম এলিসিন এবং সেলেনিয়াম যা লিভার পরিষ্কার রাখে এবং ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান হতে রক্ষা করে। প্রতিদিন যে কোন সময় ২/৩ টি রসুনের কোয়া খেয়ে নিন। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভেষজটি ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত মানুষের শরীরের ওজন এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
# তেল জাতীয় খাবার: সূর্যমুখী বীজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই রয়েছে। এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা লিভারকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
# অলিভ ওয়েল: স্বাস্থ্যকর অলিভ ওয়েলে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, অলিভ ওয়েল লিভারের এনজাইমের মাত্রা কমাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
# আখরোট: ওয়ার্ল্ড জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুসারে জানা যায়, আখরোট জাতীয় বাদাম লিভারের রোগে আক্রান্তদের সুস্থতায় বেশ সাহায্য করতে পারে।
# গ্রিন টি: গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রিন টি শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে। গবেষকরা দেখেছেন যে, গ্রিন টি লিভারে চর্বি সঞ্চয় কমাতে পারে এবং লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে।
# মরিঙ্গা বা সজনে পাতা: আদিকাল থেকেই মানুষের মাঝে সজনে বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে সজনের হাজারো গুন, যা একে সুপার ফুডের মর্যাদা দিয়েছে। লিভারের সুস্থতার জন্য এর এন্টি ব্যাকটেরিয়াল গুন বিশেষভাবে কাজ করে।
# লিভার সুস্থ রাখতে কি খাবেন না: তেল চর্বি জাতীয় খাবার, ভাজাপোড়া, চিনি ও চিনি জাতীয় খাবার এবং ফাস্টফুড নামের কয়েক দিনের বাশী পঁচা খাবার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.