রোযা সম্পর্কে কিছু কথা

www.btcnews.com.bd

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: 

রোযার ব্যুৎপত্তি

রোযা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দিন’। আর আরবিতে এর নাম সাওম বা সিয়াম। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোযা। যেহেতু এই আমলটি দিনের শুরু থেকে শেষাংশ পর্যন্ত পালন করা হয় তাই একে রোযা বলা হয়। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি সবল মুসলিমের জন্য রমযান মাসের প্রতিদিন রোযা রাখা ফরজ বা অবশ্য পালনীয়।

 

রোযার প্রকারভেদ

রোযা পাঁচ প্রকার।

  • ফরজ রোযা: যা আবার চার প্রকার-
    • রমযান মাসের রোযা।
    • কোন কারণ বশত রমযানের রোযা ভঙ্গ হয়ে গেলে তার কাযা আদায়ে রোযা।
    • শরীয়তে স্বীকৃত কারণ ব্যতিত রমযানের রোযা ছেড়ে দিলে কাফ্ফারা হিসেবে ৬০টি রোযা রাখা।
    • রোযার মান্নত করলে তা আদায় করা।
  • ওয়াজিব রোযা: নফল রোযা রেখে ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে তা আদায় করা ওয়াজিব।
  • সুন্নত রোযা: মহরম মাসের নয় এবং দশ তারিখে রোযা রাখা।
  • মোস্তাহাব রোযা: প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, এবং ১৫ তারিখে, প্রতি সাপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারে, কোন কোন ইমামের মতে শাওয়াল মাসে পৃথক পৃথক প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ছয়টি রোযা রাখা মোস্তাহাব। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে এক সাথে হোক কিংবা পৃথক পৃথক হোক শাওয়ালের ছয়টি রোযা মাকরূহ।
  • নফল রোযা: মোস্তাহাব আর নফল খুব কাছাকাছির ইবাদত। সহজ অর্থে নফল হলো যা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত নয় এমন ইবাদত পূণ্যের নিয়তে করা। রোযার ক্ষেত্রেও তাই।

রোযার ইতিহাস

রোযার প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোন কিছু জানা যায় না। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক স্পেন্সার নিজের বই Principles of Sociology -তে কতগুলো বন্য সম্প্রদায়ের উদাহরণ এবং জীব বৃত্তান্তের ওপর গবেষণা করে লিখেছেন যে, রোযার প্রাথমিক মানদন্ড এভাবেই হয়তো হয়ে থাকবে যে আদিম বন্য যুগের মানুষ স্বভাবতঃই ক্ষুৎ-পিপাসায় আক্রান্ত থাকতো এবং তারা মনে করতো যে, আমাদের আহার্য বস্তু আমাদের পরিবর্তে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃতদের নিকট পৌঁছে যায়। কিন্তু অনুমানসিদ্ধ উপাত্তকে যুক্তি ও বুদ্ধির আওতাভুক্ত লোকেরা কখনো স্বীকার করে নেয় নি। 

মোট কথা অংশীবাদী ধর্মমতগুলোতে রোযার প্রারম্ভ এবং হাকীকতের যে কোন কারণেই হোক না কেন ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রাথমিক পর্যায় ও শেষ পর্যায়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে নিজের অনুসারীদের ওকালতির প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে না। ইসলামের মূল উৎস কুরআন করীমে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে,

يَا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পার”। (সূরা বাকারা: ১৮৩)

অপর এক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,

রমযান মাস হচ্ছে সেই মাস যার মাঝে কুরআন করীম নাযেল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত, পথ প্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য 

নির্ণয়কারী। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় অথবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোযা অন্যান্য দিনসমূহে আদায় করবে। আল্লাহ্ পাক তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ চান এবং তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না এবং যেন তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং আল্লাহর মহিমা কীর্তন কর এইজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”। (সূরা বাকারা: ১৮৬)

হযরত আদম (আ.)-এর রোযা : হযরত আদম (আ.) যখন নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন এবং তারপর তাওবাহ করেছিলেন তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তাঁর তাওবাহ কবুল হয়নি। ৩০ দিন পর তাঁর তাওবাহ কবুল হয়। তারপর তাঁর সন্তানদের উপরে ৩০টি রোযা ফরয করে দেয়া হয়।

 

হযরত নূহ (আ.)-এর রোযা : নূহ (আ.)-এর যুগেও সিয়াম ছিল। কারণ, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: হযরত নূহ (আ.) ১লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোযা রাখতেন ।

হযরত ইবরাহীম (আ.) ও বিভিন্ন জাতির রোযা : হযরত নূহ (আ.)-এর পরে নামকরা নবী ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। তাঁর যুগে ৩০টি সিয়াম ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কিছু পরের যুগ বৈদিক যুগ।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বেদের অনুসারী ভারতের হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাস ছিল। প্রত্যেক হিন্দী মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের উপর একাদশীর’ উপবাস রয়েছে।

হযরত দাউদ (আ.)-এর রোযা: হযরত মূসা (আ.)-এর পর কিতাবধারী বিখ্যাত নবী ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)। তাঁর যুগেও রোযার প্রচলন ছিল। আল্লাহর রাসুল বলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোযা হযরত দাউদ (আ.)-এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোযায় থাকতেন (নাসাঈ ১ম খণ্ড ২৫০ পৃষ্ঠা, বুখারী, মুসলিম,মিশকাত ১৭৯ পৃষ্ঠা)। অর্থাৎ হযরত দাউদ (আ.) অর্ধেক বছর রোযা রাখতেন এবং অর্ধেক বছর বিনা রোযা থাকতেন।

