রূপকথার ধ্বনি, ইতিহাসের ঘ্রাণ — খুলনা ডুমরিয়ার ধামালিয়া জমিদারবাড়ি ও ড. বাকার : এক যুগান্তরের ফিচার

খুলনা ব্যুরো: একটা সময় ছিল, যখন সময় নিজেই দাঁড়িয়ে থাকত ধামালিয়ার জমিদারবাড়ির উঠোনে। আকাশ থেকে সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়ত, তখন মনে হতো, পুকুরের শানবাঁধানো পাড়ে সূর্যটা বিশ্রাম নিচ্ছে। খাল, দীঘি, তিন গম্বুজ মসজিদ, আর কলসীর পিতলের ঝিকিমিকি—সবকিছু যেন বলত, “আমরা হারিয়ে যাইনি, কেবল অপেক্ষা করছি পুনর্জন্মের।”
এই পুনর্জন্মের মহানায়ক হলেন, একজন বিজ্ঞানী—ড. সামছুল করিম বাকার। একদা ধ্বংসপ্রায় জমিদার বাড়ি আজ তাঁর স্বপ্ন ও কৌশলে হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের আধুনিক পাঠশালা।
ধামালিয়া জমিদার পরিবারের শেকড় ছড়িয়ে ছিল অবিভক্ত বাংলার জমিনে।
বিশেষ করে মুন্সী বাবর আলী সরদার থেকে আহাদ আলী সরদার, এবং পরবর্তীতে ভেকন আলী সরদারের শাসনামলে জমিদারী ছড়িয়েছিল যশোর, ফুলতলা, দাকোপ ও কেশবপুরের বিস্তৃত অঞ্চলে।
জনশ্রুতি আছে—ঘুনি জালে একদিন মাছ নয়, উঠে এসেছিল রৌপ্য মুদ্রা।
শোনা যায়, পুকুরে পানি না ওঠায় এক সাধু বলেছিলেন, জমিদার-পত্নীকে উৎসর্গ করলে মিলবে জল। কিন্তু জমিদার ভিন্ন পথ নিলেন। কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন উজির মিস্ত্রি। পুকুরের তিন পাড় ও তলদেশ শান বাঁধিয়ে, পাশ দিয়ে ড্রেন তৈরি করে পানি নিয়ে এলেন। এ গল্প প্রমাণ করে—জ্ঞান আর স্থিরতা রূপকথার বিকল্প।
১৭১৭ সালে নির্মিত ধামালিয়া জমিদার মসজিদ স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। তিনটি গম্বুজ খোদাই করা, পিতলের কলসী বসানো সেই গম্বুজে। নির্মাণে অংশ নিয়েছিলেন কলকাতার খ্যাতনামা মিস্ত্রিরা। অদ্ভুত সূক্ষ্মতায় গাঁথা হয়েছে প্রতিটি ইট, যেন যুগ যুগ ধরে ইতিহাস বলবে এই স্থাপনা। আজও মসজিদের চূড়ায় পিতলের ঢাকনা, নকশার ভেতরে ঝিরঝিরে ইতিহাস, এবং তার নিচে প্রার্থনায় মগ্ন মানুষ।
কলকাতায় ইটভাটা, কাঠের ব্যবসা, ঠিকাদারী, নদীপথে বরুনা বন্দর গড়ে ওঠা—এইসবের মধ্য দিয়ে জমিদার পরিবার হয় ধনাঢ্য। কিন্তু সময় শাসন মানে না। জমিদারির অবসান, আদালতে মামলাজট, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, এবং সামাজিক পট পরিবর্তনের ঢেউয়ে ধামালিয়ার প্রাসাদ একসময় হয়ে ওঠে জরাজীর্ণ ইতিহাসের সাক্ষী।
আধুনিক রূপকথার মানুষ ড. এসকে বাকার। ১৯৬৯ সাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে অনার্সে প্রথম, পরের বছর এমএসসিতে প্রথম। তারপর লেকচারার হয়ে পাড়ি জমান কানাডায়, কমনওয়েলথ স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষা। এরপর পিএইচডি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর গবেষণার ঝলকানি—কোলগেট, পালমোলিভ, চারটি পেটেন্ট, দাঁতের গুঁড়া থেকে শুরু করে বিশুদ্ধ জীবাণুনাশক উদ্ভাবন। কিন্তু… তার জীবনের আসল বিজ্ঞান ছিল, “মানবসেবা।”
ড. বাকার তাঁর গ্রামের মানুষের জন্য ফিরলেন স্বপ্ন হাতে নিয়ে। গড়ে তুললেন ড. এসকে বাকার কলেজ, যা ২০১৯ সালে এমপিওভুক্ত হয়। নির্মাণ করলেন রঘুনাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুইটি ভবন, প্রতিষ্ঠা করলেন লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন, মজিদুল ইসলাম হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, বাকার সৈকত সঙ্গীত একাডেমি, আর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করলেন ভবন, আসবাব ও প্রযুক্তি। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল যেন একেকটি বিজ্ঞানভিত্তিক মানবিক গবেষণা—গন্তব্য, মানুষের উন্নয়ন।
এক সাক্ষাৎকারে ড. বাকার বলেছিলেন, “সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কেউ যখন কাজ করে, তার আনন্দ হয় গভীর এবং আত্মতৃপ্তির মতো। জমিদার না হলেও যদি মানুষ উপকারে আসে, সেটাই প্রকৃত গৌরব।”
ধামালিয়া জমিদার বাড়ি আজ আর শুধু এক ইট-কাঠের নিদর্শন নয়। এটি এক প্রাণবন্ত শিক্ষাকেন্দ্র, সামাজিক রূপান্তরের কেন্দ্র, এবং অতীত গৌরবের আধুনিক ভাষ্য।
ড. এসকে বাকার প্রমাণ করেছেন—যে প্রাচীন ছিল গল্প, তা নতুন প্রজন্মের কাছে হতে পারে প্রেরণা। ইতিহাস তখনই অমর হয়, যখন তা নতুন রূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ডুমুরিয়ার ইতিহাসবিদ কবি শেখ আব্দুল জলিল বলেন, “ড. বাকার ধ্বংসপ্রায় ঐতিহ্যকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছা থাকলে একজন মানুষই সমাজের রূপ পাল্টাতে পারেন।” এ যেন জমিদারির পুনর্জন্ম—নতুন অবয়বে, নতুন অর্থে। যেখানে জমি নয়, হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে মানুষ জয় করা হয়।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.