হযরত ইয়াহইয়া (আ.) যিনি হযরত ঈসা (আ.)-এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোযা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোযা রাখার রীতির প্রচলন ছিল।

আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোযা সম্পর্কে কমবেশী ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মুহররম) দিনে এ জন্য রোযা রাখতো যে, এই দিনে খানা কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল: ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ২৪৪) মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করতো। (সহীহ বুখারী: কিতাবুস সওম, ১ম খন্ড, পৃ: ১৬২) অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের ১০ম দিনে রোযা রাখতো।

রোযার উদ্দেশ্য

রোযা রাখা বা সিয়ামের উদ্দেশ্য হলো, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরহেজগারি বা তাকওয়া বৃদ্ধি করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)।

‘তাকওয়া’ শব্দটির মূল অর্থ ‘রক্ষা করা।’ এর অনুবাদ করা হয়েছে নানাভাবে। যেমন পরহেজগারি, আল্লাহর ভয়, দ্বীনদারি, সৎ কর্মশীলতা, সতর্কতা প্রভৃতি। রোযা রাখা হয় এ জন্য যে, এই তাকওয়ার দীক্ষায় আমরা দীক্ষিত হবো। রোযা ঢালের মতো কাজ করে, যা গোনাহের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা আখেরাতে আল্লাহতায়ালার প্রদত্ত শাস্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। 

রোযার শর্ত

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের দ্বিতীয়টি হলো রোযা। রোযার কিছু মৌলিক আচার আছে। যা ফরজ বলে চিহ্নিত। অন্যদিকে, ইসলাম কোনো ক্ষেত্রেই জোরজবরদস্তি করে না। রোযার ক্ষেত্রেও তাই। সুস্থ-সবল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। কিন্তু শারীরিক অসমর্থতার কারণে সে এ দায়িত্ব থেকে আপাতভাবে মুক্তি পেতে পারে। এর প্রতিবিধানে রয়েছে কাজা ও কাফফারার বিধান। ইসলাম নিজেকে সরল পথ বলে দাবি করে। তাই আচারিকভাবে সকল অবস্থা বিবেচনায় করা হয়। নিচে রোযার ফরজ ও শর্তগুলো দেওয়া হলো-

রোযার ৩ ফরজ :

  • নিয়ত করা
  • সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা
  • যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা।

রোযা রাখার ৪ শর্ত :

  • মুসলিম হওয়া
  • বালেগ হওয়া
  • অক্ষম না হওয়া
  • ঋতুস্রাব থেকে বিরত থাকা নারী।

 

রোযা ভঙ্গ হইলে

বিনা কারণে রোযা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোযা ভঙ্গ হবে, ততটি রোযা আদায় করতে হবে। কাজা রোযা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোযার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোযাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে।

  • একটি রোযা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোযা রাখতে হবে। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোযার মাঝে কোনো একটি ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
  • যদি কারও জন্য ৬০টি রোযা পালন সম্ভব না হয় তাহলে সে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খানা দেবে। অপর দিকে কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোযা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খানা খাওয়াতে হবে।
  • গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।

যেসব কারণে রমযান মাসে রোযা ভঙ্গ করা যাবে কিন্তু পরে কাজা করতে হয় তা হচ্ছে;

  • মুসাফির অবস্থায়।
  • রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে।
  • মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে।
  • এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে।
  • শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে।
  • কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে।
  • মহিলাদের মাসিক হায়েজ-নেফাসকালীন রোজা ভঙ্গ করা যায়।

যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হয় (অর্থাৎ একটির পরিবর্তে একটি) :

  • স্ত্রীকে চুম্বন বা স্পর্শ করার কারণে যদি বীর্যপাত হয়।
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে।
  • পাথরের কণা, লোহার টুকরা, ফলের বিচি গিলে ফেললে।
  • ডুশ গ্রহণ করলে।
  • বিন্দু পরিমান কোন খাবার খেলে তবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা মনের ভুলে যা খাওয়াই হোক না কেন রোযা ভাংবে না তবে মনে আসলেই তাকে তৎক্ষণাৎ খাবার খাওয়া বন্দ করে দিতে হবে।
  • নাকে বা কানে ওষুধ দিলে (যদি তা পেটে পেঁৗছে)।
  • মাথার ক্ষতস্থানে ওষুধ দেওয়ার পর তা যদি মস্তিষ্কে বা পেটে পেঁৗছে।
  • যোনিপথ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সহবাস করার ফলে বীর্য নির্গত হলে।
  • স্ত্রী লোকের যোনিপথে ওষুধ দিলে।

রোযার ফযিলত

রমযানরে একটি বিশেষ ফজিলত বা মাহাত্ন হচ্ছে,এই পবিত্র রমযান মাসে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রমযান মাসের রোযা মানুষকে পাপ-পন্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়,মানুষের কুপ্রবৃত্তি ধুয়ে মছে দেয় এবং আত্নাকে দহন করে ঈমানের শাখা প্রশাখা সন্জীবীত করে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এই মর্মে মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন,

রোযাদারের জন্য দুটি খুশি একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।(বুখারী ও মুসলিম)

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.